
ডিজ়েল বিক্রিতে বড় পতন! দিন দিন কমছে এই পেট্রোপণ্যের চাহিদা। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই উঠে গিয়েছে একটি প্রশ্ন। এ বার কি তবে বৈদ্যুতিন গাড়ির (ইলেকট্রিক ভেহিকল বা ইভি) দুনিয়ায় পুরোপুরি ঢুকে পড়ল ভারত? দেশের অর্থনীতিতে কতটা পড়বে এর প্রভাব? জবাব খুঁজছেন তাবড়় আর্থিক বিশ্লেষকেরা।

ভারতে ব্যবহৃত সর্বাধিক পেট্রোপণ্য হল ডিজ়েল। সরকারি হিসাব বলছে, ৩১ মার্চ শেষ হওয়া অর্থবর্ষে (পড়ুন ২০২৪-’২৫) কোভিড অতিমারির পর ডিজ়েলের চাহিদা সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গিয়েছে। বিকল্প জ্বালানির দিকে যে ধীরে ধীরে দেশের অর্থনীতি ঝুঁকতে শুরু করেছে, এটাই তার প্রমাণ।

কেন্দ্রীয় তেল মন্ত্রকের নিয়ন্ত্রণাধীন ‘পেট্রোলিয়াম প্ল্যানিং অ্যান্ড অ্যানালিসিস সেল’ বা পিপিএসি-র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ১ এপ্রিল থেকে এ বছরের ৩১ মার্চের মধ্যে ভারতে ডিজ়েলের ব্যবহার মাত্র দু’শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পেট্রোপণ্যের মোট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৯ কোটি ১৪ লক্ষ টন। কোন কোন ক্ষেত্রে ডিজ়েলের ব্যবহার হ্রাস পেয়েছে, সরকারি রিপোর্টে তারও উল্লেখ রয়েছে।

ট্রাক ও লরির মতো পণ্য পরিবহণে ব্যবহৃত গাড়ি এবং কৃষিক্ষেত্রের ট্র্যাক্টর-সহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি চালাতে ডিজ়েল অপরিহার্য বলে গণ্য করা হয়। কিন্তু, সরকারি হিসাব বলছে, এই দুই ক্ষেত্রেই ধীরে ধীরে কমছে পেট্রোপণ্যটির ব্যবহার। ২০২২-’২৩ আর্থিক বছরে দেশে ডিজ়েলের চাহিদা ছিল ১২.১ শতাংশ। পরের অর্থবর্ষে সেই অঙ্ক ৪.৩ শতাংশে নেমে যায়।

তবে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, গত আর্থিক বছরে ডিজ়েলের চাহিদা চার শতাংশের নীচে চলে এসেছে। এই সূচক আরও নামবে বলে মনে করা হচ্ছে। মজার বিষয় হল, দেশে ব্যবহৃত পেট্রোপণ্যের প্রায় ৪০ শতাংশই দখল করে রয়েছে ডিজ়েল।

ভারতে ডিজ়েলের চাহিদা হ্রাসের নেপথ্যে একাধিক কারণের কথা বলেছেন আর্থিক বিশ্লেষক ও শিল্পপতিরা। তাঁদের দাবি, দেশের যাত্রী ও পণ্য পরিবহণের তিন চতুর্থাংশের ক্ষেত্রে শক্তির জোগান দেয় ডিজ়েল। কিন্তু সেই জায়গা ধীরে ধীরে দখল করছে বৈদ্যুতিন গাড়ি।

উদাহরণ হিসাবে একাধিক সরকারি উদ্যোগের উল্লেখ করেছেন আর্থিক বিশেষজ্ঞেরা। সেই তালিকায় প্রথমেই থাকবে ভারতীয় রেলের নাম। দূরপাল্লার ট্রেন বা মালগাড়ির ডিজ়েল ইঞ্জিনের বদল করতে সমস্ত জায়গায় বৈদ্যুতিন সুবিধা স্থাপনের কাজ দ্রুত গতিতে চালিয়ে যাচ্ছে রেল মন্ত্রক। ফলে সেখানে কমছে চাহিদা।

এ ছাড়া দিল্লি, বেঙ্গালুরু, নয়ডা বা গুরুগ্রামের মতো এলাকাগুলিতে বৈদ্যুতিন বাস চালানো শুরু করেছে সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থা। কোথাও কোথাও আবার কমপ্রেস্ড ন্যাচরাল গ্যাস বা সিএনজি চালিত যাত্রী পরিবহণের গাড়ি ব্যবহৃত হচ্ছে। এই প্রবণতা দেশের অন্যান্য শহরেও ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে।

ডিজ়েলের চাহিদা হ্রাসে ই-কমার্স সংস্থাগুলির অবদানও নেহাত কম নয়। খাবার বা পছন্দের পণ্য গ্রাহকের হাতে তুলে দিতে এত দিন অ্যামাজ়ন, ফ্লিপকার্ট বা জোম্যাটো, সুইগির মতো সংস্থা ডিজ়েল ইঞ্জিনের গাড়ি ব্যবহার করত। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলি বৈদ্যুতিন গাড়ি ব্যবহারের উপর জোর দিয়েছে।

দেশের একাধিক টু-টিয়ার ও থ্রি-টিয়ার শহরে বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে ই-রিকশা। অন্য দিকে ডিজ়েলের বদলে পেট্রল ইঞ্জিনের ব্যক্তিগত গাড়ির চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। দূষণ কমাতে রাজধানী দিল্লিতে ইতিমধ্যেই ১০ বছরের পুরনো ডিজ়েল ইঞ্জিনের গাড়ি নিষিদ্ধ করেছে সরকার। প্রশাসনের এই ধরনের সিদ্ধান্ত পেট্রলচালিত গাড়ির চাহিদা বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ।

পিপিএসির তথ্য অনুযায়ী, গত আর্থিক বছরে (পড়ুন ২০২৪-’২৫) পেট্রলের ব্যবহার ৭.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর বিক্রির পরিমাণ ছিল চার কোটি টন। একই সময়সীমার মধ্যে ৩ কোটি ১৩ লক্ষ ২০ হাজার টন এলপিজ়ি (লিকুইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস) বিক্রি করেছে তিনটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা। এই ক্ষেত্রে বিক্রি বৃদ্ধি পেয়েছে ৫.৬ শতাংশ।

২০২৪-’২৫ আর্থিক বছরে বিমানের জ্বালানির বিক্রি ন’শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৯০ লক্ষ টনে পৌঁছে গিয়েছে। কেন্দ্রের দাবি, ঘরোয়া এবং আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে দিন দিন বাড়ছে যাত্রীর সংখ্যা। বিমানের জ্বালানির বিক্রিতে তারই প্রতিফলন পড়েছে।

পেট্রোপণ্যের মধ্যে শিল্পে ব্যবহৃত ন্যাপথার চাহিদা ৪.৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। গত আর্থিক বছরে এর বিক্রির অঙ্ক ছিল ১৩১ কোটি ৫০ লক্ষ টন। একই অবস্থা জ্বালানি তেলেরও। এর ব্যবহার এক শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ফলে সেটি ৬৪ কোটি ৫০ লক্ষ টনে নেমে এসেছে।

গত আর্থিক বছরে কমেছে রাস্তা তৈরিতে ব্যবহৃত বিটুমিনের বিক্রি। কিন্তু, ঊর্ধ্বমুখী ছিল পেট্রোলিয়াম কোক, লুব্রিক্যান্ট এবং গ্রিজ়ের চাহিদা। ২০২৪ সালের ১ এপ্রিল থেকে এ বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত বিটুমিন বিক্রি হয়েছে ৮৩ কোটি ৩০ লক্ষ টন। এই পেট্রোপণ্যের বিক্রির সূচক ৫.৪ শতাংশ নিম্নমুখী হয়েছে।

পেট্রোলিয়াম কোক এবং লুব্রিক্যান্ট ও গ্রিজ়ের চাহিদা যথাক্রমে ৮.৬ শতাংশ এবং ১২.৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সামগ্রিক ভাবে দেশের পেট্রোপণ্যের ব্যবহার ২১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত আর্থিক বছরে পেট্রোপণ্যের মোট বিক্রির পরিমাণ ২৩ কোটি ৯১ লক্ষ ৭১ হাজার টনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।

২০২৩-’২৪ আর্থিক বছরে দেশে পেট্রোপণ্যের ব্যবহার পাঁচ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ঠিক তার আগের অর্থবর্ষে এটি ১০.৬ শতাংশ বেড়েছিল। ২০২১-’২২ আর্থিক বছরে বৃদ্ধির অঙ্ক ছিল ৩.৮ শতাংশ। পেট্রোপণ্যের চাহিদা হ্রাসের নেপথ্যে দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্টস বা জিডিপি) সূচক নামাকেও দায়ী করেছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা।

কোভিড অতিমারির দু’বছর (২০১৯-’২০ এবং ২০২০-’২১ অর্থবর্ষ) দেশ জুড়ে লকডাউন থাকায় পেট্রল ও ডিজ়েলের বিক্রি মারাত্মক ভাবে কমে গিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী বছরগুলিতে জ্বালানির ব্যবহার বাড়তে থাকে। কিন্তু, ২০২৪-’২৫ আর্থিক বছরে তেলের চাহিদা বৃদ্ধির অঙ্ক গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে শ্লথ হয়ে যায়, জানিয়েছে কেন্দ্র।

চলতি অর্থবর্ষে তেলের চাহিদা কতটা থাকবে, ইতিমধ্যেই তার পূর্বাভাস দিয়েছে পেট্রোলিয়াম মন্ত্রক। পিপিএসির দাবি, জ্বালানির মোট চাহিদা ৫.৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২৫ কোটি ৩০ লক্ষ টনে পৌঁছবে। ডিজ়েল ও পেট্রলের ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে যথাক্রমে তিন ও ৬.৫ শতাংশ।

২০২৫-’২৬ আর্থিক বছরে মোট ৯ কোটি ৪১ লক্ষ টন ডিজ়েল বিক্রির সম্ভাবনা রয়েছে। পেট্রলের চাহিদা থাকতে পারে ৪ কোটি ২৬ লক্ষ ৩০ হাজার টন। অর্থাৎ গত আর্থিক বছরের থেকে ডিজ়েলের ব্যবহার সামান্য বাড়বে বলেই মনে করছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার।
সব ছবি: সংগৃহীত।