
নাম, পরিচয় জিজ্ঞাসা করে পর্যটকদের বুকে-মাথায় গুলি! পহেলগাঁওয়ে নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালানো জঙ্গিদের খোঁজে উপত্যকা তোলপাড় করে চিরুনিতল্লাশি চালাচ্ছে সেনা ও পুলিশ। ভূস্বর্গের এই সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে পরতে পরতে মিল রয়েছে পাকিস্তানের বালোচ বিদ্রোহীদের হামলার। তাঁদের কায়দাতেই ইসলামাবাদ মদতপুষ্ট জঙ্গিগোষ্ঠী লশকর-ই-ত্যায়বার ছায়া সংগঠন ‘দ্য রেজ়িস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ) ‘টার্গেট কিলিং’ চালিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

চলতি বছরের ১১ মার্চে বালোচিস্তানের রাজধানী কোয়েটা থেকে ১৬০ কিলোমিটার দূরে কাচ্চি বোলানের মাশকাফ সুড়ঙ্গে যাত্রীবোঝাই জ়াফর এক্সপ্রেসকে অপহরণ করে স্থানীয় বিদ্রোহী গোষ্ঠী বালোচ লিবারেশন আর্মি বা বিএলএ। ট্রেনে ছিলেন পাক সেনার বেশ কয়েক জন কর্মী। প্রাথমিক ভাবে ট্রেনের সমস্ত যাত্রীকে পণবন্দি করলেও প্রথমেই মহিলা, শিশু এবং বৃদ্ধদের ছেড়ে দেন বিএলএ যোদ্ধারা।

ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ অনুযায়ী, যাত্রীরা কোন অঞ্চলের বাসিন্দা, তা জানতে চেয়েছিলেন বালোচ বিদ্রোহীরা। পরিচয় জানার পর তাঁদের আলাদা আলাদা দলে ভাগ করে তাঁরা। ট্রেনে যে পাক সৈনিকেরা ছিলেন, তাঁরা ছুটিতে বাড়ি ফিরছিলেন। অভিযোগ, তাঁদের খুঁজে খুঁজে হত্যা করে বিএলএ।

সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অপহৃত জ়াফর এক্সপ্রেস থেকে বেঁচে ফেরা যাত্রী আরসালান ইউসুফ বলেন, ‘‘বালোচ বিদ্রোহীরা মাঝেমধ্যেই সৈনিকদের ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। সকলের সামনেই নৃশংস ভাবে তাঁদের খুন করা হয়।’’ আরসালানের দাবি, শুধু সেনা নয়, বেশ কয়েক জন যাত্রীকেও নিশানা করেছিল বিএলএ। এ ব্যাপারে আপত্তি করলে বুলেটে বুক ফুঁড়ে দেয় তারা।

অপহৃত জ়াফর এক্সপ্রেস থেকে পণবন্দিদের উদ্ধার করতে ৩০ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে কমান্ডো অপারেশন চালায় পাক সেনা। বালোচ বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অভিযানে নামে স্পেশ্যাল সার্ভিস গ্রুপ, ফ্রন্টিয়ার কোর, বায়ুসেনা ও আধাসেনা। ১২ মার্চ রাতে বিবৃতি দেয় ইসলামাবাদ। সেখানে বলা হয়, ৩৩ জন বালোচ বিদ্রোহীকে জাহান্নামে পাঠানো হয়েছে। উদ্ধার হওয়া পণবন্দির সংখ্যা ৩০০।

জ়াফর এক্সপ্রেসের এই ‘অপারেশন’ নিয়ে অবশ্য একাধিক ধোঁয়াশা রয়েছে। ১৩ মার্চ এই ইস্যুতে বিবৃতি দেন বিএলএ মুখপাত্র জ়িয়ান্দ বালোচ। তাঁর কথায়, ‘‘ট্রেন ছিনতাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীদের একাংশকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তাঁদেরই নাম উদ্ধারের তালিকায় রেখে ব্যাপক প্রচার চালাচ্ছে পাক সেনা।’’ ওই সময়ে পণবন্দিরা তাঁদের কব্জাতেই ছিলেন বলে দাবি করেন বিদ্রোহীরা।

বিএলএর ওই বিবৃতির সঙ্গে মুক্তি পাওয়া রেলযাত্রীদের বয়ানের মিল পাওয়া গিয়েছিল। সংবাদমাধ্যমকে তাঁরা বলেন, ‘‘পরিচয়পত্র দেখে বেছে বেছে পণবন্দি নির্বাচন করেছেন বালোচ বিদ্রোহীরা। মূলত পঞ্জাববাসী পাক নাগরিক, সেনা, পুলিশ বা আধাসেনায় কর্মরতদের আটকে রেখেছে বিএলএ।’’ পণবন্দির সংখ্যা কম-বেশি ১০০ হতে পারে বলে ইঙ্গিত দেন তাঁরা।

পাক সেনার এই ‘অপারেশন’-এর দ্বিতীয় খটকার জায়গা হল মৃতের সংখ্যা। রাওয়ালপিন্ডির দাবি, ৩৩ জন বালোচ বিদ্রোহীকে নিকেশ করতে গিয়ে প্রাণ গিয়েছে মাত্র এক জন সৈনিকের। এ ছাড়া অভিযান শুরু হওয়ার পর পালানোর রাস্তা বন্ধ বুঝতে পেরে পণবন্দিদের মধ্যে ২৭ জনকে খুন করে বিএলএ। অর্থাৎ, সব মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা ৬১ বলে জানায় ইসলামাবাদ।

অন্য দিকে পাক সেনা হামলা চালাতেই পণবন্দিদের মধ্যে আরও ৫০ জনকে হত্যার দায় স্বীকার করে বিএলএ। ইসলামাবাদের কমান্ডো অপারেশনে তাঁদের ৩৩ জন যোদ্ধার মৃত্যু হলে অঙ্কের হিসাবে নিহতের সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ৮৩। ফলে রাওয়ালপিন্ডি মৃতদেহ লোপাট করেছে বলে অভিযোগ উঠেছিল।

তৃতীয়ত, পাক সেনার বয়ান অনুযায়ী, অভিযানে কোনও নিরীহ নাগরিকের মৃত্যু হয়নি। কিন্তু, এই তথ্য পুরোপুরি উড়িয়ে দেন বালোচিস্তানের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী আখতার মেঙ্গল। তাঁর দাবি, ইসলামাবাদের কমান্ডো অপারেশনে প্রাণ গিয়েছে আমজনতার। এ ছাড়া বালোচ বিদ্রোহীদের সঙ্গে গুলির লড়াইয়ে মৃত্যু হয়েছে অন্তত ১০০ পাক সৈনিকের।

গত ২৬ মার্চ বালোচিস্তানের বন্দর শহর গ্বদর থেকে করাচিগামী একটি বাসকে কালমত এলাকায় থামিয়ে পাঁচ যাত্রীকে খুন করে বিএলএ। জ়াফর এক্সপ্রেসের ক্ষত তখনও ঠিকমতো কাটিয়ে উঠতে পারেনি ইসলামাবাদ। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, জাতীয় সড়কে বাস থামানোর পর পরিচয়পত্র দেখে বেছে বেছে পাক পঞ্জাব প্রদেশের বাসিন্দাদের গুলি করে বালোচ বিদ্রোহীরা। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তাঁদের।

উল্লেখ্য, এর আগেও একাধিক বার বাস আটকে পরিচয়পত্র খতিয়ে দেখে বেছে বেছে পঞ্জাবি যাত্রীদের খুন করার অভিযোগ উঠেছে বিএলএর বিরুদ্ধে। পহেলগাঁও হত্যাকাণ্ডে টিআরএফকে সেই মডেল অনুসরণ করতে দেখা গিয়েছে। অমিল শুধু একটা জায়গাতেই। স্বাধীনতার দাবিতে পাক সেনার বিরুদ্ধে লড়ছে বালোচ বিদ্রোহী গোষ্ঠী। অন্য দিকে টিআরএফের জন্মদাতা রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তারা।

বিশ্লেষকদের একাংশের আবার দাবি, লশকর-ই-ত্যায়বার ছায়া সংগঠনটি বিএলএর থেকে এই কায়দা শিখেছে, তা বলা ঠিক হবে না। কারণ, ৮০ বা ৯০-র দশকে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের এ ভাবেই বেছে বেছে খুন করত জঙ্গিরা। ওই সময়ে ঠিক একই কায়দায় ধর্মকে ঢাল করেছিল তাঁরা।

পহেলগাঁও হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়ে সৌদি আরব সফর কাঁটছাঁট করে দ্রুত দেশে ফেরেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এর পর দফায় দফায় বৈঠক করেন তিনি। এর পরই ১৯৬০ সালের সিন্ধু জলচুক্তি স্থগিতের নির্দেশ দেয় নয়াদিল্লি। বন্ধ করা হয় আটারি সীমান্ত। এ ছাড়া পাক নাগরিকদের ভিসা দেওয়া বন্ধ করেছে কেন্দ্র। আগে দেওয়া ভিসাও বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মোদী সরকার।

পাশাপাশি, দিল্লিতে অবস্থিত পাকিস্তানের সামরিক উপদেষ্টাদের ‘অবাঞ্ছিত ব্যক্তি’ হিসাবে ঘোষণা করেছে নয়াদিল্লি। এক সপ্তাহের মধ্যে ভারত ছাড়তে হবে তাঁদের। ইসলামাবাদ থেকেও ভারতীয় উপদেষ্টাদের প্রত্যাহার করছে কেন্দ্র। ইসলামাবাদে ভারতীয় দূতাবাসে কর্মীসংখ্যা ৫৫ থেকে ৩০-এ নামিয়ে আনছে মোদী সরকার।

পরিস্থিতি যে দিকে গড়াচ্ছে, তাতে ইসলামাবাদের সঙ্গে যে কোনও মুহূর্তে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারে ভারত। এ ছাড়া বড় রকমের প্রত্যাঘাতের দায়িত্ব পুরোপুরি সেনাবাহিনীর কাঁধে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। এ ব্যাপারে বিবৃতি দিয়েছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহও।

পহেলগাঁওয়ে হত্যাকাণ্ডে জড়িত চার জঙ্গিকে শনাক্ত করেছে ভারতের নিরাপত্তা সংস্থাগুলি। ইতিমধ্যে চার জনের ছবিও প্রকাশ করে পরিচয় জানানো হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রে খবর, চার জঙ্গি হল— আদিল, আসিফ ফুজি, সুলেমান শাহ এবং আবু তালহা। গোয়েন্দা সূত্রে দাবি, হামলাকারীরা সংখ্যায় ছিল পাঁচ-ছ’জন। সকলের মুখে ছিল মাস্ক। হাতে একে ৪৭-এর মতো রাইফেল।

গত ২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ের বৈসরন উপত্যকায় পর্যটকদের উপর হামলা চালায় টিআরএফ। এতে বাংলার তিন পর্যটক-সহ প্রাণ গিয়েছে মোট ২৬ জনের। পহেলগাঁওয়ের হত্যালীলায় জড়িত জঙ্গিদের খোঁজ পেতে পুরস্কার ঘোষণা করেছে জম্মু-কাশ্মীর পুলিশ। অনন্তনাগ পুলিশ বিভাগ জানিয়েছে, জঙ্গিনিধন অভিযানে সাহায্য হওয়ার মতো কোনও তথ্য দিয়ে কেউ সহায়তা করলে তাঁকে ২০ লক্ষ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে।
সব ছবি: সংগৃহীত।