পোশাকি নাম ‘টারডিগ্রেড’। তবে এক মিলিমিটারেরও কম দৈর্ঘ্যের আটপেয়ে প্রাণীগুলি বেশি পরিচিত ‘ওয়াটার বেয়ার’ বা ‘জলভালুক’ নামে। কেউ কেউ বলেন ‘শেওলা শূকরছানা’। মনে করা হয়, যত দিন না সূর্য মরছে, তত দিন বেঁচে থাকবে এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণী।
বিজ্ঞানীদের একাংশের মতে, জলভালুকেরা পৃথিবীর ‘সবচেয়ে অবিনশ্বর’ প্রাণী। ১৭৭৩ সালে জার্মান প্রাণীবিদ জোহান অগাস্ট এফ্রাইম গোয়েজ প্রথম জলভালুকদের বর্ণনা দিয়েছিলেন। তিনিই প্রথম আট পায়ের এই প্রাণীদের ‘জলভালুক’ বলে সম্বোধন করেছিলেন।
১৭৭৭ সালে ইটালীয় জীববিজ্ঞানী লাজারো স্প্যালানজিনি এই প্রাণীগুলির নাম দেন ‘টারডিগ্রেড’, যার অর্থ ‘ধীর গতির প্রাণী’।
‘অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি’ এবং ‘হার্ভার্ড-স্মিথসোনিয়ান সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোফিজিক্স’-এর নতুন গবেষণা অনুসারে বিশ্বের ‘সবচেয়ে অবিনশ্বর’ এই প্রজাতির স্থূল চেহারায় চার জোড়া পা রয়েছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, সূর্যের মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত বেঁচে থাকবে এরা।
আকার-আয়তনে ‘টারডিগ্রেড’ আণুবীক্ষণিক হলেও চরমতম পরিস্থিতিতেও তারা বেঁচে থাকতে পারে। জলে বসবাসকারী এই প্রাণীরা খাবার এবং জল ছাড়া ৩০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।
পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, ১৫০ ডিগ্রি থেকে মাইনাস ২৭২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রায় বেঁচে থাকতে পারে টারডিগ্রেডরা।
বেঁচে থাকতে পারে মহাশূন্যের একেবারে চাপশূন্য অবস্থা কিংবা পৃথিবীর গভীরতম সমুদ্রখাত ‘মারিয়ানা ট্রেঞ্চ’-এর ভয়ঙ্কর চাপেও। বহু বছর মৃতবৎ থেকে জল-বায়ু পেয়ে আবার বেঁচে উঠতে পারে এরা।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন সুপারনোভা এবং গামা রশ্মির বিস্ফোরণের মতো যে সব মহাজাগতিক বিপর্যয়ে মানবজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে, সে সব বাধাও অবলীলায় উতরে যেতে পারে টারডিগ্রেডরা।
বিজ্ঞানীদের ধারণা, টারডিগ্রেডকুল কমপক্ষে ১০০০ কোটি বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। অর্থাৎ, সূর্য যত ক্ষণ জ্বলতে থাকবে তত ক্ষণ পৃথিবীতে টারডিগ্রেডরা বেঁচে থাকতে পারে।
জলভালুকেরা আকারে সর্বাধিক ০.৫ মিলিমিটার পর্যন্ত হতে পারে।
এই প্রসঙ্গে, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিদ্যার বিভাগের অধ্যাপক আব্রাহাম লোয়েব বলেন, ‘‘বাসযোগ্য গ্রহ থেকে সব ধরনের প্রাণ একেবারে নির্মূল করা কঠিন।’’
লোয়েব আরও বলেন, ‘‘মঙ্গল গ্রহের ইতিহাস ইঙ্গিত দেয় যে, এখানে একসময় এমন বায়ুমণ্ডল ছিল যা চরম পরিস্থিতিতেও প্রাণ বাঁচিয়ে রাখতে পারত। টারডিগ্রেডও সে রকম এক প্রাণী যা চরম পরিস্থিতিতে বাঁচতে পারে।’’
জলভালুক কতটা চরম পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকতে পারে, তা বোঝার জন্য সেই প্রাণীকে চাঁদেও পাঠানো হয়েছিল।
২০১৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি চাঁদের উদ্দেশে রওনা হয়েছিল ইজ়রায়েলের মহাকাশযান ‘বেরেশিট’। সেই মহাকাশযানে চড়েই চাঁদে নামার কথা ছিল জলভালুকের। কিন্তু ১১ এপ্রিল যান্ত্রিক গোলযোগে চাঁদের মাটিতে ভেঙে পড়ে ‘বেরেশিট’।
ওই যানের বিশেষ প্রকোষ্ঠে জলভালুকরা ছিল। চাঁদের রুক্ষ জমিতে আছড়ে পড়ে ইজ়রায়েলি মহাকাশযান ভেঙেচুরে যাওয়ার সময়ে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ হয়েছিল। সেই ধাক্কা সামলাতে পারলে ধরে নেওয়া যায়, চাঁদের মাটিতে বেঁচেবর্তেই আছে পৃথিবী থেকে পাঠানো আট পায়ের জলভালুকেরা।
বিজ্ঞানীরা আশ্বাস দিয়েছেন, চাঁদের আবহাওয়া খুব বেশি অসহ্য না-হয়ে উঠলে জলভালুকেরা বেঁচেই থাকবে। কারণ, বিস্ফোরণ, তাপমাত্রা বা চাপের চরম হেরফেরও তাদের কাছে নস্যি।
ইজ়রায়েলি মহাকাশযানে কার্যত শীতঘুমে পাঠিয়ে ভরে দেওয়া হয়েছিল টারডিগ্রেডদের। চাঁদের বুকে আবার তারা জেগে উঠবে বা ইতিমধ্যেই জেগে উঠেছে বলে বিশ্বাস বিজ্ঞানীদের।
ছবি: সংগৃহীত।