১৯১২ সালের টাইটানিক ডুবে যাওয়ার ঘটনা আজও ভয় ধরায়। কিন্তু টাইটানিক ডোবার তিন বছর আগেই সমুদ্র গ্রাস করে নিয়েছিল অন্য একটি বিশালাকার জাহাজকে। মাঝসমুদ্র থেকে হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গিয়েছিল সেটি। বহু দিন পর জলে ভেসে উঠেছিল বহু মৃতদেহ। কিন্তু জাহাজের ধ্বংসাবশেষের কোনও চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি।
১৯০৮ সালে ব্লু অ্যাঙ্কর লাইন নামে ব্রিটেনের এক জাহাজ নির্মাণকারী সংস্থা এসএস ওয়ারাতাহ নামে একটি জাহাজ তৈরি করে। সেই বছর ১২ সেপ্টেম্বর জাহাজটি উদ্বোধন করেছিলেন ব্রিটেনের এজেন্ট জেনারেল অফ ভিক্টোরিয়ার স্ত্রী জেডব্লিউ টাভার্নার।
জাহাজ নির্মাণকারী সংস্থার তরফে দাবি করা হয়েছিল যে, ওয়ারাতাহ কোনও পরিস্থিতিতেই ডুববে না। প্রথম যাত্রায় তা প্রমাণও করেছিল ওয়ারাতাহ। ১৯০৯ সালের জুলাই মাসে ২১১ জন যাত্রী নিয়ে দ্বিতীয় যাত্রা শুরু করেছিল জাহাজটি। অস্ট্রেলিয়া থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনের বন্দরে পৌঁছনোর কথা ছিল তার।
১৯০৯ সালের ২৬ জুলাই দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবান বন্দরে পৌঁছেছিল ওয়ারাতাহ। সেখান থেকে রাত সওয়া ৮টার সময় রওনা দিয়েছিল জাহাজটি। দক্ষিণ আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে ভারত মহাসাগরের উপর দিয়ে ভেসে যাওয়ার সময়ে ওয়ারাতাহকে লক্ষ করেন দূরে থাকা অন্য এক জাহাজের নাবিক।
ওয়ারাতাহের সঙ্গে দূরের জাহাজটি অনবরত আলো জ্বালিয়ে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করছিল বলে দাবি করেন ওই নাবিক। গতি বাড়িয়ে সেই জাহাজটিকে ২৭ জুলাই ভোর ৬টার সময় ধরে ফেলে ওয়ারাতাহ। তার পর সেই জাহাজটিকে পিছনে ফেলে এগিয়েও যায়।
অন্য জাহাজের নাবিকদের দাবি, সেই সময় সমুদ্র স্বাভাবিকের তুলনায় অনেকটাই উত্তাল হয়ে পড়ে। হঠাৎই শুরু হয়েছিল ঝড়। সেই ঝড়ের মধ্যেই নাকি মিলিয়ে যায় ওয়ারাতাহ।
নাবিকদের আরও দাবি, ১৩ বছর ধরে সমুদ্রে রয়েছেন তিনি। কিন্তু ২৭ জুলাই সারা দিন সমুদ্রের যে রুদ্ররূপ তিনি দেখেছিলেন, তা কোনও দিন দেখেননি। ঝড় চলকালীন সমুদ্রে ওয়ারাতাহের উপস্থিতি টের পেয়েছেন বলে দাবি অন্য জাহাজের নাবিকদের।
২৭ জুলাই একই দিকে ভেসে যাচ্ছিল হার্লো নামে একটি জাহাজ। সেই জাহাজের নাবিক জানিয়েছিলেন, রাতের অন্ধকারে মাঝসমুদ্রে তিনি প্রবল ধোঁয়া দেখতে পান। কোনও বিশাল জাহাজে আগুন লাগলেই একমাত্র ওই পরিমাণ ধোঁয়া বার হতে পারে বলে দাবি তাঁর। এমনকি, পর পর দু’বার আলোর ঝলকানিও দেখতে পান তিনি। তার পর আবার সব অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।
২৭ জুলাই রাত সাড়ে ৯টায় ডারবান থেকে উত্তর দিকে ভেসে যাচ্ছিল গুয়েল্ফ নামের একটি জাহাজ। সমুদ্রে অন্য একটি জাহাজের সঙ্গে নাকি আলো দিয়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিল সেটিও। কিন্তু আবহাওয়া খারাপ থাকার কারণে আলোর সঙ্কেত স্পষ্ট বুঝতে পারেননি জাহাজের নাবিক।
গুয়েল্ফ জাহাজের নাবিকদের দাবি, অন্য জাহাজ থেকে তিনি আলোর যে সঙ্কেতগুলি বুঝতে পেরেছিলেন, তা হল জাহাজের নামের শেষ তিনটি ইংরেজি অক্ষর টিএএইচ। তাঁর অনুমান, আলো দিয়ে ওয়ারাতাহের নাবিক সেই জাহাজের নামই বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু সেই জাহাজের কাছে কোনও ভাবেই দিকনির্দেশ করে পৌঁছতে পারেনি গুয়েল্ফ।
এমনকি, ঝড়ের সময় কাছাকাছি একটি দ্বীপের উঁচু টিলা থেকে টেলিস্কোপ লাগিয়ে সমুদ্রের দিকে নজর রেখেছিলেন এডওয়ার্ড জো কনকুয়ার নামে এক ব্যক্তি। পেশায় বন্দুকধারী ঘোড়সওয়ার ছিলেন তিনি। এডওয়ার্ডের দাবি, তিনি ওয়ারাতাহ জাহাজটির দেখা পেয়েছিলেন। সমুদ্রের স্রোতের সঙ্গে লড়াই করতে করতে হঠাৎ উধাও হয়ে যায় সেটি।
২৯ জুলাই কেপটাউন বন্দরে পৌঁছনোর কথা ছিল ওয়ারাতাহের। কিন্তু নির্দিষ্ট দিনে পৌঁছয়নি সেই জাহাজ। পৌঁছতে দেরি হচ্ছিল দেখে অনেকে ভেবেছিলেন, ঝড়ের কারণে অথবা জাহাজের কোনও যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেওয়ার কারণে ওয়ারাতাহ এখনও পৌঁছয়নি। কিন্তু এক সপ্তাহ পার হয়ে যাওয়ার পরেও জাহাজ বন্দরে না পৌঁছনোয় তল্লাশি শুরু করে নৌবাহিনী।
১৯০৯ সালের ১ অগস্ট ওয়ারাতাহ জাহাজটিকে খুঁজতে টিই ফুলার নামে একটি টাগবোট রওনা দেয়। কিন্তু খারাপ আবহাওয়ার কারণে তা আবার ফিরে আসে। তার পর এইচএমএস ফোর্তে এবং এইচএমএস প্যান্ডোরা নামে নৌবাহিনীর দু’টি জাহাজও হারিয়ে যাওয়া জাহাজের খোঁজে পাড়ি দেয়। কিন্তু আবহাওয়া সঙ্গ না দেওয়ার কারণে সেগুলিও ফিরে আসে।
ওয়ারাতাহ জাহাজটি যেখান থেকে হঠাৎ উধাও হয়েছিল, সেখানেই ১৩ অগস্ট একের পর এক মৃতদেহ ভেসে থাকতে দেখেছিলেন অন্য জাহাজের নাবিক এবং যাত্রীরা। কিন্তু জাহাজের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়নি কোথাও।
এই ঘটনার ৯০ বছর পর ১৯৯৯ সালের ১৪ জুলাই এমলিন ব্রাউন নামে এক সমুদ্র অন্বেষণকারী দাবি করেছিলেন, তিনি কেপটাউনের পূর্ব উপকূলে ওয়ারাতাহের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু সেই এলাকায় সমুদ্রের স্রোত এত বেশি যে কোনও ডুবুরির পক্ষে তার খোঁজ করা বিপজ্জনক। তাই তিনি জায়গাটির নির্দিষ্ট ঠিকানা জানাননি।
এমলিন দাবি করেছিলেন, ১৮ বছর ধরে অনুসন্ধান চালিয়ে ওয়ারাতাহকে খুঁজে পেয়েছেন তিনি। তাঁর দাবি, জাহাজের মাঝে এক হাজার টন ওজনের সিসা এবং ৩০০ টন ওজনের লোহার আকরিক ছিল।
আকরিকের সঙ্গে জল বা অন্য কোনও তরল মিশে যাওয়ায় তা জাহাজের অন্য প্রান্তে সরে যায়। ফলে ভারসাম্য হারায় জাহাজটি। এই কারণে ওয়ারাতাহ ডুবে যায় বলে মনে করেন অনেকে।
তবে একাংশের দাবি, ওয়ারাতাহ একটি ‘ভূতুড়ে’ জাহাজ। না হলে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার বহু দিন পর সমুদ্রে মৃতদেহ ভেসে ওঠে কী করে? জাহাজটির ধ্বংসাবশেষও বা সকলের নাগালের বাইরে রয়েছে কেন? সব মিলিয়ে ওয়ারাতাহকে ঘিরে রহস্য থেকেই গিয়েছে।
সব ছবি: সংগৃহীত।