টলিউডের হাল আমলের উজ্জ্বল তারকা তিনি। মূলত মূল ধারার বাণিজ্যিক ছবিতে দেখা যায় তাঁকে। প্রথম ছবির হাত ধরেই জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। তার পর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। দিন যত গড়িয়েছে, ততই প্রচারের আলোয় আলোকিত হয়েছেন। তবে নিজেকে শুধুমাত্র ‘লাইট-সাউন্ড-ক্যামেরা-অ্যাকশনে’র মধ্যে আটকে রাখেননি। পা রেখেছেন রাজনীতির ময়দানেও। তবে এখনও সেখানে সফল হননি। বাংলা ছবির নায়িকা হিসাবে বরাবরই তিনি চর্চিত। তিনি কৌশানী মুখোপাধ্যায়। এ বার রাজ্য রাজনীতিতে শোরগোল ফেলে দেওয়া শিক্ষায় নিয়োগ দুর্নীতির চর্চার মধ্যে ভেসে এল তাঁর নাম।
পরিচালক অনুপ সেনগুপ্ত এবং অভিনেত্রী পিয়া সেনগুপ্তের পুত্র বনিও প্রায় একই সময়ে টলিউডে কেরিয়ার শুরু করেছিলেন। ছবির কাজের সূত্রেই তাঁদের আলাপ। পরে সেই আলাপ প্রেমে গড়ায়।
বনির আরও একটি পরিচিতি রয়েছে। তাঁর মামাদাদু হলেন বিশিষ্ট অভিনেতা সুখেন দাস। ইন্ডাস্ট্রিতে অনেকেই বনিকে সুখেন দাসের নাতি হিসাবেও চেনেন।
শিক্ষায় নিয়োগ দুর্নীতিতে গ্রেফতার করা হয়েছে হুগলির বলাগড়ের যুব তৃণমূল নেতা কুন্তল ঘোষকে। তাঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের নথি ঘেঁটে দেখেই বনির নাম জানতে পারেন তদন্তকারীরা। কুন্তলের সঙ্গে বনির আর্থিক লেনদেন হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। এই সূত্রেই শুক্রবার সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্সে (যেখানে ইডির দফতর রয়েছে) ডাকা হয় বনিকে। কিন্তু তার আগেই বৃহস্পতিবার সেখানে গিয়েছেন অভিনেতা।
কুন্তলের হয়ে একাধিক অনুষ্ঠান করেছেন বনি, এমনটাই দাবি করেছেন তিনি। কুন্তলও একই দাবি করেছেন। বনি জানিয়েছেন, ৫ বছর আগে একটি গাড়ি কিনতে কুন্তল তাঁকে সাহায্য করেছিলেন। সেই সূত্রেই টাকার লেনদেন হয়। এর বিনিময়ে কুন্তলের একাধিক অনুষ্ঠান করেছেন বলে দাবি করেছেন বনি।
বনি এবং কুন্তলের যোগসূত্রের মধ্যেই উঠে এসেছে কৌশানীর নাম। বনির মাধ্যমেই কুন্তলের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়েছিল বলে দাবি করেছেন অভিনেত্রী। কুন্তলের অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথাও জানিয়েছেন কৌশানী। আর এর পরই নিয়োগ দুর্নীতিতে বনি এবং কৌশানীকে নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে।
কুন্তলের সঙ্গে কাজ করার প্রসঙ্গে আনন্দবাজার অনলাইনে মুখ খুলেছেন কৌশানী। বলেছেন, ‘‘আমরা আমাদের কাজ করেছি। বেরিয়ে এসেছি। আমি একটা-দু’টো ইভেন্টে গিয়ে থাকতে পারি ওঁর এলাকায়। আমি একশোটা লোকের ইভেন্ট করি। সবচেয়ে বেশি ইভেন্ট এবং শো করি। প্রচুর মাচা করি। আমি যদি কারও মাচায় গিয়ে থাকি, তা হলে তার সঙ্গে এই ঘটনা মেলানোর কোনও যৌক্তিকতা নেই। কোনও লেনদেনও থাকতে পারে না।’’ তাঁর আরও সংযোজন, ‘‘বনির সঙ্গে পরিচয় সূত্রেই আমার সঙ্গে (কুন্তলের) আলাপ। আমার সঙ্গে ওঁর কোনও ব্যক্তিগত আলাপ ছিল না। উনি আমাকে একটা ইভেন্টের জন্য বলেছিলেন। আমি একটা ইভেন্ট ওঁর জন্য করে দিয়েছিলাম। উনি আমাকে টাকা দিয়েছিলেন। সেখানেই সব শেষ।’’
টলিউডে কৌশানীর উত্থানের কাহিনিও বেশ চমকপ্রদ। রুপোলি পর্দায় পা রাখার আগে একটি সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন কৌশানী। ‘সুন্দর হাসি’ এবং ‘সুন্দর চুল’-এর শিরোপা জুটেছিল তাঁর। তার পরই রুপোলি পর্দায় অভিনয়ের সুযোগ আসে তাঁর কাছে।
২০১৫ সালে মুক্তি পেয়েছিল পরিচালক রাজ চক্রবর্তীর ছবি ‘পারব না আমি ছাড়তে তোকে’। এই ছবির হাত ধরেই টালিগঞ্জে ফিল্মি পাড়ায় পা রাখেন কৌশানী। ছবিতে কৌশানীর বিপরীতে ছিলেন বনি।
এর পর একের পর এক মূল ধারার বাংলা ছবির পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন কৌশানী। বনির পাশাপাশি দেব, জিতের মতো সুপারস্টারের সঙ্গেও কাজ করেছেন কৌশানী। কাজ করেছেন অঙ্কুশের সঙ্গেও। ‘কেলোর কীর্তি’ ছবিতে অঙ্কুশের বিপরীতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে।
অন্য নায়কদের সঙ্গে কাজ করলেও বনির সঙ্গেই অধিকাংশ ছবিতে জুটি বেঁধেছেন কৌশানী। পর্দার বাইরের প্রেমের কারণে সমাজমাধ্যমে এই তারকা জুটি বরাবরই নজর কাড়ে।
তবে ‘পারব না আমি ছাড়তে তোকে’র পর বনি-কৌশানীর জুটির কোনও ছবি সে ভাবে বক্স অফিসে দাগ কাটতে পারেনি। কিছু দিন আগেই এই জুটির ছবি ‘ডাল বাটি চুরমা’ মুক্তি পেয়েছিল। তবে তেমন সাড়া ফেলেনি।
ছবিতে রাজ করতে করতেই ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনের আগে রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়েছিল কৌশানীর। অভিনেত্রীর রাজনীতিতে পদার্পণ নিয়েও চর্চা চলেছিল।
বনির মা তথা অভিনেত্রী পিয়া সেনগুপ্তের সঙ্গে জোড়াফুলের পতাকা হতে তুলে নিয়েছিলেন কৌশানী। তিনি যখন তৃণমূলে যোগ দিলেন, সেই সময় বিজেপিতে যোগ দেন তাঁর ‘প্রেমিক’ বনি।
বনি বিজেপিতে, আর কৌশানী তৃণমূলে— এই নিয়ে সেই সময় জোর চর্চা চলে। যদিও সেই সময় কৌশানী বলেছিলেন, ‘‘আমার আর বনির ব্যক্তিগত সম্পর্ক আলাদা। রাজনৈতিক মতাদর্শও আলাদা। একে অন্যকে সম্মান করি।
২০২১ সালের নির্বাচনে কৃষ্ণনগর উত্তর কেন্দ্রে কৌশানীকে প্রার্থী করেছিল তৃণমূল। তাঁর বিপরীতে ছিলেন তৎকালীন বিজেপির নেতা মুকুল রায়। ভোটের লড়াইয়ে পা রেখে বিতর্কেরও মুখোমুখি হতে হয়েছে কৌশানীকে।
শোনা গিয়েছিল, কৌশানীকে প্রার্থী করায় কৃষ্ণনগর উত্তর বিধানসভা কেন্দ্রের জোড়াফুল শিবিরের একাংশের মধ্যে ক্ষোভের বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল। এমনকি, কৌশানীকে ‘বহিরাগত’ তকমাও দেওয়া হয়েছিল। তবুও লড়াই সামলেছেন।
ভোটের প্রচারে কৌশানীর এক মন্তব্যে নিয়ে বিতর্ক বেধেছিল। ফেসবুকে একটি ভিডিয়োতে কৌশানীকে বলতে দেখা গিয়েছিল, ‘‘ঘরে সবার মা, বোন আছে, ভোটটা ভেবে দেবেন।’’ যদিও এই ভিডিয়োর সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন। পরে কৌশানী দাবি করেছিলেন, ‘‘আমি বলেছিলাম, বাড়িতে সবারই মা-বোনেরা আছে, ভোটটা ভেবে দেবেন। তার উদ্দেশ্য হুমকি দেওয়া ছিল না।’’
তারকা মুখ হয়েও ওই কেন্দ্রে ভোটে হেরে যান কৌশানী। এর পর নিজের ছবির জগৎ নিয়েই নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন অভিনেত্রী।
ছবির বাইরেও বনি এবং কৌশানীকে নিয়ে সমাজমাধ্যমে রোজ চর্চা চলে। ইনস্টাগ্রামে কৌশানীর জনপ্রিয়তা নেহাত কম নয়! সেখানে তাঁর অনুরাগীর সংখ্যা ২ মিলিয়ন বা ২০ লক্ষেরও বেশি।
ছবির নায়িকা হলে তাঁকে নিয়ে নানা চর্চা হবেই। এ বার সেই চর্চার মধ্যেই নিয়োগ দুর্নীতিতে ধৃত কুন্তলের সঙ্গে বনি এবং কৌশানীর যোগাযোগ প্রকাশ্যে এল।
ছবি সংগৃহীত এবং ইনস্টাগ্রাম।