প্রায় ৪০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে রাজত্ব করেছিল সে। ঘায়েল করেছিল বহু শত্রুকে। আবার শত্রুর আক্রমণেই যেতে বসেছিল চোখ আর প্রাণ। কিন্তু সেই জখম কাবু করতে পারেনি তাকে। মৃত্যুও হয়েছিল রাজার মতো। সেই ‘স্কার’ আজও মানুষের মনে রয়েছে গিয়েছে রাজা হয়েই।
একটি সিংহের আয়ু সাধারণত ১০ থেকে ১৪ বছর হয়। স্কার মারা গিয়েছিল ১৪ বছর বয়সে। অসুখ, আঘাত— সব কিছুকে জয় করেই দাপট দেখিয়ে বেঁচে ছিল সে।
ডান চোখে আঘাতই তাকে করেছিল পৃথিবী বিখ্যাত। নিজস্ব ফেসবুক পেজও ছিল তার। সেই পেজে অনুগামীর সংখ্যা লক্ষাধিক।
আঘাতের কারণে সিংহটির নাম রাখা হয়েছিল স্কার। অনেকে ডাকতেন ‘স্কারফেস’ বলে। কেনিয়ার মাসাইমারা জঙ্গলে ছিল তার বাস। চার ভাই মিলে রাজ করেছিল সেই জঙ্গলে।
‘প্রাইড বিফোর দ্য ফল’ বইতে স্কারকে ‘রকস্টার অফ মারা’ বলা হয়েছিল। পর্যটকেরা মাসাইমারা বেড়াতে গেলে তার খোঁজ করতেনই। শুধু চোখের ক্ষত নয়, কেশরের জন্যও বিখ্যাত ছিল স্কার।
বিশাল লম্বা কেশর ছিল স্কারের। এমন কেশর সচরাচর দেখা যেত না। হাওয়ায় উড়ত সেই কেশর। তার মধ্যে আবার কিছু অংশ ছিল কালো।
সিংহের কেশরে আকৃষ্ট হত সিংহীরা। সিংহীদের মধ্যেও দারুণ জনপ্রিয় ছিল এই পুরুষসিংহ। স্কারকে নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা যেত সিংহীদের মধ্যে। ভয়ঙ্কর ছিল তার গর্জন। সেই গর্জনেও হাড়হিম হয়ে যেত পর্যটক থেকে স্থানীয়দের।
সিংহদের একটা বড় অংশ বেঁচে থাকে আড়াই থেকে তিন বছর। প্রতিদ্বন্দ্বীর হামলায় প্রাণ যায় বেশির ভাগ সিংহের। কেউ আবার আহত হয়ে আত্মরক্ষার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তখন হায়নার দল শিকার করে সেই সিংহকে।
স্কারের জীবনে এই সব কিছুই ঘটেছে। এমনকি এক স্থানীয় পুরুষ নিজের সন্তানকে বাঁচানোর জন্য তাকে লক্ষ্য করে বর্শা ছুড়েছিলেন। তাতেও প্রাণে বেঁচে যায় স্কার। সব বাধাকে হেলায় হারিয়ে শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে ১৪ বছর বেঁচে থেকেছে সে।
স্কটল্যান্ডের বন্যপ্রাণ চিত্রগ্রাহক জর্জ লোগান মাসাইমারার সিংহের উপর লাগাতার নজর রাখতেন। তিনি জানিয়েছেন, যেখানে জন্ম হয়েছিল, মৃত্যুর আগে সেখানেই গিয়েছিল স্কার। প্রায় ২৫ কিলোমিটার পথ নিজেকে টানতে টানতে কোনও মতে নিয়ে গিয়েছিল সে।
জর্জ জানিয়েছেন, স্কার যেখানে মৃত্যুর আগে চলে গিয়েছিল, সেই এলাকায় ছিল মাসাইমারার সব থেকে বিপজ্জনক সালাস পুরুষ সিংহেরা। ছিল হায়নার দল। সকলেই নাকি প্রবীণ রাজাকে সম্মান জানিয়ে ওই চত্বর থেকে সরে গিয়েছিল। শান্তিতে মরতে পেরেছিল স্কার।
এক সময় মাসাইমারা জঙ্গলের একটা বড় অংশে দাপিয়ে বেড়াত স্কার এবং তার তিন ভাই। তাদের নাম হান্টার, মোরানি, সিকিয়ো। তাদের ‘ফোর মাস্কেটিয়ার্স’ বলা হত।
প্রায় ৪০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিজেদের দখলে রেখেছিল স্কার ভাইরা। সেখানে বিপক্ষ দলের সিংহদের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। কেউ ঢুকলে রেয়াৎ করত না স্কার।
এলাকা দখলে রাখতে গিয়েই গিয়েছিল ডান চোখ। সময়টা ২০১২ সাল। তখন স্কারের বয়স চার বছর। সিংহদের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে তুমুল লড়াই হয়েছিল। বিবিসি সেই নিয়ে তথ্যচিত্রও তৈরি করেছিল।
স্কারের ডান চোখ এবং তার উপরের অংশে বড় ধরনের ক্ষত তৈরি হয়েছিল। সংক্রমণের ফলে প্রাণটাই যেত। সঠিক সময়ে চিকিৎসকদের চোখে পড়ে। শুরু হয় চিকিৎসা।
এর পর মাঝেমধ্যেই চোখের উপরের সেই ক্ষত দগদগে হয়ে উঠত। ভাগ্যক্রমে প্রতি বারই তা চোখে পড়ে কোনও না কোনও চিকিৎসকের। প্রাণ বেঁচে যায় স্কারের।
আসলে ওই ক্ষতই মাসাইমারার জঙ্গলে ‘বিশেষ’ করে তুলেছিল স্কারকে। তেজ বেড়েছিল আরও। ২০১৬ সালে আবার তিন ভাইকে নিয়ে এলাকা দখলের লড়াইয়ে সামিল হয়েছিল স্কার। জিতেছিল সে বারও।
চোট-আঘাত খুব একটা কাবু করতে পারেনি স্কারকে। বয়সের ভারে ক্রমে জর্জরিত হয়ে যায় সে। তবে বয়সেও কোনও প্রতিপক্ষ তাকে ঘাঁটানোর চেষ্টা করেনি। বরং ভয়ে পাশ কাটিয়ে গিয়েছে। মৃত্যুর সময়ও আক্রমণ করেনি কোনও বন্য পশু।