
আশপাশে যত দূর চোখ যায় সব কিছুই সাদা। তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নীচে। সেই রকম হিমশীতল আবহাওয়ায় বরফের মধ্যে ৬ ঘণ্টা পড়ে রইলেন জিন হিলিয়ার্ড। বরফের মাঝে পড়ে থাকতে থাকতে প্রায় বরফেই পরিণত হলেন তিনি। যখন ধরেই নেওয়া হয়েছিল যে জিনের বাঁচার কোনও সম্ভাবনা নেই, তখনই সবাইকে চমকে বেঁচে ফেরেন বছর উনিশের তরুণী।

অবাক করে দেওয়া এই ঘটনাটি ঘটে ১৯৮০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা রাজ্যে। জিন তখন সবে যৌবনের দোরগোড়ায় পা দিয়েছেন। কিন্তু মাত্র ১৯ বছর বয়সেই তরুণী মৃত্যুর মুখ প্রায় দেখে ফেলেন।

বিশ্ব জুড়ে তখন নতুন বছরকে স্বাগতম জানানোর আমেজ। সেই আমেজে মেতেছিলেন ১৯ বছর বয়সি জিনও। ১৯৮০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ভোরবেলা জিন বন্ধুর বাড়ি থেকে পার্টি করে ফিরছিলেন। সেই সময় রাস্তায় জমে থাকা বরফের পুরু আস্তরণ পেরিয়ে আসতে গিয়ে জিন গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন।

বরফজমা রাস্তায় পিছলে গিয়ে গাড়িটি পড়ে যায়। সেই ঘটনায় জিন বিশেষ আঘাতপ্রাপ্ত না হলেও গাড়িটিকে তিনি আর চালু করতে পারেননি। ফলে গাড়ি ছাড়াই সেখান থেকে চলে আসতে হয় তাঁকে।

জিন গাড়ি নিয়ে যেখানে পড়ে যান, সেখান থেকে তাঁর বাড়ির দূরত্ব ছিল বেশ খানিকটা। তরুণী তাই এক বন্ধুর বাড়ি চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মিনেসোটায় ডিসেম্বরের শেষ দিনের ভোরবেলার তাপমাত্রা তখন হিমাঙ্কের ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস নীচে। সেই হিমশীতল আবহাওয়ায় জিন একা একা হেঁটে তাঁর বন্ধুর বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন।

জিনের পরনে বিশেষ কোনও শীতের পোশাকও ছিল না। হাতে ছিল একজোড়া আঙুল ছাড়া দস্তানা, গায়ে চাপানো ছিল একটা কোট এবং পায়ে সাধারণ বুট। বরফের রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে যেতে তরুণী পিছলে পড়ে যান। তখনই ঘটে অঘটন। রাস্তার পাশে জমে থাকা বরফের চাঁইয়ে মাথায় আঘাত পেয়ে তিনি অজ্ঞান হয়ে যান।

হাড়কাপানো ঠান্ডার মধ্যে জ্ঞান হারানো অবস্থাতেই জিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে থাকেন। এ ভাবে ছ’ঘণ্টা কেটে যায়। বহু ক্ষণ পরেও জিন না ফেরায় তাঁর বন্ধু ওয়ালি নেলসন তাঁকে খুঁজতে বার হন। নিজের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে রাস্তার উপরে বরফের মধ্যে জিনকে পড়ে থাকতে দেখেন তিনি।

জিনকে দেখে ঘাবড়ে যান ওয়ালি। তিনি তৎক্ষণাৎ জিনকে তাঁর বাড়ির বারান্দার তুলে নিয়ে আসেন। সেই ঘটনার বহু বছর পর ‘মিনেসোটা পাবলিক রেডিয়ো’য় দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে ওয়ালি জানিয়েছিলেন, তিনি যখন জিনকে তাঁর বাড়ির সদর দরজা থেকে কিছুটা দূরে রাস্তার উপর পড়ে থাকতে দেখেন, তখন জিনের শরীর অসাড় ছিল। জিন যেন বরফের চাঁইয়ে পরিণত হয়েছিলেন। তাঁর শরীর ইটের মতো শক্ত হয়ে গিয়েছিল।

ওয়ালি মুহূর্তের জন্য ভেবেছিলেন যে, বন্ধুকে তিনি চিরতরে হারিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু তাঁর আশার দ্বীপ জ্বলে ওঠে যখন তিনি কাঠের মতো শক্ত জিনের নাক থেকে বুদবুদ বেরাতে দেখতে পান। ওয়ালি তৎক্ষণাৎ জিনকে তাঁর বাড়ির কাছে একটি হাসপাতালে নিয়ে যান।

হাসপাতালের চিকিৎসকেরাও জিনকে দেখে ভেবেছিলেন তিনি আর বেঁচে নেই। ‘সায়েন্স অ্যালার্ট’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, জিনের হৃদ্স্পন্দন অস্বাভাবিক মাত্রায় কমে গিয়েছিল। প্রতি মিনিটে জিনের হৃদ্পিণ্ড মাত্র ১২ বার স্পন্দিত হচ্ছিল।

জিনের শরীরের তাপমাত্রা মাত্র ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে এসেছিল, যা এক জন সুস্থ মানুষের শরীরের তাপমাত্রার চেয়ে ১০ ডিগ্রি কম।

জিনের শরীর এতটাই জমে গিয়েছিল যে হাসপাতালের কর্মীরা তাঁর গায়ে সূচ ঢোকাতেও হিমশিম খান। বহু চেষ্টা করেও তাঁরা জিনের শিরার হদিস পাচ্ছিলেন না। অনেকগুলি সূচ ভেঙেও যায়।

এর পর তাঁরা জিনের সারা শরীরে গরম সেঁক দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। সেঁক দেওয়া শুরু করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই জিনের শরীরে সাড় ফিরে আসতে শুরু করে। তরুণীকে হাত-পা নাড়াতে দেখা যায়।

শুধু হাত-পা নাড়ানোই নয়, দুপুরের মধ্যে জিন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেন এবং কথা বলতেও শুরু করেন। সেই ঘটনার প্রায় সাত সপ্তাহ পর জিনকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। অতিরিক্ত ঠান্ডার কারণে জিনের পায়ের কয়েকটি আঙুল কিছু দিনের জন্য অসাড় হয়েছিল এবং কয়েকটি জায়গায় ফোস্কাও পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু তা-ও পরে সেরে যায় এবং তিনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে আসেন।

ফসটন হাসপাতালের চিকিৎসক জর্জ স্যাথার হিমায়িত অবস্থা থেকে জিনের জীবিত ফিরে আসার এই ঘটনাকে ‘অলৌকিক’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেনন। জিন কী ভাবে বেঁচে ফিরলেন, তা বোঝার জন্য পরবর্তীকালে বহু গবেষণা হলেও তেমন কিছু জানা যায়নি।
সব ছবি: সংগৃহীত।