সালটা ২০০৫। উত্তরপ্রদেশের বাগপত জেলার সানাউলি গ্রামের কৃষক শ্রীরাম শর্মা তাঁর নিত্যদিনের কাজ করছিলেন। বেলা বাড়তে কোদাল নিয়ে ক্ষেতে যান তিনি।
কোদাল দিয়ে ক্ষেতের মাটি কোপাতে কোপাতে হঠাৎ ঠং করে একটা আওয়াজ আসে শ্রীরামের কানে। একই জায়গায় আবার কোদালের কোপ মারতে আবার সেই একই আওয়াজ। কৌতূহলবশত ওই জায়গার খুঁড়তে শুরু করেন তিনি। প্রথমে তাঁর হাতে উঠে আসে একটি তামার পাত্র। আরও খানিকটা খুঁড়তে বার হয় একটা কঙ্কাল।
হতভম্ব হয়ে মাঠ থেকে চলে যান শ্রীরাম। যোগাযোগ করেন স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। শ্রীরাম তখনও জানতেন না তিনি কোন ইতিহাস খুঁড়ে বার করেছেন।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের সঙ্গেও কথা বলেন শ্রীরাম। শীঘ্রই সেখানে এসে পৌঁছয় ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ (আর্কিয়োলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া বা এএসআই)। শ্রীরামের তিন বিঘা জমি জুড়ে খননকাজ শুরু করে তারা।
প্রাথমিক ভাবে ১৩ মাস ধরে ওই জমি খুঁড়ে একটি রথ, কফিন, বিভিন্ন আকারের পাত্র, কঙ্কাল, তামার শিরস্ত্রাণ খুঁজে পায় এএসআই। তারা পরীক্ষা করে দেখে, ওই সব জিনিস প্রায় ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের। অর্থাৎ, প্রায় চার হাজার বছর আগের।
এএসআই-এর এক কর্তা জানিয়েছিলেন, ওই এলাকায় যে কাঠামোগুলি পাওয়া গিয়েছিল, সেগুলি কাঠের তৈরি।
মজার বিষয় হল, সিনৌলি থেকে উদ্ধার হওয়া বেশির ভাগ কাঠের বস্তুর উপরেই তামার পাত বা তারের আবরণ ছিল। যার কারণে প্রায় চার হাজারেরও বেশি সময় মাটির নীচে চাপা থাকা সত্ত্বেও সেই কাঠের জিনিসগুলির সে ভাবে ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
এএসআই জানিয়েছে, সিনৌলি থেকে প্রায় ১২৫টি সমাধি উদ্ধার হয়েছে। ‘কার্বন ডেটিং’ (কোনও জিনিস কত পুরনো, তা নির্ধারণ করার পরীক্ষা) করে এএসআই নিশ্চিত করেছে যে, সেগুলি প্রায় চার হাজার বছরের পুরনো।
পাশাপাশি, এএসআই-এর অনুমান, সিনৌলি থেকে তামার যে শিরস্ত্রাণ উদ্ধার হয়েছে, তা বিশ্বের প্রাচীনতম শিরস্ত্রাণ হতে পারে।
তবে সিনৌলির যে খোঁজকে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বলে মনে করেছে এএসআই, তা হল তিনটি রথের আবিষ্কার। এই আবিষ্কার ভারতে আর্যদের আগমন নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলেছে।
খুঁজে পাওয়া রথগুলির নকশা এবং আকার দেখে গবেষকদের অনুমান, সেগুলি ঘোড়ায় টানা রথ ছিল যা মেসোপটেমিয়া ও সুমেরীয় সংস্কৃতির সমসাময়িক।
অন্য দিকে, ইতিহাসবিদদের একাংশের মতে, ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে আর্যরা মধ্য এশিয়া থেকে ঘোড়া নিয়ে ভারতে এসেছিল।
এএসআই রথ ছাড়াও সিনৌলি থেকে একটি মশাল, একটি হাতলযুক্ত তরোয়াল, সুসজ্জিত সমাধিস্থল খুঁজে পেয়েছে। আশ্চর্যজনক ভাবে সেগুলি ভাল ভাবে সংরক্ষিত অবস্থায় ছিল।
সিনৌলি থেকে পাওয়া ধ্বংসাবশেষগুলির সঙ্গে হরপ্পা সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের মিল রয়েছে বলেও প্রত্নতাত্ত্বিকেরা জানিয়েছেন। তবে অমিলও রয়েছে।
সিনৌলি থেকে মূলত তামা উদ্ধার হয়েছে। অন্য দিকে, হরপ্পা সভ্যতা তামা পরবর্তী যুগের। সেই সভ্যতায় মূলত ব্রোঞ্জের ব্যবহার হত।
ইতিহাসবিদেরা মনে করছেন, সিনৌলি থেকে উদ্ধার হওয়া রথ ঘোড়ায় টানা ছিল। অন্য দিকে, হরপ্পা সভ্যতায় রথ টানত ষাঁড়।
সিনৌলিতে যে সংস্কৃতি ছিল, তা হরপ্পার সমসাময়িক হলেও হরপ্পার সঙ্গে তার কোনও যোগ ছিল না বলেই প্রত্নতাত্ত্বিকেরা মনে করছেন।
সিনৌলির খননকাজ পরিচালনার দায়িত্বে থাকা এএসআই কর্তা সঞ্জয়কুমার মঞ্জুল সংবাদমাধ্যম ‘আউটলুক’কে এক বার জানিয়েছিলেন, ২০০৫ সালে খননকাজ চলার সময় বিভিন্ন আকারের মাটির পাত্র আবিষ্কার হয়েছিল। এ ছাড়াও পুঁতি এবং অন্যান্য উপাদান উদ্ধার হয়েছিল, যা হরপ্পা সভ্যতায় ব্যবহার করা হত। তবে হরপ্পা সভ্যতায় এ রকম সুসজ্জিত সমাধিস্থল উদ্ধার হয়নি।
এএসআই আরও জানিয়েছিল, হরপ্পায় যে ইট ব্যবহার করা হত, তা সিনৌলি থেকে উদ্ধার হওয়া ইটগুলির চেয়ে ছোট।
এর পরে ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে আরও সূক্ষ্ম ভাবে খননকাজ চালায় এএসআই। সনৌলি সম্পর্কে আরও বেশ কিছু কৌতূহলী তত্ত্ব এবং আবিষ্কার উঠে আসে।
২০১৮ সালের খননকাজ চলার সময় এএসআই সনৌলি থেকে যে জিনিসপত্রগুলি আবিষ্কার করেছিল, সেগুলি সনৌলির সংস্কৃতি সম্পর্কে আরও স্বচ্ছ ধারণা তৈরি করে। ওই জিনিসগুলির মধ্যে ছিল একটি ময়ূরের প্রতিকৃতি থাকা শিং দিয়ে তৈরি চিরুনি, তামার আয়না, পুঁতি দিয়ে তৈরি হাতের বালা, ফুলদানি এবং বাটি। এমন আটটি সমাধিস্থলের খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল যা রাজকীয় ভাবে সাজানো ছিল। এ ছাড়াও উদ্ধার করা হয় একাধিক তামার বর্ম।
সমাধিগুলি আরও ইঙ্গিত দেয় যে, সিনৌলিতে যে সভ্যতার খোঁজ পাওয়া গিয়েছে সেখানে যুদ্ধের প্রচলন ছিল। পুরুষ এবং মহিলা উভয়ের কঙ্কালের পাশেই উদ্ধার হওয়া তরোয়াল তার প্রমাণ বলেও মনে করছেন ইতিহাসবিদেরা।
বলাই বাহুল্য, এই শতাব্দীর অন্যতম বড় আবিষ্কার হিসাবে সনৌলি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
টেলিভিশন চ্যানেল ‘ডিসকভারি প্লাস’ সম্প্রতি ‘সিক্রেটস অফ সনৌলি — ডিসকভারি অফ দ্য সেঞ্চুরি’ নামে একটি ৫৫ মিনিটের তথ্যচিত্র তৈরি করেছে। যা পরিচালনা করেছেন নীরজ পাণ্ডে। তথ্যচিত্রে সূত্রধরের কাজ করেছেন অভিনেতা মনোজ বাজপেয়ী।