
জাফর এক্সপ্রেস ছিনতাই এবং পণবন্দিদের উদ্ধার নিয়ে মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে পাকিস্তান। ‘বালোচ লিবারেশন আর্মি’ (বিএলএ)-র এ-হেন দাবিতে মুখ লুকোনোর জায়গা খুঁজছে ইসলামাবাদ। অন্য দিকে রীতিমতো প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারি করে রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তাদের ‘মিথ্যা’র ফিরিস্তি দিয়েছেন বালোচ বিদ্রোহীরা। পরিস্থিতি সামলাতে তড়িঘড়ি ভারত ও আফগানিস্তানের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে হাত ধুয়ে ফেলতে মরিয়া শাহবাজ় শরিফের সরকার।

গত ১১ মার্চ বালোচিস্তানের রাজধানী কোয়েটা থেকে খাইবার-পাখতুনখোয়ার পেশোয়ারগামী জাফর এক্সপ্রেস ছিনতাই করেন বিএলএ যোদ্ধারা। রেলযাত্রীদের একাংশকে পণবন্দি করেন তাঁরা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অভিযানে নামে পাক সেনার স্পেশ্যাল সার্ভিস গ্রুপ, ফ্রন্টিয়ার কর্পস, বায়ুসেনা এবং আধাসেনা। ফলে কিছু ক্ষণের মধ্যেই বালোচিস্তানের পাহাড়ি এলাকায় দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনটির মাথার উপর ঘুরতে দেখা যায় ফৌজি কপ্টার।

এর পর ১২ মার্চ রাতে অভিযান শেষ বলে বিবৃতি দেয় পাক সেনা। সেখানে বলা হয়, ৩৩ জন বালোচ বিদ্রোহীকে জাহান্নামে পাঠানো হয়েছে। উদ্ধার হওয়া পণবন্দির সংখ্যা ৩০০ বলে দাবি করে রাওয়ালপিন্ডি। আর এখানেই তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা। কারণ বিএলএর দাবি, যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি। পণবন্দিরা তাঁদের কব্জাতেই রয়েছেন। এই নিয়ে মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে জেনারেল আসিফ মুনিরের ফৌজ।

১৩ মার্চ এই ইস্যুতে বিবৃতি দেন বিএলএ মুখপাত্র জ়িয়ান্দ বালোচ। তাঁর কথায়, ‘‘ট্রেন ছিনতাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীদের একাংশকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তাঁদেরই নাম উদ্ধারের তালিকায় রেখে ব্যাপক প্রচার চালাচ্ছে পাক সেনা। পণবন্দিদের ইতিমধ্যেই অন্যত্র সরিয়ে আনা হয়েছে। তাঁদের জীবন নিয়ে ভাবিত নয় ইসলামাবাদ। কিন্তু, আগামী দিনে এই পণবন্দিদের মৃত্যুর দায় শরিফ সরকারকে নিতে হবে।’’

জাফর এক্সপ্রেসে পাক সেনার ‘সফল’ অভিযানের প্রথম খটকা এই জায়গায়। কারণ, ১২ তারিখ ট্রেনটি ছিনতাইয়ের পর পরই প্রেস রিলিজ় প্রকাশ করে ‘বালোচ লিবারেশন আর্মি’। সেখানে ঘটনার দায় স্বীকারের পাশাপাশি মহিলা, বয়স্ক এবং শিশুদের ছেড়ে দেওয়ার কথা স্পষ্ট করে লিখেছিল বিএলএ। এ ছাড়া বালোচ নাগরিকদেরও মুক্তি দেন তাঁরা। ট্রেন থেকে বেরিয়ে দ্রুত নিরাপদ জায়গায় চলে আসেন ওই সমস্ত রেলযাত্রীরা।

এর পর ওই দিনই সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খোলেন মুক্তি পাওয়া রেলযাত্রীরা। তাঁদের বয়ান অনুযায়ী, রীতিমতো পরিচয়পত্র দেখে বেছে বেছে পণবন্দি নির্বাচন করেছেন বালোচ বিদ্রোহীরা। মূলত পঞ্জাববাসী পাক নাগরিক, সেনা, পুলিশ বা আধা সেনায় কর্মরতদের আটকে রেখেছে বিএলএ। বাকি প্রায় সবাইকেই ছেড়ে দেন তাঁরা। পণবন্দির সংখ্যা কম-বেশি ১০০ হতে পারে বলে মুক্তি পাওয়া রেলযাত্রীদের কথায় ইঙ্গিত মিলেছিল।

পাক সেনার এই ‘অপারেশন’-এর দ্বিতীয় খটকার জায়গা হল মৃতের সংখ্যা। রাওয়ালপিন্ডি জানিয়েছে, ৩৩ জন বালোচ বিদ্রোহীকে নিকেশ করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন মাত্র এক জন সৈনিক। এ ছাড়া অভিযান শুরু হওয়ার পর পালানোর রাস্তা বন্ধ বুঝতে পেরে পণবন্দিদের মধ্যে ২৭ জন সেনাকর্মীকে খুন করে বিএলএ। এরা কেউই জাফর এক্সপ্রেসে কর্তব্যরত অবস্থায় ছিলেন না। অর্থাৎ, সব মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা ৬১ বলে দাবি করেছে মুনিরের ফৌজ।

অন্য দিকে পাক সেনা হামলা চালাতেই পণবন্দিদের মধ্যে ৫০ জনকে খুন করা হয়েছে বলে জানায় বিএলএ। শুধু তা-ই নয়, দাবি পূরণের জন্য শাহবাজ় শরিফ সরকারের সামনে ২০ ঘণ্টার সময়সীমা বেঁধে দেন বালোচ বিদ্রোহীরা। ইসলামাবাদের কমান্ডো অপারেশনে তাঁদের ৩৩ জন যোদ্ধার মৃত্যু হলে অঙ্কের হিসাবে নিহতের সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ৮৩। ফলে রাওয়ালপিন্ডি মৃতদেহ লোপাট করছে বলে ইতিমধ্যেই অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে।

তৃতীয়ত, পাক সেনার বয়ান অনুযায়ী, অভিযানে কোনও নিরীহ নাগরিকের মৃত্যু হয়নি। কিন্তু, এই তথ্য পুরোপুরি উড়িয়ে দিয়েছেন বালোচিস্তানের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী আখতার মেঙ্গল। তাঁর দাবি, ইসলামাবাদের কমান্ডো অপারেশনে প্রাণ গিয়েছে আমজনতার। এ ছাড়া বালোচ বিদ্রোহীদের সঙ্গে গুলির লড়াইয়ে মৃত্যু হয়েছে অন্তত ১০০ পাক সৈনিককের।

মেঙ্গলের এই তথ্যের সঙ্গে বিএলএর বিবৃতির বেশ মিল রয়েছে। বালোচ বিদ্রোহীদেরও দাবি, শতাধিক পাক ফৌজিকে নিকেশ করেছেন তাঁরা। চাপ বাড়ছে বুঝতে পেরে ১৩ তারিখ বিকেলের দিকে বয়ান বদল করে ইসলামাবাদ। এ বার ২১ জন নিরীহ নাগরিক এবং চার জন সৈনিকের মৃত্যু হয়েছে বলে নতুন করে বিবৃতি দেন রাওয়ালপিন্ডির লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদমর্যাদার এক সেনা অফিসার।

অন্য দিকে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে মুখ খুলেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বালোচিস্তানের রেলের এক আধিকারিক। সংবাদ সংস্থা এএফপিকে তিনি বলেন, ‘‘মোট ২৫টি মৃতদেহ উদ্ধার করে নিকটবর্তী মাচো শহরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। নিহতদের মধ্যে ১৯ জন সেনাকর্মী, এক জন পুলিশ এবং এক জন রেল আধিকারিক রয়েছেন। তাঁদের কাউকেই এখনও চিহ্নিত করা যায়নি। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়বে। আর তাই যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়ে রাখার নির্দেশ দিয়েছে প্রশাসন।’’

প্রাণে বেঁচে যাওয়া রেলযাত্রীদের একাংশের দাবি, ৭০ থেকে ৮০টি মৃতদেহ নিজের চোখে দেখেছেন তাঁরা। তেমনই এক জন হলেন মুহাম্মদ নাভিদ। গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন তিনি। সংবাদমাধ্যমকে নাভিদ বলেন, ‘‘ট্রেন ছিনতাইয়ের পর পঞ্জাববাসীদের এক এক করে কামরার বাইরে নামতে বলেন বালোচ বিদ্রোহীরা। কারও ক্ষতি হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নীচে নামার সঙ্গে সঙ্গে নির্বিচারে গুলি করে তাঁদের খুন করেন বিএলএ যোদ্ধারা।’’

মৃতের সংখ্যা নিয়ে বিতর্কের এখানেই শেষ হয়। সংবাদ সংস্থা রয়টার্সে প্রকাশিত একটি ছবিকে কেন্দ্র করেও বেঁধে গিয়েছে হইচই। ওই ছবিটিতে কোয়েটা রেলস্টেশনে এক ব্যক্তিকে একের পর এক কফিন নামাতে দেখা গিয়েছে। বালোচিস্তানের রেল আধিকারিকদের উদ্ধৃত করে রয়টার্স জানিয়েছে, ১৫০ থেকে ২০০ কফিন দক্ষিণ-পশ্চিমের প্রদেশটিতে পাঠিয়েছে ইসলামাবাদ। মৃতের সংখ্যা মাত্র ৬১ হলে প্রায় তিন গুণ বেশি কফিন পাঠানো হল কেন? উঠছে প্রশ্ন।

এই আবহে নজর ঘোরাতে হঠাৎ করেই গোটা ঘটনার দায় আফগানিস্তানের তালিবান সরকারের উপর চাপিয়েছে মুনিরের ফৌজ। পাক সেনাকর্তাদের অভিযোগ, হিন্দুকুশের কোলে বসে জাফর এক্সপ্রেস ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করা হয়। ট্রেন অপহরণের পর আফগানভূমি থেকে স্যাটেলাইট ফোনে ক্রমাগত নির্দেশ পাচ্ছিলেন বালোচ বিদ্রোহীরা। ফলে ‘কাউন্টার অপারেশন’ চালাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে।

পাক সেনার এ হেন বিবৃতিতে ফুঁসে ওঠে আফগানিস্তানের তালিবান সরকার। ১৩ মার্চ এ ব্যাপারে পাল্টা বিবৃতি দেন কাবুল বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র আব্দুল কাহার বলখি। তাঁর কথায়, ‘‘মুনিরের ফৌজের এই ধরনের অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। বালোচিস্তানের ঘটনার সঙ্গে আফগানিস্তানের কোনও যোগ নেই। ইসলামাবাদকে বলতে চাই, এ ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য না করে বরং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, দেশের সমস্যায় নজর দিক।’’

এতেও কাজ হচ্ছে না দেখে শেষে ভারতের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদকে মদত দেওয়ার অভিযোগ তুলেছে শাহবাজ় সরকার। ফলে পাকিস্তানকে সরাসরি ‘সন্ত্রাসের আঁতুড়ঘর’ বলে তোপ দেগেছে নয়াদিল্লি। এ প্রসঙ্গে বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র রণধীর জওসওয়াল খোঁচা দিয়ে বলেছেন, ‘‘গোটা বিশ্ব জানে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সন্ত্রাসবাদের আঁতুড়ঘর কোথায় রয়েছে।’’

গোদের উপর বিষফোড়ার মতো ১৩ তারিখ থেকে সমাজমাধ্যমে বেশ কিছু ছবি ভাইরাল হতে শুরু করে। সেখানে পাকিস্তানের পতাকা দিয়ে মোড়া কয়েকটি কফিনকে নিয়ে সৈনিকদের কুচকাওয়াজের ভঙ্গিতে এগিয়ে যেতে দেখা গিয়েছে। কেউ কেউ পাক সৈনিকদের ছবি পোস্ট করে তাঁদের মৃত্যুর খবর প্রকাশ্যে এনেছেন। এই ভাইরাল পোস্টগুলির সত্যতা নিয়ে মুখ কুলুপ এঁটে রয়েছে ইসলামাবাদ।

পাক সেনার অবশ্য মিথ্যা কথা বলার লম্বা ইতিহাস রয়েছে। এমনকি নিজেদের সৈনিকদের ব্যাপারেও বার বার উদাসীনতা দেখিয়েছে রাওয়ালপিন্ডির সেনা সদর দফতর। ১৯৯৯ সালের কার্গিল যুদ্ধের পর নিহত পাক সৈনিকদের মৃতদেহ নিতে অস্বীকার করে ইসলামাবাদ। শেষে তাঁদের সমাধিস্থ করেছিল ভারতীয় সেনা। ফলে জাফর এক্সপ্রেসের ঘটনায় মুনিরের ফৌজের মৃতদেহ লোপাটের আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন না প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।
সব ছবি: সংগৃহীত।