
মুদ্রাস্ফীতিতে জেরবার পাকিস্তান। ঋণের বোঝা গলায় ক্রমশ ফাঁসের মতো চেপে বসেছে। কমেই চলেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রার ভান্ডার। সরকারি ভান্ডার প্রায় অর্থশূন্য। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। ভেঙে পড়া অর্থনীতিতে ‘অক্সিজেন’ জোগাতে এ বার বড় সিদ্ধান্ত নিল ইসলামাবাদ।

নিদারুণ আর্থিক সঙ্কটে থাকা পাকিস্তানের ত্রাতা হয়ে দাঁড়াতে পারে ক্রিপ্টো মুদ্রা। এমনটাই মনে করছে শাহবাজ় শরিফের সরকার। দীর্ঘ দিনের অর্থনৈতিক সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে পাকিস্তান সরকার ক্রিপ্টোমু্দ্রার বেচাকেনাকে বৈধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

পাকিস্তানে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নজর টানার এবং সে দেশের ধুঁকতে থাকা অর্থনীতির আধুনিকীকরণের জন্য ক্রিপ্টোমুদ্রার লেনদেন ও ব্যবসাকে বৈধ করার পরিকল্পনা করছে ইসলামাবাদ। কয়েক বছর ধরেই দেশটি নজিরবিহীন আর্থিক সঙ্কট মোকাবিলা করে চলেছে। লক্ষণীয় ভাবে কমেছে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপি। ধীরে ধীরে কমেছে বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়ও।

অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে সে দেশের নাগরিকদের মধ্যে। যে কোনও দিন নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করতে পারে সে দেশের সরকার, এমনটাই মত আর্থিক বিশেষজ্ঞদের একাংশের। গত এক দশকে পাকিস্তানে বেকারত্বের হার ১.৫ শতাংশ থেকে বেড়ে সাত শতাংশে গিয়ে পৌঁছেছে। দেশটির মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপি বৃদ্ধির হার স্বাস্থ্য বা শিক্ষাখাতের প্রয়োজনীয়তা পূরণের পক্ষে পর্যাপ্ত নয়।

এই পরিস্থিতি থেকে পাকিস্তানের উত্তরণে সে দেশের অর্থমন্ত্রীর প্রধান উপদেষ্টা এবং নবগঠিত পাকিস্তান ক্রিপ্টো কাউন্সিল (পিসিসি)-এর সিইও বিলাল বিন সাকিব ব্লুমবার্গ টিভির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, ব্লকচেন প্রযুক্তি ও ডিজিটাল সম্পদের গ্রহণযোগ্যতাকে মেনে নিয়ে সেই পথেই হাঁটতে চায় পাকিস্তানের সরকার।

এই ঘোষণার পরই এই ধরনের সিদ্ধান্তের পিছনে পাকিস্তানের আসল উদ্দেশ্য কী, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে বিভিন্ন মহলে। বিলাল অবশ্য ব্লুমবার্গকে বলেছেন, ‘‘আমাদের মূল লক্ষ্য হল আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করা এবং ব্লকচেন প্রযুক্তিকে পাক অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করা। সরকারের লক্ষ্য একটি নিয়ন্ত্রক কাঠামো তৈরি করা যা ব্লকচেন প্রযুক্তিকে আর্থিক ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত করবে।’’

পাকিস্তান ক্রিপ্টো কাউন্সিল (পিসিসি)-এর সিইও বিলাল মনে করেন, পাকিস্তানের ৬০ শতাংশ জনসংখ্যা যে হেতু ৩০ বছরের নীচে, তাই সে দেশে ডিজিটাল মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয় করার বাজার তৈরিই আছে। তাঁর দাবি, আনুমানিক দেড় থেকে দুই কোটি পাকিস্তানি ইতিমধ্যেই ডিজিটাল সম্পদের ব্যবসা শুরু করছেন।

জালিয়াতি, অর্থ পাচার এবং আর্থিক অস্থিরতার আশঙ্কায় ক্রিপ্টোকারেন্সির বিরুদ্ধে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের সতর্কতা সত্ত্বেও, ডিজিটাল সম্পদের চাহিদা এত বেশি হয়ে গিয়েছে যে, তা উপেক্ষা করা যাচ্ছে না।

পাকিস্তান ক্রিপ্টোকারেন্সি ট্রেডিংকে বৈধ করার আরও একটি প্রধান কারণ হল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষণা। দ্বিতীয় বার আমেরিকার মসনদ অধিকার করার পর ট্রাম্প বিটকয়েন-সহ অন্যান্য ডিজিটাল মুদ্রায় লেনদেনে বিশেষ জোর দিতে শুরু করেছেন। ট্রাম্পের আশ্বাসবাণী পেয়ে তেজি ঘোড়ার মতো দৌড়োচ্ছে ক্রিপ্টোমুদ্রার বাজার।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পাঁচটি ডিজিটাল সম্পদের নাম ঘোষণা করেছেন। সেই মুদ্রাগুলি দিয়ে তিনি আমেরিকায় একটি নতুন কৌশলগত সঞ্চয় গড়ে তোলার পরিকল্পনা চালাচ্ছেন বলে হোয়াইট হাউস সূত্রে খবর।

আমেরিকাকে ক্রিপ্টোর রাজধানী হিসাবে গড়ে তুলতে চান ওয়াশিংটনের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। ব্যাঙ্ক অফ আমেরিকা যেমন সোনা সঞ্চয় করে রাখে, ঠিক তেমনই ট্রাম্প চান আলাদা করে ক্রিপ্টোর ভান্ডার গ়ড়ে উঠুক। সেই উদ্দেশ্যে একটি বিবৃতিও জারি করেছে হোয়াইট হাউস। ফলে চড়চড় করে দাম বাড়ছে ক্রিপ্টো মুদ্রার। ট্রাম্পের ওই ঘোষণার পর রেকর্ড উচ্চতায় ওঠে বিটকয়েনের দর। গত ১৬ ডিসেম্বর এই ক্রিপ্টো মুদ্রার এক একটির দাম ছিল ১ লক্ষ ৭ হাজার ডলার।

আমেরিকার মতো দেশের ক্রিপ্টো-বান্ধব নীতির দিকে ঝুঁকে পড়া পাকিস্তানকে ক্রিপ্টোকারেন্সি বাণিজ্যকে বৈধ করার দিকে এগিয়ে যেতে বাধ্য করেছে বলে মনে করছেন অনেকেই। ক্রিপ্টো নিয়ে লেনদেনের নিরিখে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে পাকিস্তান নবম স্থানে রয়েছে বলে জানিয়েছে ‘চ্যানেলেসিস’ নামের একটি সমীক্ষক সংস্থা।

এই সংস্থার সমীক্ষা জানাচ্ছে, এই তালিকায় রাশিয়া, চিনকে টপকে প্রথম স্থান দখল করেছে ভারত। বর্তমানে ভারতে ১৫ থেকে ২০ কোটি মানুষ শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করার মতো ক্রিপ্টোমুদ্রায় বিনিয়োগ করা শুরু করে দিয়েছেন। যদিও ভারত সরকার এই লেনদেনকে এখন আইনি বৈধতা দেয়নি পুরোপুরি। লেনদেন বেআইনি না-হলেও যাঁরা এর সঙ্গে যুক্ত তাঁদের মুদ্রা বেচার লভ্যাংশের উপর ৩০ শতাংশ কর দিতে হয় সরকারকে।

কেন ক্রিপ্টোকারেন্সির প্রতি এতটা ভরসা রাখতে চাইছে ইসলামাবাদ? সে সম্পর্কে বলতে গিয়ে বিলাল জানিয়েছেন, আইএমএফ তথা আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারের কাছে পাকিস্তান আর্জি জানিয়েছে ক্রিপ্টোকারেন্সি চালু করার জন্য। এর ফলে ঋণ পরিশোধের দিকটি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। পাশাপাশি এর ফলে বিদেশি বিনিয়োগ যেমন বেশি আসবে, তেমনই কর পরিশোধও করা যাবে এর সাহায্যে।

আন্তর্জাতিক মু্দ্রা তহবিল থেকে ২০২৪ পর্যন্ত পাকিস্তান ২০ বার ঋণ নিয়েছে। সাম্প্রতিকতম ঋণের পরিমাণ ৭০০ কোটি ডলার। পঞ্চম বৃহত্তম ঋণগ্রহীতা আশ্বাস দিয়েছিল যে, এটিই তাদের শেষ ঋণ হবে। আইএমএফ ফেডারেল বোর্ড অফ রেভিনিউয়ের কাছে পাকিস্তান জানিয়েছে, ক্রিপ্টো থেকে যে রাজস্ব আসবে, তা দেশের কর কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত করা হবে যাতে এই ঋণ পরিশোধ করা যায়।

ডিজিটাল সম্পদ চালু করা নিয়ে একদা বিরোধিতা করা পাকিস্তানের তড়িঘড়ি ক্রিপ্টো মুদ্রা চালু করা নিয়ে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন ভারতের নিরাপত্তা সংস্থাগুলি। পাকিস্তান নিজেদের আর্থিক সঙ্কটের দোহাই দিয়ে ক্রিপ্টো লেনদেন চালু করার কথা আন্তর্জাতিক দরবারে ঘোষণা করেছে। সেই সূত্র ধরে সন্ত্রাসবাদকে আর্থিক ইন্ধন জোগানোর নতুন পথ তৈরি করতে চাইছে পাকিস্তান, এমন আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না অনেকেই।

ভারতে সন্ত্রাসবাদের শিকড়কে ছড়িয়ে দিতে টাকার বদলে ডিজিটাল মুদ্রাকে হাতিয়ার করতে পারে জেহাদি ও জঙ্গি সংগঠনগুলি। জাল নোটের বদলে ক্রিপ্টোকেই লেনদেনের সহজ মাধ্যম হিসাবে বেছে নিতে পারে আতঙ্কবাদী সংগঠনগুলি। ভারতের মাটিতে বসে একটি মাত্র ক্লিকে কোটি কোটি ডলারের লেনদেন চলবে।

সারা বিশ্ব জুড়ে বেআইনি অস্ত্র বা মাদক পাচারের কাজ চলছে। সেই কেনাবেচায় বেশ বড় ভূমিকা নিয়েছে এই ডিজিটাল মুদ্রাগুলি। এর প্রধান কারণ, ক্রিপ্টো মুদ্রা লেনদেনে নজরদারি বা নিয়ন্ত্রণ করা বেশ মুশকিল। ২০২২ সালে বেশ কয়েকটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, পাক মদতপুষ্ট জঙ্গি সংগঠনগুলি ভারতে সন্ত্রাস ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ক্রিপ্টো ব্যবহার করে অর্থ ও অস্ত্র জোগান দিয়েছে।

পাকিস্তানের অভ্যন্তরেও ক্রিপ্টো বৈধ করার সিদ্ধান্তের বিরোধিতাও রয়েছে। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক-সহ বিভিন্ন আর্থিক সংস্থা এখনও ক্রিপ্টোর নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিয়ে শঙ্কিত। তারা মনে করছে, সঠিক নিয়ন্ত্রণের অভাবে নানা অবৈধ কার্যকলাপে ব্যবহৃত হতে পারে।
সব ছবি: সংগৃহীত।