হিমাচল প্রদেশে পর্যটকদের অত্যন্ত পছন্দের জায়গা শিমলা, কুলু, মানালি, ডালহৌসির মতো শৈলশহরগুলি। মুখে মুখেই এই নামগুলি এত পরিচিতি পেয়েছে যে, এই রাজ্যে ঘুরতে যাওয়ার নাম উঠলেই জনপ্রিয় পর্যটনস্থলগুলি মনের মধ্যে ভেসে ওঠে। কিন্তু হিমাচলের পাহাড়ের কোলে বহু অজানা জায়গা, বহু অজানা রহস্য রয়েছে, যা খুব কম মানুষের গোচরে এসেছে।
হিমাচল প্রদেশের তেমনই একটি রহস্যে ঘেরা গ্রাম মালানা। এই গ্রাম বাইরের জগতের আঁচ থেকে নিজেদের সরিয়ে রেখেছে। স্কুল, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট— সব কিছুই আছে, কিন্তু মালানা গ্রামে সম্পূর্ণ আলাদা একটি জগৎ গড়ে উঠেছে।
হিমাচল প্রদেশের অতি প্রাচীন একটি গ্রাম মালানা। দাবি করা হয়, বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন গণতন্ত্রের জন্ম এই গ্রামে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮,৭০১ ফুট উচ্চতায় পাহাড়ের কোলে গড়ে উঠেছে এই গ্রাম। ৬২৫টি পরিবারের বাস এই গ্রামে। মোট জনসংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার।
কুলু থেকে ৪৪ কিলোমিটার দূরে রয়েছে এই গ্রাম। কুলু থেকে সেখানে পৌঁছতে ৪ ঘণ্টা সময় লাগে। ২ ঘণ্টা গাড়িতে, আর ২ ঘণ্টা পাহাড়ের চড়াই-উতরাই বেয়ে হেঁটে উঠতে হয়। তার পরেই ঢুকে পড়া যায় মালানার রহস্যময় জগতে।
মালানার পরিচিতি ‘চরস গ্রাম’ নামে। দাবি করা হয়, এখানে বিশ্বের অন্যতম উন্নত মানের চরস পাওয়া যায়। যেটি ‘মালানা ক্রিম’ নামে পরিচিত।
মালানা গ্রামের বাসিন্দারা নিজেদের সম্রাট আলেকজান্ডারের বংশধর বলে দাবি করেন। হিমাচল প্রদেশে বিধানসভার ভোট আগামী ১২ নভেম্বর। চার দিকে যখন ভোটের প্রচার চলছে, ভোট নিয়ে ব্যস্ততা, মালানায় কিন্তু তখন অন্য ব্যস্ততা তুঙ্গে।
এই গ্রামে বছরের তিন মাস ব্যস্ততা চরমে থাকে। তিন মাস চরস তৈরিতে ব্যস্ত থাকেন গ্রামবাসীরা। বছরের বাকি ৯ মাসের উপার্জন এই তিন মাসেই আয় করে নেওয়ায় ব্যস্ত থাকেন তাঁরা। চরস যে গাছ থেকে তৈরি হয়, বছরে তিন মাস সেই গাছ জন্মায়। তাই এই তিন মাস চরস তৈরির ব্যস্ততা তুঙ্গে থাকে।
‘দৈনিক ভাস্কর’-এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিন মাসে মালানা গ্রামে প্রতি দিন ১ কোটি ২০ লক্ষ টাকার চরস তৈরি হয়। সারা দিন চরস তৈরি করে এক এক জন ১০ হাজার টাকা আয় করেন।
‘দৈনিক ভাস্কর’-এর ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক জন দিনে ৮ ঘণ্টা কাজ করলে ১২ গ্রাম চরস তৈরি করতে পারেন। ১০ গ্রাম চরসের দাম ৮ হাজার টাকা। এক দিনে প্রায় সাড়ে ১৪ কেজি চরস তৈরি হয় গ্রামে। যার দাম এক কোটি টাকার বেশি।
মাসে ৪৩২ কেজি চরস তৈরি করে এই গ্রাম। সেই চরস বিক্রি করে ৩৬ কোটি টাকা আয় হয়। তিন মাসে মোট ১০৮ কোটি টাকার ব্যবসা হয় এই গ্রামে।
বাইরের লোকেরা এই গ্রামে প্রবেশ করতে পারলেও, এখানে এত রকম বিধিনিষেধের বেড়া রয়েছে যে, তা লঙ্ঘন করলে শাস্তির খাঁড়া নেমে আসতে পারে। বিপুল টাকা জরিমানাও দিতে হয়।
উল্লেখযোগ্য যে বিষয়গুলি, তার মধ্যে একটি হল, বাইরের কোনও লোক গ্রামবাসী এবং তাঁদের কোনও জিনিস ছুঁতে পারবেন না। বহিরাগতদের থেকে তাঁরা সব সময় দূরত্ব বজায় রাখেন।
মালানায় নিজেদের শাসন, আইন চলে। এই গ্রামের নিজস্ব ভাষা আছে। যে ভাষা কানাশি নামে পরিচিত। গোটা হিমাচল প্রদেশে যার কোনও ব্যবহার নেই।
এই গ্রামে কোনও ঘটনায় পুলিশের মধ্যস্থতাকে অনুমতি দেওয়া হয় না। কেউ কোনও অপরাধ করলে গ্রাম পরিষদই তাঁর শাস্তির ব্যবস্থা করে। অন্য কোনও আইন বা শাসন চলে না। কোনও অভিযুক্ত যদি পুলিশের সহযোগিতা চান, তা হলে তাঁকে জরিমানা করে গ্রাম পরিষদ।
এখানে গ্রাম পরিষদই সব কিছু। গোটা গ্রাম পরিষদের ইশারায় চলে। ভুলেও কেউ যদি এই গ্রামের কোনও মন্দির ছুঁয়ে ফেলেন, তা হলে তাঁকে বড় অঙ্কের জরিমানা দিতে হয়।
গ্রামে ঠাকুর সম্প্রদায়ের মানুষই বেশি। হরিজন সম্প্রদায়ের লোকেরা গ্রামের বাইরে থাকেন। এখানে নামেই পঞ্চায়েত আছে, সব কিছুই গ্রামবাসীরা সিদ্ধান্ত নেন।
মালানায় ছবি তোলায় কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই। কিন্তু কোনও ভিডিয়ো করা যাবে না।
মালানায় দোতলা, তিনতলা বাড়ি দেখা যায়। নীচতলাকে গ্রামবাসীরা খুরাং বলেন। এখানে গবাদি পশু এবং জ্বালানি কাঠ রাখা হয়। দোতলাকে গায়িং বলা হয়। এখানে খাবার এবং ব্যবহারের যাবতীয় জিনিস রাখা হয়। তিনতলাকে পাতি বলা হয়। এখানে শোয়ার ঘর থাকে।