
গায়ের উপর অনবরত পড়ছে চিনা ড্রাগনের গরম নিঃশ্বাস! ফলে আতঙ্কে ঘুম উড়েছে প্রশান্ত মহাসাগরের বুকের ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্রের। তাদের গিলে খেতে মুখ হাঁ করেই রয়েছে বেজিং। এই পরিস্থিতিতে ঢাল হয়ে পাশে দাঁড়াল আটলান্টিকের পারের আর এক ‘সুপার পাওয়ার’। সেখান থেকে অত্যাধুনিক লড়াকু জেট চলে আসায় ড্রাগনের চোখরাঙানির মুখের মতো জবাব দেওয়া যাবে বলে মনে করছেন সমুদ্রে ঘেরা দেশটির আমজনতা থেকে সরকার।

দীর্ঘ দিন ধরেই প্রশান্ত মহাসাগরের সাবেক ফরমোজা দ্বীপ (বর্তমানে তাইওয়ান) দখলের ছক কষছে চিন। এলাকাটিকে স্বাধীন, সার্বভৌম দেশ বলে মানতে নারাজ বেজিং। উল্টে তা নিজেদের অংশ বলে দাবি ঠুকেছে ড্রাগন। শুধু তা-ই নয়, বিবাদে উস্কানি দিতে প্রায়ই তাইওয়ানের আকাশসীমায় ঢুকে দাদাগিরি চালিয়ে থাকে চিনের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএর বায়ুসেনা। এই আবহে অতি শক্তিশালী এফ-১৬ ভাইপার যুদ্ধবিমান তাইপের হাতে তুলে দিল ওয়াশিংটন।

তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক জানিয়েছে, মোট ৬৬টি লড়াকু জেটের মধ্যে প্রথম ধাপের যুদ্ধবিমানগুলি সরবরাহ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। উল্লেখ্য, এফ-১৬ ভাইপার নির্মাণের নেপথ্যে হাত রয়েছে আমেরিকার জনপ্রিয় সামরিক সংস্থা লকহিড মার্টিনের। যুদ্ধবিমানগুলিকে তাইপে বায়ুসেনাকে সরবরাহ করতে দক্ষিণ ক্যারোলিনার কারখানায় একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে তারা। সেই ছবি এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) পোস্ট করেছেন মার্কিন রাজনীতিক তথা পার্লামেন্ট কংগ্রেসের সদস্য উইলিয়াম টিমন্স।

এ ব্যাপারে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন তাইওয়ানের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মহাসচিব জোসেফ উ। একটি এফ-১৬ ভাইপার লড়াকু জেটের সামনে দাঁড়িয়ে ক্যামেরায় পোজ় দিয়েছেন তিনি। পরে সমাজমাধ্যমে সেই ছবি আপলোড করে তিনি লেখেন, ‘‘আকাশ রক্ষার জন্য এ বার আমাদের বহরে শামিল হবে ৬৬টি যুদ্ধবিমান।’’ এফ-১৬ ভাইপারের ছোবলে ড্রাগনের পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমানগুলিকে সহজেই নাস্তানাবুদ করা যাবে বলে আত্মবিশ্বাসী তাইপের বায়ুসেনা।

স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলির দাবি, প্রথম ধাপে তাইওয়ানকে মোট সাতটি ট্যাকটিক্যাল ফাইটার উইং সরবরাহ করছে লকহিড মার্কিন। পূর্ব দিকের আকাশসীমার নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে সম্প্রতি বিমানবাহিনীর একটি নতুন ইউনিট গঠন করেছে প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র। এফ-১৬ ভাইপারগুলি সেখানেই ব্যবহার হবে বলে সূত্র মারফত মিলেছে খবর। এই লড়াকু জেট চালানো এবং সেখান থেকে হামলা চালানোর প্রশিক্ষণ যুক্তরাষ্ট্রের থেকে নিচ্ছে তাইপের বায়ুসেনা।

২০২২ সালে তাইওয়ান সফরে যান তৎকালীন মার্কিন পার্লামেন্ট কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ হাউস অফ রিপ্রেজ়েন্টেটিভের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি। বিষয়টিকে একেবারেই ভাল চোখে দেখেনি বেজিং। ফলে পরবর্তী সময়ে বার বার প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্রটিকে যুদ্ধজাহাজ দিয়ে ঘিরে মহড়ার মাধ্যমে মারাত্মক চাপ তৈরি করেছে ড্রাগন নৌসেনা। এতে তাইওয়ান জুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের কথায়, তাইওয়ান প্রণালীতে ক্রমাগত শক্তি বৃদ্ধি করে চলেছে চিন। পিএলএ নৌসেনার কাছে ‘উভচর’ প্রজাতির যুদ্ধজাহাজ ও উপকূলে আক্রমণ শানানোর ছোট জলযান রয়েছে। সেগুলির মাধ্যমে ট্যাঙ্ক বা সাঁজোয়া গাড়ি উপকূলে নামাতে পারলে দ্বীপরাষ্ট্রটিকে কব্জা করা তাঁদের পক্ষে খুব কঠিন হবে না। আর তাই প্রত্যাঘাত শানাতে আমেরিকার দ্বারস্থ হয় তাইপে। এফ-১৬ ভাইপার যে সাবেক ফরমোজা দ্বীপের বায়ুসেনার শক্তি অনেকটাই বৃদ্ধি করল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

দ্য ইউরেশিয়ান টাইম্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৬৬টি নতুন যুদ্ধবিমান কেনার পাশাপাশি ১৩৯টি লড়াকু জেট সংস্কারে বিপুল খরচ করছে তাইপে সরকার। এই কর্মসূচির নামকরণ করা হয়েছে ‘পিস ফিনিক্স রাইজ়িং’। বিশ্লেষকদের অনুমান, আগামী দিনে পঞ্চম প্রজন্মের চিনা যুদ্ধবিমান জে-২০র সঙ্গে মার্কিন এফ-১৬ ভাইপারের দ্বৈরথ দেখতে পাবে গোটা বিশ্ব। আর তখনই আসল শক্তি পরীক্ষা হবে ড্রাগনের লড়াকু জেটের।

লকহিড মার্টিনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এফ-১৬ ভাইপার চতুর্থ প্লাস প্লাস প্রজন্মের যুদ্ধবিমান। এতে আর এক মার্কিন প্রতিরক্ষা সংস্থা নর্থরোপ গ্রুমম্যানের অ্যাজ়াইল বিম রাডার ব্যবহার করা হয়েছে। ইলেকট্রনিক লড়াইয়ে এটি বেশ পটু। তা ছাড়া একাধিক অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্রে এফ-১৬ ভাইপারকে সাজানো হয়েছে। সংঘর্ষের সময়ে একের পর এক রণতরী ধ্বংস করে লড়াইয়ের মুখ রাতারাতি বদল করার ক্ষমতা রয়েছে এই যুদ্ধবিমানের।

তাইওয়ানের এফ-১৬ ভাইপারে থাকছে আকাশ থেকে ভূমিতে হামলাকারী এজিএম-৮৪ হারপুন ক্ষেপণাস্ত্র (এয়ার টু গ্রাউন্ড মিসাইল)। এটির সাহায্যে চিনা যুদ্ধজাহাজগুলিকে নিশানা করতে পারবেন তাইপের বায়ুবীরেরা। এ ছাড়া লড়াকু জেটটিতে এজিএম-১৫৪ জয়েন্ট স্টাফ অফ ওয়েপেন এবং এজিএম-৮৮ হাইস্পিড অ্যান্টি রেডিয়েশন ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে।

এ ছাড়া চিনের রক্তচাপ বাড়িয়ে বিপুল পরিমাণে জয়েন্ট এয়ার-টু-সারফেস স্ট্যান্ডঅফ ক্ষেপণাস্ত্র কিনেছে তাইওয়ান। জিপিএস জ্যামিং-সহ ইলেকট্রনিক যুদ্ধের মধ্যেও দিব্যি কাজ করতে পারে এই হতিয়ার। অন্য দিকে ২০০-র বেশি পঞ্চম প্রজন্মের জে-২০ লড়াকু জেট তৈরি করেছে ড্রাগন সরকার। পিএলএর পাঁচটি ফৌজি থিয়েটারে সেগুলি মোতায়েন রয়েছে। লালসেনার কাছে এই লড়াকু জেটের পোশাকি নাম ‘মাইটি ড্রাগন’।

গত বছরের নভেম্বরে পঞ্চম প্রজন্মের দ্বিতীয় যুদ্ধবিমান জে-৩৫এ-কে বিশ্বের সামনে এনে শক্তি প্রদর্শন করেন চিনা প্রেসিডেন্ট তথা চেয়ারম্যান শি জিনপিং। পাশাপাশি, ষষ্ঠ প্রজন্মের দু’টি লড়াকু জেট, জে-৩৬ এবং জে-৫০-র প্রোটোটাইপ বা নমুনা হাতে পেয়েছে পিএলএ বায়ুসেনা। ২০২৪ সালের ঝুহাই এয়ার শোয়ে এর মধ্যে একটিকে পরীক্ষামূলক ওড়ানো হয়। ড্রাগনের এই ষষ্ঠ প্রজন্মের যুদ্ধবিমানের নেই লেজের মতো কোনও অংশ।

সূত্রের খবর, ২০৩০ সালের মাঝামাঝি ষষ্ঠ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান পিএনএ বায়ুসেনার বহরে যুক্ত করবে বেজিং। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, স্টেলথ প্রযুক্তির কারণে চিনের জে-২০ এবং জে-৩৫ লড়াকু জেটগুলিকে চিহ্নিত করা তাইপের পক্ষে বেশ কঠিন হবে। আর সেই কারণেই ২০২৩ সালের অগস্টে প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্রকে ইনফ্রারেড অনুসন্ধান ও ট্র্যাকিং সিস্টেম (ইনফ্রারেড সার্ভেল্যান্স ট্রাকিং সিস্টেম) বিক্রির অনুমোদন দেয় যুক্তরাষ্ট্রের সরকার।

চিনের সরকারি সংবাদ সংস্থা ‘গ্লোবাল টাইমস’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এফ-১৬ ভাইপার থাকা সত্ত্বেও তাইওয়ানকে জে-২০ দিয়ে গুঁড়িয়ে দিতে পারবে পিএলএ বায়ুসেনা। মার্কিন লড়াকু জেট আকাশে ওঠার আগেই সেগুলিকে ধ্বংস করা হবে। কারণ বেজিঙের কাছে রয়েছে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র। সেই অস্ত্র দিয়ে দ্বীপরাষ্ট্রকে ইনফ্রারেড অনুসন্ধান ও ট্র্যাকিং সিস্টেমে ওড়াতে পারবে তারা।

যুদ্ধবিমানের সংখ্যার নিরিখে অনেক এগিয়ে আছে চিন। পিএলএ বায়ুসেনার বহরে ১,৫০০-র বেশি লড়াকু জেট রয়েছে। সেখানে তাইপের কাছে সব মিলিয়ে আছে ৪০০টির মতো যুদ্ধবিমান। তার সবগুলি যে এফ-১৬ ভাইপার, তা নয়। তাইপের আকাশযোদ্ধাদের বহরে রয়েছে পুরনো এফ-৫, মিরাজ়-২০০০ এবং স্থানীয় ভাবে উৎপাদিত এফ-সিকে-১ লড়াকু জেট।

কিন্তু, এ ক্ষেত্রে পাল্টা যুক্তিও রয়েছে। প্রথমত, চিনের তৈরি যুদ্ধবিমানগুলি কোনও লড়াইয়ে অংশ নেয়নি। এফ-১৬ ভাইপারের আবার সোনালি ইতিহাস রয়েছে। এই লড়াকু জেট পাকিস্তানের বায়ুসেনাও ব্যবহার করে। এ ছাড়া ইজ়রায়েল ডিফেন্স ফোর্স বা আইডিএফের বহরেও রয়েছে বেশ কিছু এফ-১৬ ভাইপার।

দ্বিতীয়ত, চিন সত্যি সত্যি তাইওয়ান আক্রমণ করলে দ্বীপরাষ্ট্রটিকে রক্ষা করতে সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে নামতে পারে আমেরিকা। সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অতি আধুনিক লড়াকু জেট এফ-৩৫ লাইটনিং টু বা বোমারু বিমান বি-২ স্পিরিটের সামনে পড়বে বেজিং। ড্রাগনের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) সেগুলিকে কতটা সামলাতে পারবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

প্রসঙ্গত, চিনের মতো ষষ্ঠ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এফ-৪৭ নামের ওই লড়াকু জেট একসঙ্গে বহু ড্রোন নিয়ে উড়ে গিয়ে হামলা চালাতে পারবে বলে জানিয়েছেন তিনি। বিখ্যাত বিমান প্রস্তুতকারী সংস্থা বোয়িংকে এর নির্মাণের দায়িত্ব দিয়েছে আমেরিকার প্রতিরক্ষা সদর দফতর পেন্টাগন। এফ-৪৭-কে আকাশের পরবর্তী প্রজন্মের অধিপতি (নেক্সড জেনারেশন এয়ার ডোমিন্যান্স) বলে দাবি করেছে ওয়াশিংটন।
সব ছবি: সংগৃহীত।