দুয়ারে দাঁড়ানো চিরশত্রুকে ভয়ঙ্কর সব মারণাস্ত্র বিক্রি করেছে ভারত। সেই সমস্ত হাতিয়ারের ধ্বংসক্ষমতা দেখে চোখ কপালে উঠেছে কাস্পিয়ান সাগরের তীরের মধ্য এশিয়ার দেশটির। বিপদ ঘনিয়ে আসছে বুঝতে পেরে সময় নষ্ট করেনি ককেসাস পাহাড়ের দক্ষিণ কোলের ওই রাষ্ট্রটি। গোপনে ‘বন্ধু’ মারফত নয়াদিল্লির কাছে একই ধরনের হাতিয়ার কেনার আর্জি জানিয়েছে তারা।
কথায় আছে, ‘বিষে বিষে বিষক্ষয়’! সম্প্রতি তেমনই পরিকল্পনা করেছিল মধ্য এশিয়ার কাস্পিয়ান সাগরের তীরের দেশ। যদিও শেষ পর্যন্ত তাঁদের চালাকি ধরে ফেলে নয়াদিল্লি। পত্রপাঠ ‘বন্ধু’ মারফত পাঠানো প্রতিরক্ষা চুক্তির আর্জি খারিজ করে দেয় নরেন্দ্র মোদী সরকার। আর এতে তাঁদের যাবতীয় পরিকল্পনায় যে জল ঢালা হয়েছে, তা বলার অবকাশ রাখে না।
মধ্য এশিয়ার ককেসাস পাহাড়ের দক্ষিণ কোলের কাস্পিয়ান সাগর তীরবর্তী দেশটি হল আজ়ারবাইজান। প্রতিবেশী আর্মেনিয়ার সঙ্গে সাপে-নেউলে সম্পর্ক তাদের। গত কয়েক বছর ধরে আর্মেনিয়াকে একাধিক মারণাস্ত্র বিক্রি করেছে নয়াদিল্লি। সূত্রের খবর, সেই একই অস্ত্র ঘুরপথে ভারতের থেকে কেনার ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে আজ়ারবাইজান।
২০২২ সালে ‘আকাশ’ ক্ষেপণাস্ত্র কেনার জন্য ভারতের সঙ্গে ছ’হাজার কোটি টাকার চুক্তি করে আর্মেনিয়া। এই হাতিয়ারের মোট ১৫টি ইউনিট ইয়েরেভানকে সরবরাহের কথা রয়েছে নয়াদিল্লির। চলতি বছরের নভেম্বরে ‘আকাশ’-এর দ্বিতীয় ইউনিট আর্মেনীয় সেনার হাতে তুলে দিয়েছে মোদী সরকার।
‘আকাশ’ প্রকৃতপক্ষে একটি আকাশ প্রতিরোধী ব্যবস্থা। এতে রয়েছে ভূমি থেকে আকাশে হামলা চালানোর ক্ষেপণাস্ত্র। শত্রুর যুদ্ধবিমান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র বা ড্রোনকে মাঝ আকাশে ধ্বংস করার ক্ষমতা রয়েছে সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি এই হাতিয়ারের। এর পাল্লা ২৫ কিলোমিটার।
২০২২ সালেই নয়াদিল্লির থেকে ‘পিনাকা মাল্টি ব্যারেল রকেট লঞ্চার’ কেনে আর্মেনিয়া। এর নকশা তৈরি করেছে প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিও। মাত্র ৪৪ সেকেন্ডের মধ্যে ১২টি করে রকেট নিখুঁত নিশানায় ছোড়ার ক্ষমতা রয়েছে পিনাকার। সাধারণ ভাবে এর পাল্লা ৪০ কিলোমিটার। তবে হাতিয়ারটির নতুন সংস্করণের বর্ধিত পাল্লা ৬০ কিলোমিটার বলে জানা গিয়েছে।
১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধের গতি পাল্টাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল পিনাকা। এ বছরের নভেম্বরে আর্মেনীয় ফৌজকে এই হাতিয়ার সরবরাহ শুরু করেছে নয়াদিল্লি। এ ছাড়া ভারতের থেকে রাডার এবং ড্রোন কেনার ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে মধ্য এশিয়ার এই দেশ।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, মূলত আকাশ এবং পিনাকাকে নিয়ে আজ়ারবাইজানের মনে ধরেছে ভয়। আর তাই প্রতিরক্ষা ও আক্রমণাত্মক, এই দুই মারণাস্ত্র ভারতের থেকে কিনতে চাইছে বাকু। কিন্তু সরাসরি প্রস্তাব না-দিয়ে নয়াদিল্লির এক বন্ধু রাষ্ট্রের মারফত সেই আর্জি জানিয়েছে তারা।
সূত্রের খবর, প্রস্তাব আসা মাত্রই বন্ধু দেশটিকে এ ব্যাপারে না বলেছে কেন্দ্র। নয়াদিল্লির যুক্তি, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে সব সময়ে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে মধ্যস্থতাকারী কোনও দেশকে সামনে রেখে প্রতিরক্ষা চুক্তি করার প্রশ্ন নেই।
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই হাতিয়ার আমদানির পরিমাণ কমিয়ে দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি অস্ত্র রফতানির উপর জোর দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। হাতিয়ার রফতানির নিরিখে আমেরিকা ও রাশিয়ার স্তরে নিজেকে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে নয়াদিল্লি।
এই পরিস্থিতিতে বন্ধু দেশের থেকে আসা প্রস্তাব যথেষ্ট লোভনীয় ছিল। সূত্রের খবর, ওই রাষ্ট্রটির এক শীর্ষ আধিকারিক প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের পদস্থ কর্তাদের বলেন, অস্ত্র সরবরাহের ক্ষেত্রে দীর্ঘকালীন অংশীদার খুঁজলে নয়াদিল্লি অবশ্যই আজ়ারবাইজানের দিকে তাকাতে পারে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের অবশ্য দাবি, বাকুর ব্যাপারে দিল্লির এ-হেন নেতিবাচক মনোভাবের নেপথ্যে একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, কাশ্মীর ইস্যুতে তুরস্কের মতো বার বার পাকিস্তানের পাশে দাঁড়িয়েছে আজ়ারবাইজান। ভূস্বর্গের একাংশ অবৈধ ভাবে ভারত দখল করে রেখেছে বলে আন্তর্জাতিক মঞ্চে বিবৃতি দিতে শোনা গিয়েছে কাস্পিয়ান সাগরের তীরের দেশটিকে।
দ্বিতীয়ত, ইসলামাবাদের সঙ্গে বাকুর সম্পর্ক বেশ গভীর। আর্মেনিয়াকে হারাতে পাক ফৌজিদের ভাড়া করে এনে নিজেদের সেনাবাহিনীর সঙ্গে ব্যবহার করার অভিযোগও রয়েছে আজ়ারবাইজানের বিরুদ্ধে। এই অবস্থায় নীতিগত ভাবে মধ্য এশিয়ার দেশটিকে নয়াদিল্লি যে হাতিয়ার বিক্রি করবে না, তা বলাই বাহুল্য।
এ ছাড়া আজ়ারবাইজানের সঙ্গে শত্রুতায় গ্রিস এবং ফ্রান্সকে পাশে পেয়েছে আর্মেনিয়া। এই দুই দেশের সঙ্গে ভারতের মজবুত সম্পর্ক রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে অর্থের লোভে বাকুকে হাতিয়ার সরবরাহ শুরু করলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আথেন্স এবং প্যারিসের মতো বন্ধুকে হারানোর আশঙ্কা রয়েছে, যা কখনওই চাইবে না নয়াদিল্লি।
২০১৭ সালে পাকিস্তান এবং তুরস্কের সঙ্গে ত্রিপাক্ষিক সম্পর্ক গভীর করার দিকে মন দেয় আজ়ারবাইজান। চলতি বছরের জুলাইয়ে কাজ়াখস্তানে হওয়া সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজ়েশন বা এসসিও) বৈঠকে আলাদা করে কথা বলেন এই তিন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান। গত বছর (পড়ুন ২০২৩) কাশ্মীর ইস্যুতে খোলাখুলি ভাবে ইসলামাবাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল বাকু।
মধ্য এশিয়ার নাগোর্নো-কারাবাখ নামের একটি এলাকাকে নিয়ে আর্মেনিয়া ও আজ়ারবাইজানের মধ্যে দীর্ঘ দিন ধরেই বিবাদ চলছে। গত শতাব্দীতে এই দুই দেশই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ। ওই সময়ে সংঘাত এড়াতে নাগোর্নো-কারাবাখকে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেয় মস্কো।
কিন্তু, আশির দশক থেকে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। নাগোর্নো-কারবাখের অধিকাংশ বাসিন্দাই আর্মেনীয় হওয়ায় ইয়েরেভানের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার দাবি উঠতে শুরু করে। অন্য দিকে এলাকাটি আজ়ারবাইজানের ভূমিতে ঘেরা থাকায় এর অধিকার ছাড়তে রাজি হয়নি বাকু।
বিশেষজ্ঞদের একাংশের অবশ্য দাবি, নাগোর্নো-কারাবাখের বিপুল খনিজ সম্পদের লোভ আজ়ারবাইজানকে যুদ্ধে উৎসাহিত করেছে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ান ভেঙে গেলে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে মধ্য এশিয়ার ওই দুই দেশ। এর পর থেকেই ওই এলাকাকে কেন্দ্র করে একাধিক বার লড়াইয়ের ময়দানে একে অপরের রক্ত ঝরিয়েছেন বাকু ও ইয়েরেভানের সৈনিকেরা।
২০২০ সালে তুরস্কের থেকে কেনা হাতিয়ার এবং আত্মঘাতী ড্রোনের সাহায্যে আচমকা নাগোর্নো-কারাবাখে হামলা চালায় আজ়ারবাইজান। সেই হামলা সহ্য করতে পারেনি আর্মেনীয় বাহিনী। ফলে গোটা এলাকার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় বাকুর কব্জা।
ওই যুদ্ধের পর নিজেদের অস্ত্রভান্ডার বৃদ্ধির দিকে নজর দেয় আর্মেনীয় ফৌজ। প্রতিরক্ষা খাতে খরচের পরিমাণ কয়েক গুণ বাড়িয়েছে মধ্য এশিয়ার ওই দেশ। একটা সময়ে রাশিয়ার থেকে যাবতীয় হাতিয়ার কিনত ইয়েরেভান। কিন্তু, নাগোর্নো-কারাবাখ ইস্যুতে মস্কো যুদ্ধবিরতির উপর জোর দেওয়ায় অস্ত্র সংগ্রহে ভারতের দিকে মুখ ফিরিয়েছে আর্মেনিয়া।
গত তিন-চার বছরে রকেট লঞ্চার, কামান, গোলা-বারুদ, স্নাইপার রাইফেল, ট্যাঙ্কধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র কিনতে নয়াদিল্লির সঙ্গে বেশ কয়েকটি প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছে ইয়েরেভান। বর্তমানে রাশিয়ার তৈরি সুখোই-৩০এমকেআই যুদ্ধবিমানের সংখ্যা বৃদ্ধির দিকে নজর দিয়েছে তারা। এই যুদ্ধবিমানে ‘অস্ত্র’ নামের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে ভারতীয় বায়ুসেনা। ওই মারণাস্ত্র পাওয়ার ব্যাপারেও কেন্দ্রের সঙ্গে আর্মেনীয় সরকারের কথাবার্তা চলছে বলে জানা গিয়েছে।
সব ছবি: সংগৃহীত।