
ফের পাকিস্তানের গালে বিরাশি সিক্কার থাপ্পড়! শ্রীলঙ্কাকে সঙ্গে নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে ঘোঁট পাকানোর পরিকল্পনা করেছিল ইসলামাবাদ। কিন্তু কলম্বো তাতে জল ঢেলে দেওয়ায় মুখ লুকোনোর জায়গা নেই রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তাদের। অন্য দিকে, এই ঘটনায় দক্ষিণ দ্বীপরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত হয়েছে নয়াদিল্লির।

সংবাদ সংস্থা পিটিআইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারত-শ্রীলঙ্কার মাঝের কৌশলগত জলপথ ত্রিঙ্কোমালি উপকূলে কলম্বোকে সঙ্গে নিয়ে নৌমহড়ার পরিকল্পনা করে পাকিস্তান। সেই খবর প্রকাশ্যে আসতেই এতে আপত্তি জানায় নয়াদিল্লি। এর পরই সংশ্লিষ্ট মহড়া বাতিল করে কলম্বো। বিষয়টি নিয়ে অবশ্য মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে ইসলামাবাদ।

চলতি বছরের এপ্রিলে তিন দিনের সফরে দক্ষিণের দ্বীপরাষ্ট্রে যান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সূত্রের খবর, তিনি সেখানে পা রাখার কয়েক সপ্তাহ আগে কলম্বোর সঙ্গে এই যৌথ মহড়ার পরিকল্পনা করে পাক নৌসেনা। যদিও এই নিয়ে কোনও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা থেকে বিরত ছিল ইসলামাবাদ।

শ্রীলঙ্কার উত্তর-পূর্ব উপকূলের ত্রিঙ্কোমালির কৌশলগত অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখান থেকে বঙ্গোপসাগর এবং উত্তর-পূর্ব ভারত মহাসাগরের বিস্তীর্ণ এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ রয়েছে। আর তাই প্রস্তাবিত মহড়ার খবর মিলতেই ভুরু কোঁচকায় নয়াদিল্লি।

প্রসঙ্গত, এর পর আর সময় নষ্ট না করে কলম্বোর সঙ্গে যোগাযোগ করে মোদী প্রশাসন। লঙ্কা সরকারকে উদ্বেগের বিষয়টি সবিস্তার জানান সেখানে কর্মরত ভারতীয় হাই কমিশনার। এই ধরনের যৌথ মহড়া এলাকার নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে পারে বলেও স্পষ্ট করা হয়। ফলে পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে পেরে পাক নৌসেনার সঙ্গে মহড়া বাতিল করেন কলম্বোর জলযোদ্ধারা।

লঙ্কা সরকারের এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন ত্রিঙ্কোমালির বাসিন্দারা। বিষয়টি নিয়ে সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খোলেন তাঁরা। এলাকাবাসীদের কথায়, ‘‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে ভারতকে নিশানা করতেই এই নৌমহড়ার আয়োজন করা হচ্ছিল। এতে কলম্বো ও নয়াদিল্লির সম্পর্কে ফাটল ধরার প্রবল আশঙ্কা ছিল। মহড়া বাতিল করে সেটা এড়ানো গিয়েছে।’’

উল্লেখ্য, গত বছর সমুদ্র গবেষণায় যুক্ত বিদেশি জাহাজের শ্রীলঙ্কার জলসীমায় প্রবেশে এক বছরের নিষেধাজ্ঞা জারি করে কলম্বোর সরকার। ২০২২ সাল থেকে দক্ষিণের দ্বীপরাষ্ট্রটিতে চিনা নজরদারি জাহাজের আনাগোনা বৃদ্ধি পায়। এই নিয়ে প্রবল আপত্তি তোলে নয়াদিল্লি। বিশ্লেষকদের দাবি, মোদী সরকারের চাপে শেষ পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা জারি করতে বাধ্য হয় লঙ্কা সরকার।

২০২২ সালের অগস্টে শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দরে নোঙর করে চিনা নৌসেনার ক্ষেপণাস্ত্র এবং কৃত্রিম উপগ্রহের উপর নজরদারিতে সক্ষম গুপ্তচর জাহাজ ইউয়ান ওয়াং ৫। এতে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হওয়ায় কলম্বোর উপর চাপ বাড়াতে থাকে নয়াদিল্লি। ফলে দক্ষিণের প্রতিবেশী দ্বীপরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কে চিড় ধরে ভারতের।

ঠিক এর এক বছরের মাথায় ২০২৩ সালের অগস্টে ফের হাম্বানটোটায় নোঙর করে চিনা লালফৌজের আর একটি যুদ্ধজাহাজ। এতে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। উল্লেখ্য, ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে হাম্বানটোটা বন্দরটি একরকম দখলই করে রেখেছে বেজিং। ফলে প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হচ্ছে বুঝতে পেরেও ড্রাগনকে আটকাতে পারছিল না কলম্বো।

শেষে ২০২৪ সালে এ ব্যাপারে সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে লঙ্কা সরকার। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, এই পরিস্থিতিতে ভারতের উপর নজরদারিতে পাকিস্তানকে ব্যবহার করতে চাইছে চিন। ইসলামাবাদের নৌমহড়ার পরিকল্পনা তারই অঙ্গ বলে মনে করেন তাঁরা।

দীর্ঘ দিন ধরেই কলম্বো ও ইসলামাবাদের নৌসেনার মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। দু’দেশের রণতরীগুলিকে প্রায়ই একে অপরের নৌঘাঁটিতে নোঙর করতে দেখা যায়। যৌথ মহড়াতেও যোগ দেয় তারা। তবে এর আগে কখনওই ত্রিঙ্কোমালির মতো কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় দু’দেশের নৌবাহিনী গা ঘামানোর পরিকল্পনা করেনি। ফলে সন্দেহ দানা বেঁধেছিল।

এপ্রিলের লঙ্কা সফরে ত্রিঙ্কোমালিকে শক্তিকেন্দ্র হিসাবে গড়ে তুলতে কলম্বোর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি করেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে ভারতের সঙ্গে কাজ করবে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি। এটি সাফল্য পেলে ত্রিঙ্কোমালির জ্বালানি এবং বিদ্যুতের সঙ্কট অনেকাংশে পূরণ হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

৭ এপ্রিল কলম্বো সফরের শেষ দিনে অনুরাধাপুরায় বোধিবৃক্ষ দর্শন করেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। সম্রাট অশোকের কন্যা সিংহলে যে চারাগাছ এনেছিলেন, তা থেকেই এই বোধিবৃক্ষের উৎপত্তি বলে বিশ্বাস দু’দেশের বাসিন্দাদের। মোদীর সঙ্গে ছিলেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট অনুরা কুমার দিশানায়েক।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে হওয়া নির্বাচনে দক্ষিণের দ্বীপরাষ্ট্রে দেখা গিয়েছে বাম দলগুলির জয়জয়কার। ভোটে জিতে দশম প্রেসিডেন্ট হিসাবে কুর্সিতে বসেন জনতা বিমুক্তি পেরামুনা বা জেভিপির পলিটব্যুরোর সদস্য দিশানায়েকে। রাজনীতির ময়দানে ভারত-বিরোধী ও চিনপন্থী হিসাবে পরিচিতি ছিল তাঁর। যদিও ক্ষমতায় আসার পর থেকে নয়াদিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করার রাস্তাতেই হেঁটেছেন তিনি।

কুর্সিতে বসার পর প্রবল ভারত বিরোধিতার রাস্তায় শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট হাঁটবেন না বলে ইঙ্গিত দেন বিশ্লেষকদের একাংশ। কারণ দ্বীপরাষ্ট্রটির ঋণখেলাপি অবস্থা পুরোপুরি কাটেনি। এই অবস্থায় আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার বা আইএমএফের থেকে নতুন করে ঋণ নিতে হলে ভারতের সাহায্য প্রয়োজন হবে। বাস্তবে সেই ছবিই দেখা গিয়েছে।

শ্রীলঙ্কার অনুরাধাপুরায় দু’টি রেল প্রকল্পের কাজ শেষ করেছে নয়াদিল্লি। এপ্রিলের সফরে সেগুলির উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। সেই অনুষ্ঠান দেখতে ভিড় জমিয়েছিলেন স্থানীয়েরা। ভারতের রেল মন্ত্রকের অধীনস্থ একটি সংস্থার তৈরি ওই দু’টি প্রকল্পকে শ্রীলঙ্কার পরিকাঠামোয় ভারতের গুরুত্বপূর্ণ অবদান বলে মনে করা হচ্ছে।

মোদীর সফর শেষের সঙ্গে সঙ্গেই অন্তত ১১ জন ভারতীয় মৎস্যজীবীকে মুক্তি দিয়েছে শ্রীলঙ্কা সরকার। দিশানায়েকের সঙ্গে মোদীর বৈঠকে দক্ষিণ ভারতের মৎস্যজীবীদের সে দেশের জলসীমায় ঢুকে পড়ার অভিযোগে গ্রেফতারির প্রসঙ্গ উঠেছিল। গোটা বিষয়টিই মানবিক ভাবে দেখার কথা বলেছিলেন মোদী।

বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, নৌমহড়া বাতিল হওয়ার বিষয়টি যে সহজে ইসলামাবাদ হজম করে নেবে তা নয়। কারণ সম্প্রতি পাক সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরকে ভারতের নাম না করে হিন্দুদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতে শোনা গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে সম্পর্ক ধীরে ধীরে মজবুত হওয়াকে মোদী সরকারের ‘মাস্টারস্ট্রোক’ বলে উল্লেখ করেছেন তাঁরা।
সব ছবি: সংগৃহীত।