
চলতি বছরের ১ এপ্রিল থেকে ‘গুগ্ল কর’ মকুব করেছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পারস্পরিক শুল্কনীতির জেরে রক্তাক্ত শেয়ার বাজার। এই পরিস্থিতিতে আমেরিকাকে ‘খুশি’ করতে পদক্ষেপ? না কি নেপথ্যে অন্য কোনও বাণিজ্যিক ছক রয়েছে নয়াদিল্লির? উঠছে প্রশ্ন।

গত ২ এপ্রিল পারস্পরিক শুল্কনীতি চালু করেন ট্রাম্প। তার কয়েক দিন আগে ‘গুগ্ল কর’ প্রত্যাহারের কথা জানিয়ে দেয় কেন্দ্র। বিদেশি প্রযুক্তি সংস্থাগুলির ডিজিটাল বিজ্ঞাপন পরিষেবার উপর সংশ্লিষ্ট করটি আদায় করত সরকার। এটি মকুব করায় গুগ্ল ও মেটার মতো বহুজাতিক টেক জায়ান্ট সংস্থাগুলি ভারতের বাজারে যে বেশি লাভ করবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

আর্থিক বিশ্লেষকদের দাবি, ‘গুগ্ল কর’ প্রকৃতপক্ষে একটি সমীকরণ শুল্ক বা ইকুয়ালাইজ়েশন লেভি। ভারতের বাজারে ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের জন্য বিদেশি টেক জায়ান্ট সংস্থাগুলিকে এর জন্য দিতে হচ্ছিল ছ’শতাংশ কর। ১ এপ্রিল থেকে নতুন অর্থ আইন চালু করেছে সরকার। এটি তারই একটি সংশোধনীর অংশ বলে জানা গিয়েছে।

২০১৬ সালে ‘গুগ্ল কর’ চালু করে নয়াদিল্লি। সেই সময়ে জারি করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ভারতে ব্যবসা করে বিপুল পরিমাণ মুনাফা করছে গুগ্ল ও মেটার মতো বহুজাতিক টেক জায়ান্ট সংস্থা। অতএব সরকারি কোষাগারে কর বাবদ অর্থ প্রদান করতে হবে তাদের। এ ব্যাপারে শারীরিক ভাবে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলির উপস্থিতি অপরিহার্য নয়।

বিশ্লেষকদের দাবি, এই কর প্রত্যাহারের নেপথ্যে মোদী সরকারের একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, এর মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একটি বার্তা দেওয়া সম্ভব হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সংস্থাগুলির প্রতি নয়াদিল্লি যে বৈষম্যমূলক আচরণ করে না, ট্রাম্পকে তা বোঝাতে চাইছে কেন্দ্র।

ফেব্রুয়ারিতে আমেরিকা সফরে গিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। তখনই এ ব্যাপারে ইঙ্গিত দেন তিনি। বর্ষীয়ান রিপাবলিকান নেতার সামনে তিনি বলেন, ‘‘দেখুন, আমরা চিন নই। অ্যালফাবেট ইনকর্পোরেটেড এবং মেটার মতো ডিজিটাল সংস্থাগুলি ভারতের বাজারে সস্তায় বিজ্ঞাপন দিতে চাইছে। এতে আপত্তির কিছু নেই।’’

‘গুগ্ল কর’ তুলে নেওয়ার দ্বিতীয় কারণ হল, এর জন্য বহুজাতিক টেক জায়ান্ট সংস্থাগুলি বিজ্ঞাপনদাতাদের থেকে বেশি টাকা নিচ্ছিল। ফলে এ দেশের ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের খরচ বহু গুণ বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে সেটা কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে সরকার।

বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, মোদী সরকার ‘গুগ্ল কর’ তুলে দেওয়ায় কমেছে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের খরচ। ফলে এই ধরনের প্ল্যাটফর্মগুলিতে বিজ্ঞাপন দিতে উৎসাহ পাচ্ছে বিভিন্ন সংস্থা। অন্য দিকে লাভের অঙ্ক বৃদ্ধি পাওয়ায় গুগ্ল, মেটা বা অ্যামাজ়নের মতো সংস্থাগুলি এ দেশের বাজারে তাদের ব্যবসার পরিসর বৃদ্ধির সুযোগ পাচ্ছে।

উল্লেখ্য, গত বছর অনাবাসী ই-কমার্স সংস্থাগুলির উপর থেকে দু’শতাংশ কর প্রত্যাহার করে মোদী সরকার। ২০২০ সালে ওয়াশিংটনকে বিষয়টি জানায় নয়াদিল্লি। ভারতের যুক্তি ছিল, কোনও সুনির্দিষ্ট বিদেশি ই-কমার্স সংস্থার থেকে কর বা শুল্ক নেওয়া হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট নিয়ম সকলের জন্য প্রযোজ্য। তাই আমেরিকার আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।

বিদেশ থেকে আমদানি করা কিছু পণ্যের উপর ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স বা ভ্যাট নিয়ে থাকে কেন্দ্র। এর পরিমাণ কম-বেশি ২৮ শতাংশ। মার্চে এ ব্যাপারে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ। এই কর কমানোর ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ট্রাম্পের পারস্পরিক শুল্কনীতির ফলে ধাক্কা খাচ্ছে ভারত-মার্কিন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য। কিন্তু নয়াদিল্লির পক্ষে ভ্যাট মকুব মোটেই সহজ কাজ নয়। কারণ এর জন্য ২৮টি রাজ্যের বোর্ডের সঙ্গে কথা বলতে হবে কেন্দ্রকে। এ ব্যাপারে সকলের একমত হওয়া বেশ কঠিন।

৫ এপ্রিল থেকে ১০ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হওয়ায় আইফোনের দাম বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে তড়িঘড়ি এ দেশের কারখানা থেকে পাঁচটি বিমান বোঝাই করে স্মার্টফোন আমেরিকায় নিয়ে গিয়েছে নির্মাণ সংস্থা অ্যাপল। ট্রাম্পের শুল্ক-বাণ এড়াতে ওই পদক্ষেপ বলে জানিয়েছে বহুজাতিক মার্কিন প্রতিষ্ঠান।

আগামী ৯ এপ্রিল মধ্যরাত থেকে বর্ধিত শুল্ক কার্যকর করবে ট্রাম্প প্রশাসন। তার আগে এশিয়ার শেয়ার বাজারে নেমেছে ধস। আমেরিকাতেও রক্তাক্ত স্টকের সূচক। খোদ প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে পথে নেমে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন সেখানকার বাসিন্দারা। কিন্তু নিজের অবস্থান বদলাতে নারাজ বর্ষীয়ান রিপাবলিকান নেতা। তাঁর পাল্টা দাবি, ‘‘ওষুধে কাজ দিচ্ছে।’’

অন্য দিকে শুল্ক নিয়ে আমেরিকার সঙ্গে ইতিমধ্যেই দর কষাকষিতে নেমে পড়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। হোয়াইট হাউসের অর্থনৈতিক কাউন্সিলের অধিকর্তা কেভিন হ্যাসেট জানিয়েছেন, ৫০টিরও বেশি দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। চিঠি পাঠিয়েছে বাংলাদেশও।

সরকারি তথ্য বলছে, ভারতের মোট রফতানির প্রায় ১৮ শতাংশ যায় আমেরিকায়। আমদানির ক্ষেত্রে দেশীয় বাজারের ৬.২২ শতাংশ মার্কিন পণ্য। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য হয় ১০.৭৩ শতাংশ।

সম্প্রতি নয়া মার্কিন শুল্কনীতিতে আমেরিকার বাজারে ভারতীয় পণ্য রফতানির জন্য ২৬ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক ঘোষণা করেছেন ট্রাম্প। এই সিদ্ধান্তের ফলে চিংড়ি, কার্পেট, চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং সোনার গহনা রফতানিকারকেরা ধাক্কা খেতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, ট্রাম্পের শুল্কনীতির পাল্টা উচ্চ হারে আমদানি করা মার্কিন পণ্যে কর বসিয়েছে চিন-সহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ। তবে সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এখনই সেই রাস্তায় হাঁটছে না ভারত। এ ব্যাপারে দু’পক্ষের আলোচনা চলছে।

সরকার সূত্রে খবর, বর্তমান পরিস্থিতিতে দ্রুত আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি সেরে ফেলতে চাইছে নয়াদিল্লি। এ ব্যাপারে পড়শি চিন, ভিয়েতনাম কিংবা ইন্দোনেশিয়ার চেয়ে এগিয়ে থাকতে চাইছে মোদী সরকার।

পড়শি তথা প্রতিদ্বন্দ্বী বেজিং আমেরিকায় পণ্য রফতানির উপর রাশ টেনেছে। চিনা প্রেসিডেন্ট তথা চেয়ারম্যান শি জিনপিং ড্রাগনভূমিতে ১১টি মার্কিন সংস্থার বাণিজ্য বন্ধ করে দিয়েছেন। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিতে চাইছে নয়াদিল্লি।
সব ছবি: সংগৃহীত।