এসে গেল বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজো। সাধারণ ভাবে ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত দুর্গাপুজো। কিন্তু কলকাতা শহরে মহালয়া থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে পুজো উদ্যাপন। নতুন জামাকাপড় পড়ে সাজুগুজু করে প্যান্ডেল ‘জয় করতে’ বেরিয়ে পড়েছে বাঙালি। উত্তর থেকে দক্ষিণ, ভিড় ঠেলে শহরের নামীদামি পুজোগুলোর প্যান্ডেলে উপচে পড়া ভিড়। চলছে নিজস্বী তোলার ধুম।
প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘোরার আনন্দ যেমন আছে, তেমনই রয়েছে যানজট এবং ভিড়ের বিরক্তি। ঠেলাঠেলির ভয়ে অনেক সময়ই কলকাতার অনেক নামীদামি পুজো দেখা হয়ে ওঠে না শহরবাসীর। শহরের বাইরে থেকেও যাঁরা এক দিন বা দু’দিনের জন্য কলকাতার পুজো দেখতে আসেন, তাঁরাও অনেক প্যান্ডেলে যেতে পারেন না সময়ের অভাবে। তবে মুশকিল আসান করেছে কলকাতা মেট্রো। এমনিতেই, উত্তর থেকে দক্ষিণে সহজেই পৌঁছে যাওয়ার জন্য বছরভর পরিষেবা দেয় কলকাতা মেট্রো। তবে পুজোর সময় যাত্রী সুবিধার কথা মাথায় রেখে ইতিমধ্যেই পুজোর ক’দিন মেট্রোর সংখ্যা বৃদ্ধির কথা জানিয়েছে মেট্রো (ব্লু লাইন)। পুজোপ্রেমী বাঙালির মুশকিল আসান করছে আনন্দবাজার অনলাইনও। কোন মেট্রো স্টেশনে নেমে কোন নামীদামি পুজো সহজেই দেখে আসতে পারবেন, তা থাকছে আনন্দবাজার অনলাইনের পাতায়। এক নজরে দেখে নিন সেই তালিকা।
কারও বাড়ি যদি উত্তরে হয়, তা হলে যাত্রা শুরু করা যেতে পারে দক্ষিণেশ্বর, বরাহনগর, নোয়াপাড়া বা দমদম থেকে। দক্ষিণেশ্বর, বরাহনগর, নোয়াপাড়ায় নেমে সে রকম কোনও নামী পুজো দেখতে না পেলেও দমদমে পৌঁছে দেখে নিতে পারেন সিঁথি সর্বজনীন এবং ১৪-র পল্লির পুজো।
দমদম থেকে আবার যাত্রা শুরু করলে মেট্রোতে পাঁচ-সাত মিনিটে পৌঁছে যাওয়া যায় বেলগাছিয়া। স্টেশনে নেমে ঘুরে ঘুরে দেখে আসুন বেলগাছিয়া সাধারণ দুর্গোৎসব (টালা পার্ক), নেতাজি স্পোর্টিং, লেকটাউন অ্যাসোসিয়েশন, যুবকবৃন্দ, ভারত চক্র (দমদম পার্ক), শ্রীভূমি, প্রদীপ সঙ্ঘ (নতুনপল্লি)।
কিছু একটু মুখে দিয়ে আবার মেট্রোয় উঠে পড়ুন বেলগাছিয়া থেকে। পাঁচ মিনিটের দূরত্বে শ্যামবাজার। শ্যামবাজার মেট্রো থেকে নেমে বাগবাজার সর্বজনীন, শ্যাম স্কোয়ার, ফ্রেন্ডস্ ইউনিয়ন, জগৎ মুখার্জি পার্কের ঠাকুর দেখে আবার যাত্রা শুরু করুন। পরের স্টেশন শোভাবাজার।
শোভাবাজারে এসেছেন আর রাজবাড়ির পুজো দেখবেন না, তা হয় নাকি! ছোট এবং বড় রাজবাড়ির পুজো দেখে আসুন হইহই করে। ঠাকুরদালানে দাঁড়িয়ে টুক করে নিজস্বীও তুলে নিন। তবে বেশি সময় নষ্ট করলে চলবে না। শোভাবাজারের আশপাশে আরও বেশ কয়েকটি নামী পুজো রয়েছে। সেগুলিও দেখতে হবে তো!
শোভাবাজারের পুজো পরিক্রমা পর্ব সেরে চলে যেতে হবে গিরীশ পার্ক। শোভাবাজার থেকে মেট্রোয় লাগবে মিনিট দু’য়েক। সেখান থেকে চলে যেতে পারেন বিডন স্কোয়ার, শিমলা ব্যায়াম সমিতি, ৩৭ পল্লি, বিবেকানন্দ স্পোর্টিং, রবীন্দ্র কানন, পাথুরিয়াঘাটা ৫-এর পল্লি। চটপট ঘুরে নিয়ে আবার ফিরে আসুন মেট্রো স্টেশনে।
পরবর্তী স্টেশন মহাত্মা গান্ধী রোড। দরজা খুলবে ডান দিকে। মহাত্মা গান্ধী রোডে নেমে বাঙালিদের সব থেকে বেশি আগ্রহ থাকে মহম্মদ আলি পার্কের পুজো নিয়ে। সঙ্গে নামী পুজোর মধ্যে রয়েছে কলেজ স্কোয়ার, শিয়ালদহ রেলওয়ে অ্যাথলেটিক ক্লাবের পুজোও।
মহাত্মা গান্ধী রোড স্টেশন থেকে আবার যাত্রা শুরু করে পৌঁছে যান সেন্ট্রাল। চট করে ঘুরে আসুন সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার, সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার, কাপালিটোলার পুজো।
সেন্ট্রাল থেকে চাঁদনি চক পৌঁছতে সময় লাগবে মিনিটখানেক। সেখানে পৌঁছে হেঁটে হেঁটে ঘুরে আসুন জানবাজার সর্বজনীন, তালতলা সর্বজনীনের পুজো।
এর পর পার্ক স্ট্রিট, এসপ্ল্যানেড বা ময়দানে নেমে বিশেষ লাভ হবে না। তেমন কোনও নামী পুজো এই চত্বরে পাবেন না। তবে রসনাতৃপ্তির জন্য নামতেই পারেন পার্ক স্ট্রিট বা এসপ্ল্যানেড। এই চত্বরে নামীদামি পুজো না থাকলেও প্রচুর নামীদামি রেস্তোরাঁ রয়েছে। চট করে হালকা পেটপুজো করে আবার বেড়িয়ে পড়ুন।
পরের গন্তব্য রবীন্দ্র সদন। স্টেশন থেকে বেরিয়ে দেখে আসুন ২২ পল্লী, নর্দান পার্ক এবং চক্রবেড়িয়া নর্থ সর্বজনীনের পুজো। তবে বেশি সময় নষ্ট করলে চলবে না। পরের গন্তব্যে থাকছে অনেক চমক।
রবীন্দ্র সদন থেকে নেতাজী ভবন পৌঁছে যাবেন চোখের নিমেষে। নেতাজী ভবনে নেমে প্রথমে কোথায় যাবেন, তা নিয়ে ভাবতে ভাবতে মিনিট পাঁচেক কেটে যাবে। দু’পারেই অসংখ্য ভাল পুজোর সমাহার। কারণ ভবানীপুর চত্বরে রয়েছে একগাদা পুজো। হরিশ চ্যাটার্জি রোডের পাড়েই রয়েছে, ৭৫ পল্লী, ৭৫ পল্লী, হরিশ পার্ক, অগ্রদূত উদয় সংঘ, ৬৮ পল্লি ও সঙ্ঘমিত্র। এমনকি কলকাতার সবচেয়ে প্রাচীন পুজো দেখতে হলে গঙ্গার পাড়ের দিকে এগোলেই ধর্মোৎসাহিনী সভার দুর্গাপুজো। আবার যদুবাবাবুর বাজারের পাড়ে গেলে রয়েছে পদ্মপুকুর ইয়ুথ অ্যাসোসিয়েশন, ভবানীপুর সর্বজনীন দুর্গোৎসব, ভবানীপুর স্বাধীন সঙ্ঘ, ঐক্যতান, বকুলবাগান ও অবসর — কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখবেন।
ভবানীপুর চত্বরের সব প্যান্ডেল ঘুরে দেখলে পা ব্যথা হতে বাধ্য। তাই এ বার একটু বিশ্রাম নেওয়ার পালা। মেট্রোতে করে পৌঁছে যান যতীন দাস পার্ক স্টেশন। স্টেশন থেকে বেরিয়ে আর একটু কষ্ট করে হাজরা পার্ক, ২৩ পল্লি, ফরওয়ার্ড ক্লাব, মাতৃমন্দির ও সঙ্ঘশ্রীর ঠাকুর দেখে নিন। কালীঘাটের দিকে এগোলে রয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর পাড়ার পুজো, কালীঘাট মিলন সংঘ। তার সঙ্গে পটুয়াপাড়ার গলিতে ঢুকলেই সরস্বতী স্পোটিং ক্লাবের পুজো, সেই পুজো দেখে আরও এগোলে মিলবে মুক্তদলের পুজোর দেখা। হাজার পার্কের ঠাকুর দেখে ক্যান্সার হাসপাতালের পাড়ে গেলে একটু হেঁটে বন্ধুবান্ধব, প্রেমিক-প্রেমিকা বা পরিবারকে নিয়ে পৌঁছে যান ম্যাডক্স স্কোয়ার। বসে বসে ঘণ্টাখানেক আড্ডা দিতে দিতে বিশ্রাম নিয়ে আবার যতীন দাস পার্ক স্টেশনে চলে আসুন। মেট্রো ধরে চলে যান কালীঘাট।
কালীঘাটে পুজোর মেলা। এক ডজনেরও বেশি নামীদামি পুজো হয় কালীঘাট চত্বরে। জাঁকজমক থিমের জন্যও পরিচিত কালীঘাট এবং তদ্সংলগ্ন এলাকার পুজো। তালিকায় রয়েছে, বাদামতলা আষাঢ় সঙ্ঘ, ৬৬ পল্লি, জনমঙ্গল সমিতি, চেতলা অগ্রণী, ৬৪ পল্লি, দেশপ্রিয় পার্ক, আদি পল্লি পার্ক, ত্রিধারা, সমাজসেবী, বালিগঞ্জ কালচারাল, হিন্দুস্তান পার্ক, সিংহী পার্ক, একডালিয়া এভারগ্রিনের পুজো।
এর পর রবীন্দ্র সরোবর। মুদিয়ালি, শিবমন্দির, নবপল্লির মতো নামজাদা পুজোর দেখা মিলবে। সেখান থেকে একটি বাসে করে মিনিট ১৫ গেলেই নিউ আলিপুরে সুরুচি সঙ্ঘের পুজো। কাছেই রয়েছে বুড়োশিবতলা জনকল্যাণ সংঘের পুজোও। ফাঁক পেলে আইসক্রিম বা ঠান্ডা পানীয়ের বোতলে চুমুক দিয়ে আবার উঠে পড়ুন মেট্রোয়।
রবীন্দ্র সরোবর থেকে মেট্রো করে মহানায়ক উত্তম কুমার স্টেশনে হরিদেবপুর গিয়ে দেখে আসুন ৪১ পল্লী, অজেয় সংহতি, বিবেকানন্দ স্পোটিং ক্লাব, বিবেকানন্দ পার্ক অ্যাথলেটিক ক্লাবের পুজো। হরিদেবপুর থেকে বড়িশা জনপদের দিকে পা বাড়ালে একের পর এক বড় পুজোর সমাহার। শীতলাতলা কিশোর সঙ্ঘ, বড়িশা ক্লাব, বড়িশা সর্বজনীন, বড়িশা উদয়ন পল্লির পুজো। যদি দাদা সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের পুজো দেখতে হয় বড়িশা ক্লাবের ঠাকুর দেখে হাঁটা দিন ডায়মন্ড হারবার রোডের উত্তর দিকে। পৌঁছে যান চৌরাস্তায়, সেখানেই দাদার পাড়ার পুজো প্লেয়ার্স কর্নারের পুজো। বাড়তি পাওয়া হিসেবে মিলন মন্দির ও বড়িশা যুবক বৃন্দেরও পুজোও।
মহানায়ক উত্তর কুমারের পর নেতাজি মেট্রো স্টেশন। ওই চত্বরে নামী পুজো বলতে পল্লি উন্নয়ন সমিতির পুজো। বেশি সময় নষ্ট হওয়ার ভয় নেই।
এর পর মাস্টারদা সূর্য সেন মেট্রো স্টেশন থেকে হেঁটে হেঁটে বেরিয়ে দেখে আসতে পারেন আজাদগড়, রিজেন্ট পার্ক, রায়নগর উন্নয়ন সমিতির পুজো।
গীতাঞ্জলি মেট্রো থেকে বেরিয়ে পৌঁছে যান বিখ্যাত নাকতলা উদয়ন সঙ্ঘের পুজোয়। প্যান্ডেলের সজ্জা দেখে ভিড় ঠেলে তাড়াতাড়়ি আবার ফিরে আসুন মেট্রো স্টেশনে।
কবি নজরুল মেট্রো স্টেশন থেকে বেরিয়ে দেখার জন্য রয়েছে একগুচ্ছ পুজো-প্যান্ডেল। তালিকায় নবদুর্গা, বড়াল সর্বজনীন, পঞ্চ দুর্গা, তরুণ সাথী, শ্যামা পল্লি, কামদহরি পূর্বপাড়া, কামদহরি নারকেল বাগানের পুজো।
কবি নজরুল মেট্রো স্টেশন থেকে মেট্রোয় চেপে এর পর চলে যান পরবর্তী এবং অন্তিম স্টেশন শহিদ ক্ষুদিরাম। স্টেশন থেকে বেরিয়ে চলে যান পাটুলি এলাকায়। পাটুলি সর্বজনীনের ঠাকুর দেখে ফেললেই ব্যস! আর চিন্তা নেই। পরের স্টেশনে না গেলেও চলবে। কবি সুভাষ মেট্রো স্টেশনের আশপাশে দেখার মতো তেমন নামী কোনও পুজো নেই। সারা দিন ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে এ বার ঘরে ফেরার পালা। তবে বাড়ি ফেরার আগে বিরিয়ানি বা চাইনিজ় দিয়ে পেট আর মন ভরাতে ভুলবেন না।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।