মুখ গম্ভীর, চোখে চশমা, পরনে বাংলাদেশি সেনার উর্দি। সোমবার দুপুরে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পরেই জনতার সমক্ষে আসেন মাঝবয়সি দোহারা চেহারার ব্যক্তি। তিনি বাংলাদেশের সেনাপ্রধান। নাম ওয়াকার-উজ-জামান। বয়স ৫৭। হাসিনা বাংলাদেশের আকাশসীমা অতিক্রম করার কিছু পরেই জাতির উদ্দেশে ভাষণ শুরু করেন তিনি। অনেকে আবার মনে করেছেন হাসিনার পদত্যাগে অনুঘটক হিসাবে হাত রয়েছে ওয়াকারেরই।
বাংলাদেশে সেনার অধীনে অন্তর্বর্তী তদারকি সরকার গঠনের কথা জানিয়েছেন ওয়াকার। বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশে তাঁর আবেদন— ‘‘আন্দোলন বন্ধ করুন’’। পুলিশ এবং সেনাকে গুলি চালাতে বারণ করেছেন বলেও জানিয়েছেন তিনি। দু’দিনের মধ্যে সর্বদল বৈঠক করার কথাও জানিয়েছেন।
এর পর থেকেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে কে এই সেনাপ্রধান, যাঁর হাত ধরে আবার বাংলাদেশে ক্ষমতার ভরকেন্দ্র হয়ে উঠল সেনাবাহিনী।
বাংলাদেশের বর্তমান সেনাপ্রধান তথা সে দেশের সেনাবাহিনীর জেনারেল ওয়াকারের জন্ম বাংলাদেশের শেরপুরে। ১৯৬৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর জন্ম তাঁর।
মিরপুরের ‘ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ’ কলেজ থেকে স্নাতক হওয়ার পর ব্রিটেনের ‘জয়েন্ট সার্ভিসেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ’ কলেজ থেকে পড়াশোনা করেন ওয়াকার। প্রতিরক্ষা বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন লন্ডনের কিংস কলেজ থেকে।
বাংলাদেশের সেনাপ্রধান পদে খুব বেশি দিন হল বসেননি ওয়াকার। ২০২৪ সালের ২৩ জুন থেকে আগামী তিন বছরের জন্য সেনাপ্রধান হিসাবে নিয়োগ করা হয় তাঁকে।
বাংলাদেশের সেনাপ্রধান হিসাবে নিযুক্ত হওয়ার আগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ‘চিফ অফ জেনারেল স্টাফ (সিজিএস)’ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন ওয়াকার।
১৯৮৫ সালের ২০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন ওয়াকার।
দীর্ঘ ৩৯ বছরের সামরিক জীবনে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসেছেন ওয়াকার। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম ‘প্রথম আলো’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের সেনাপ্রধান এবং সিজিএস পদ ছাড়াও নবম পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি), সাভার ক্যান্টনমেন্টের এরিয়া কমান্ডার এবং সেনাসদরে সামরিক সচিব হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নিরাপত্তাবাহিনীর ‘প্রিন্সিপাল স্টাফ’ অফিসার হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন ওয়াকার।
‘প্রথম আলো’র প্রতিবেদন বলছে, ঢাকার সাভার ক্যান্টনমেন্টের এরিয়া কমান্ডার এবং নবম পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) হিসাবে ওয়াকার, ২০১৪ থেকে ২০১৬— টানা তিন বছর বিজয় দিবসের প্যারেড কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। বিরল এই কৃতিত্বের জন্য ‘সেনাগৌরব পদক’ (এসজিপি)-ও পান।
বাংলাদেশি সেনার সদর দফতরেরও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ছিলেন ওয়াকার। ১৭ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডারও ছিলেন। ঢাকায় ৪৬তম স্বতন্ত্র পদাতিক ব্রিগেডের নেতৃত্ব দেন। ২০১৩ এবং ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সেনা সদর দফতরে সামরিক সচিব হিসাবে নিযুক্ত হন।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল ওয়াকার রাষ্ট্রপুঞ্জের হয়ে সেনা পর্যবেক্ষক হিসাবে অ্যাঙ্গোলা এবং সিনিয়র অপারেশন অফিসার হিসাবে লাইবেরিয়াতে দায়িত্ব পালন করেন।
দেশ-বিদেশের বহু নামী সেনা স্কুলে প্রশিক্ষণও দিয়েছেন ওয়াকার।
ওয়াকারের স্ত্রীর নাম বেগম সারাহনাজ কমলিকা। দম্পতির দুই কন্যা— রাইসা জামান এবং শায়রা ইবনাত জামান। ওয়াকারের শ্বশুর তথা অধুনাপ্রয়াত মুস্তাফিজুর রহমানও ১৯৯৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর থেকে ২০০০ সালের ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত সেনাপ্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
জনরোষের জেরে হাসিনার ইস্তফা এবং দেশত্যাগের পর ওয়াকারের ‘পরবর্তী পদক্ষেপ’ নিয়ে জল্পনা তৈরি হয়েছে।
জেনারেল জামান সোমবার দুপুরে জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে হাসিনার ইস্তফার কথা জানিয়ে বলেছেন, ‘‘আমরা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে আলোচনার মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করব।’’ জাতির উদ্দেশে ভাষণের আগে তিনি সব দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন জানিয়ে জেনারেল জামানের দাবি, ‘‘সুন্দর পরিবেশে আলোচনা হয়েছে।’’ সেই সঙ্গে বাংলাদেশে আন্দোলনকারী পড়ুয়া এবং রাজনৈতিক কর্মীদের বিরত থাকার আবেদন জানিয়ে সেনাপ্রধানের আশ্বাস, ‘‘আমি কথা দিচ্ছি, প্রতিটি হত্যার বিচার হবে।’’
হাসিনার ইস্তফার দাবিতে দেশ জুড়ে বিক্ষোভ এবং হিংসার মধ্যেই রবিবার গভীর রাতে জেনারেল জানান সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্তাদের সঙ্গে ঢাকায় তাঁর বাসভবনে বৈঠক করেছিলেন। তার পরেই জল্পনা তৈরি হয়, এ বার সরাসরি পরিস্থিতির উপর হস্তক্ষেপ করতে চলেছে সেনা। সূত্রের খবর, হাসিনা ইস্তফা দিয়ে তদারকি সরকারের ভার দিয়েছেন জাতীয় সংসদের (পার্লামেন্ট) স্পিকার শিরিন সারমিন চৌধুরির হাতে। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেত্রী শিরিনকে সেনা মানবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। ঘটনাচক্রে, রাষ্ট্রপতি মহম্মদ শাহাবুদ্দিনও আওয়ামী লীগের প্রাক্তন নেতা এবং ‘হাসিনা-ঘনিষ্ঠ’ হিসাবেই পরিচিত।
সব ছবি: সংগৃহীত।