
রকেট গতিতে উত্থান আর উল্কার মতো পতন। এককথায় বলতে গেলে এটাই ব্লুস্মার্ট মোবিলিটির কাহিনি। বৈদ্যুতিন গাড়ির অ্যাপ ক্যাব সংস্থাটির যাত্রী পরিষেবায় বেজায় খুশি ছিল আমজনতা। শুধু তা-ই নয়, একে ইলেকট্রিক ভেহিকল বা ইভির ‘পোস্টার বয়’ হিসাবেও দেখা হচ্ছিল। কিন্তু, রাতারাতি তার ঝাঁপ বন্ধ হওয়ায় বৈদ্যুতিন গাড়ির অ্যাপ ক্যাবের ভবিষ্যৎ নিয়ে উঠে গিয়েছে প্রশ্ন।

ব্লুস্মার্টের জনপ্রিয়তার সবচেয়ে বড় কারণ ছিল প্রতিশ্রুতি রক্ষা। অ্যাপ ক্যাব বুকিংয়ের পর তা বাতিল করা কিংবা যাত্রীদের থেকে অতিরিক্ত অর্থ নেওয়ার অভিযোগ ভূরি ভূরি। সে দিক থেকে ব্লুস্মার্ট ছিল স্বতন্ত্র। কিন্তু, হঠাৎ করেই সংস্থাটির বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তিকালীন আদেশ জারি করে শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রণকারী ‘সিকিউরিটিজ় অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়া’ বা সেবি। ফলে ঝাঁপ বন্ধ করতে বাধ্য হয় বৈদ্যুতিন গাড়ির অ্যাপ ক্যাব সংস্থা।

চলতি বছরের ১৫ এপ্রিল জারি করা অন্তর্বর্তিকালীন নির্দেশে সেবি জানিয়েছে, ব্লুস্মার্টের লগ্নিকারীদের ইভিতে বিনিয়োগের কথা রয়েছে। কিন্তু সংস্থার আর্থিক অব্যবস্থার জালে তাঁদের জড়ানো হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। ফলে বৈদ্যুতিন গাড়ির অ্যাপ ক্যাব সংস্থাটির বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে তদন্ত। গোটা ঘটনার জন্য ব্লুস্মার্টের মূল সংস্থা জেনসোল ইঞ্জিনিয়ারিংকে এর জন্য নিশানা করেছে সেবি।

২০১৯ সালের জানুয়ারিতে গুরুগ্রামে পথচলা শুরু করে ব্লুস্মার্ট মোবিলিটি। সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন অনমোল সিংহ জাগ্গি, পুনীত কে গোয়েল এবং পুনীত সিংহ জাগ্গি। গোড়াতেই ৩০ লক্ষ ডলারের অ্যাঞ্জেল তহবিল হাতে পায় এই সংস্থা। ব্লুস্মার্টকে ওই টাকা দিয়েছিল হিরো মোটোকর্প, জিটো অ্যাঞ্জেল নেটওয়ার্ক, মাইক্রোম্যাক্স এবং বলিউড অভিনেত্রী দীপিকা পাডুকোনের অফিস।

প্রথম দিকে শুধুমাত্র বৈদ্যুতিন গাড়ির চার্জিং স্টেশন তৈরির কাজে জড়িত ছিল ব্লুস্মার্ট। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই ঘণ্টাভিত্তিক যাত্রী পরিষেবা এবং ইন-অ্যাপ ওয়ালেটের মতো পরিষেবা চালু করে গুরুগ্রামের এই সংস্থা। ২০২১ সালে টাটা মোটরস এবং জিয়ো বিপির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় ব্লুস্মার্ট। ইভির বহর এবং চার্জিং স্টেশন বৃদ্ধি করাই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য।

২০২২ এবং ২০২৩ সাল ছিল ব্লুস্মার্টের সোনালি সময়। এই দু’বছরে গুরুগ্রামের সংস্থাটি বিপুল পরিমাণে অর্থ সংগ্রহ করেছিল। ২০২২ সালের মে মাসে ব্লুস্মার্টের প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ ছিল ২ কোটি ৫০ লক্ষ ডলার। পরের বছর সেটা আরও বেড়ে ৪ কোটি ২০ লক্ষ ডলারে গিয়ে পৌঁছোয়। ২০২৩ সালে প্রাপ্ত অর্থের অধিকাংশই এসেছিল লগ্নিকারীদের থেকে।

কিন্তু, ওই বছরই অন্যতম বিনিয়োগকারী মেফিল্ড ইন্ডিয়া নামের একটি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ড ব্লুস্মার্ট মোবিলিটির হাত ছেড়ে দেয়। সংস্থার সিইও জাগ্গির কাছে ৩২ কোটি টাকায় যাবতীয় শেয়ার বিক্রি করে চলে যায় মেফিল্ড ইন্ডিয়া। গুরুগ্রামের সংস্থাটির কাছে এটা একটা বড় আর্থিক ধাক্কা ছিল।

মেফিল্ড সঙ্গ ছাড়লেও তাদের সম্প্রসারণ অব্যাহত রাখে ওই স্টার্ট-আপ। ২০২২ সালে বেঙ্গালুরুতে ব্যবসা ছড়িয়ে দেয় ব্লুস্মার্ট। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর নাগাদ যাত্রী পরিষেবার জন্য তাদের হাতে ছিল পাঁচ হাজার বৈদ্যুতিন গাড়ি। এ ছাড়া ৩,৯০০টি চার্জিং স্টেশন তৈরি করতে সক্ষম হয় গুরুগ্রামের সংস্থা। ওই সময়ে তাদের রাজস্ব আয় ৪০০ কোটি টাকা অতিক্রম করে গিয়েছিল।

গত বছরের জানুয়ারিতে ব্লুস্মার্টের সঙ্গে যোগাযোগ করে ‘রেসপনসিবিলিটি’ নামের সুইৎজ়ারল্যান্ডের একটি জলবায়ুভিত্তিক আর্থিক সংস্থা। বৈদ্যুতিন গাড়ির অ্যাপ ক্যাব সংস্থাটির হাতে আরও ২ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা তুলে দেয় তারা। ওই অর্থে দেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় ইভি চার্জিং পরিকাঠামোকে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করানোর স্বপ্ন দেখেছিল জাগ্গিদের স্টার্ট-আপ।

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ফের বড় ঘোষণা করে ব্লুস্মার্ট। সংস্থাটির হাতে থাকা ছ’হাজার বৈদ্যুতিন ক্যাবের চার্জিংয়ের জন্য টাটা পাওয়ারের প্রযুক্তি ব্যবহারের কথা জানিয়ে দেয় তারা। ২০২৩-’২৪ আর্থিক বছরে স্টার্ট-আপটির বার্ষিক আয়ের পরিমাণ ছিল ৩৯০ কোটি টাকা, আগের অর্থবর্ষ থেকে যা ১৬০ কোটি টাকা বেশি। গত বছরের জুলাইয়ে আরও ২০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে ব্লুস্মার্ট।

কিন্তু, এ বছরের মার্চ থেকে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে ঘুরতে শুরু করে। ব্লুস্মার্টকে অধিগ্রহণের প্রাথমিক কথাবার্তা আর একটি অ্যাপ ক্যাব সংস্থা উবর সেরে ফেলেছে বলে খবর প্রকাশ্যে আসে। এর পরই স্টার্ট-আপের পিছনে থাকা মূল সংস্থা জেনসোল ইঞ্জিনিয়ারিং আর্থিক সঙ্কটে পড়ে যায়। সেখান থেকে এখনও তারা বেরিয়ে আসতে পারেনি।

১৫ এপ্রিলের অন্তর্বর্তিকালীন নির্দেশিকায় জেনসোল কী কী ভুল করেছে, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে সেবি। সেখানে বলা হয়েছে, সংস্থার দুই কর্ণধার তথা প্রোমোটার অনমোল এবং পুনীত সিংহ জাগ্গি সংস্থাকে তাঁদের ব্যক্তিগত ‘পিগি ব্যাঙ্ক’ হিসাবে ব্যবহার করেছেন। ফলে জেনসোলের কোনও আর্থিক নিয়ন্ত্রণ ছিল না। শুধু তা-ই নয়, ঋণের টাকা প্রোমোটারেরা নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

উল্লেখ্য, ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য সরকারি সংস্থা ‘ইন্ডিয়ান রিনিউয়েবল এনার্জি ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি’ (আইআরইডিএ) এবং ‘পাওয়ার ফিন্যান্স কর্পোরেশন লিমিটেড’-এর থেকে ৯৭৮ কোটি টাকা ঋণ নেয় ব্লুস্মার্ট। এই অর্থে বৈদ্যুতিন গাড়ি কেনার কথা ছিল তাদের। কিন্তু তার বদলে গাড়ির ডিলারশিপের মাধ্যমে প্রোমোটারদের সঙ্গে যুক্ত সংস্থায় ২০০ কোটি টাকা পাঠানো হয়।

বাকি টাকা বিলাসবহুল সম্পত্তি কিনতে খরচ করেন সংশ্লিষ্ট সংস্থার কর্ণধারেরা। সেই তালিকায় রয়েছে ডিএলএফ ক্যামেলিয়াস আবাসনের একটি ফ্ল্যাট, যার দাম ৭০ কোটি টাকারও বেশি। সেবির দাবি, ব্লুস্মার্টের তহবিল থেকে এই ধরনের অন্যায্য খরচের জন্য লগ্নিকারীদের বড় রকমের আর্থিক লোকসানের আশঙ্কা রয়েছে। আর তাই জেনসোলের প্রস্তাবিত স্টক বিভাজন স্থগিত রেখেছে এই কেন্দ্রীয় সংস্থা।

সেবির তরফে নির্দেশিকা জারির পর বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছে জেনসোল। কেন্দ্রীয় সংস্থার আদেশ পুরোপুরি মানা হবে বলে জানিয়েছে গুরুগ্রামের সংস্থা। তবে জাগ্গিরা আর তাঁদের সঙ্গে জড়িত নেই বলে স্পষ্ট করেছে জেনসোল। কারণ ইতিমধ্যেই পদত্যাগ করেছেন প্রতিষ্ঠাতা পুনীত সিংহ এবং অনমোল সিংহ। এ ছাড়া সংস্থার ঋণের অবস্থা দেখে ডিরেক্টর পদ থেকে ইস্তফা দেন অরুণ মেনন।

জেনসোলের এ হেন বিপদে সবচেয়ে বেশি ধাক্কা খেয়েছে তাদের স্টার্ট-আপ সংস্থা ব্লুস্মার্ট। কারণ অ্যাপ ক্যাব সংস্থাটির অধিকাংশ বৈদ্যুতিন গাড়ির মালিকানা ছিল জেনসোলের হাতে। ব্লুস্মার্টকে সেগুলি লিজ়ে দেওয়া হয়েছিল। মূল সংস্থার ঘাড়ে সেবির কোপ পড়ায় মারাত্মক আর্থিক সঙ্কটে পড়েছে এই অ্যাপ ক্যাব স্টার্ট-আপ।

চলতি বছরের ১৭ এপ্রিল থেকে পরিষেবা বন্ধ করেছে ব্লুস্মার্ট। দিল্লি এনসিআর, মুম্বই এবং বেঙ্গালুরুতে কোনও বুকিং নিচ্ছে না এই অ্যাপ ক্যাব সংস্থা। সংস্থার তরফে যাত্রীদের বার্তা পাঠানো হয়েছে। পরিষেবা পুনরায় চালু না হলে ৯০ দিনের মধ্যে টাকা ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ব্লুস্মার্ট।

গত ১৮ এপ্রিল আরও দুই স্বাধীন ডিরেক্টর হর্ষ সিংহ এবং কুলজিৎ সিংহ পপলি গুরুগ্রামের স্টার্ট-আপ সংস্থাটির পরিচালনমণ্ডলী থেকে পদত্যাগ করেন। অ্যাপ ক্যাব সংস্থা উবরের ব্লুস্মার্ট অধিগ্রহণের বিষয়টিও অনিশ্চিত। শেষ পর্যন্ত সমস্ত জটিলতা কাটিয়ে স্টার্ট-আপটি বেরিয়ে আসতে পারে কি না, সেটাই এখন দেখার।
সব ছবি: সংগৃহীত।