
আমেরিকার প্রথম সারির শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হার্ভার্ডের ২০০ কোটি ডলারেরও বেশি (ভারতীয় মুদ্রায় ১৭ হাজার কোটিরও বেশি) আর্থিক অনুদান বন্ধের কথা আগেই ঘোষণা করেছিল প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরকার। এ বার বিদেশি পড়ুয়াদের ভর্তি বন্ধেরও হুমকি দিল ট্রাম্প প্রশাসন।

একই সঙ্গে এত দিন যে বিশেষ করছাড় পেত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, তা-ও বন্ধ করা হতে পারে বলেও সমাজমাধ্যমে জানালেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। অর্থাৎ কর চাপতে পারে বিশ্বের অন্যতম বৈগ্রাহিক ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর।

কিন্তু কেন ট্রাম্প প্রশাসনের কোপে পড়ল বিশ্বের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়টি? হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস রাজ্যের কেমব্রিজে অবস্থিত একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। ১৬৩৬ সালের ২৮ অক্টোবর প্রতিষ্ঠা হয় হার্ভার্ডের।

ধর্মযাজক জন হার্ভার্ডের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয়। এটি আমেরিকার প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়ও বটে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণার কাজে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে হার্ভার্ডের। বিশ্বের বহু নোবেল প্রাপক গবেষণা করেছেন হার্ভার্ড থেকে। শিক্ষার মান, সুনাম এবং প্রভাবের কারণে বিশ্বের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়েরও তকমা পেয়েছে হার্ভার্ড।

বর্তমানে হার্ভা়র্ডে স্নাতক, স্নাতকোত্তর এবং গবেষক মিলিয়ে পড়ুয়ার সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। অধ্যাপক এবং শিক্ষাকর্মীর সংখ্যাও হাজার হাজার। প্রায় সাড়ে তিন কোটি পড়ুয়া বর্তমানে হার্ভার্ডের বিভিন্ন অনলাইন কোর্স থেকে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। এ যাবৎ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বেরিয়েছেন চার লক্ষের বেশি পড়ুয়া।

চিকিৎসা, ব্যবসা, বিজ্ঞান, আইন, সমাজকল্যাণ-সহ বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার কাজ চলে হার্ভার্ডে। সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই এ বার ট্রাম্প প্রশাসনের কোপে। পশ্চিম এশিয়ায় হামাস-ইজ়রায়েল যুদ্ধের আবহে আমেরিকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্যালেস্টাইনের সমর্থনে বিক্ষোভ দেখানো হয়েছে। বিষয়টি মোটেই ভাল চোখে দেখেনি ট্রাম্প সরকার।

সরকার দাবি করে, দিনে দিনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি রাজনীতির আখড়া হয়ে উঠছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ইহুদি-বিদ্বেষের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলেও অভিযোগ তোলে ট্রাম্প প্রশাসন।

বন্ধু ইজ়রায়েলের পাশে দাঁড়িয়ে ট্রাম্প সরকারের অভিযোগ ছিল, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ইহুদি বিদ্বেষীদের সংখ্যা বাড়ছে। একই সঙ্গে সরকার এ-ও অভিযোগ করে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সঠিক পদক্ষেপ করছেন না।

ফলস্বরূপ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ক্যাম্পাসে ইহুদি-বিদ্বেষ বন্ধ করার জন্য কী কী করণীয়, সে বিষয়ে কিছু নির্দেশিকা দেওয়া হয়েছিল সরকারের তরফে। স্পষ্ট করা হয় যে, শর্ত না-মানলে বিশ্ববিদ্যালয়কে আর্থিক সাহায্য দেওয়া বন্ধ করা হবে।

এরই মধ্যে চলতি সপ্তাহের সোমবার বিকেলে (স্থানীয় সময় অনুসারে) প্রথম মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে আমেরিকার সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়।

কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো কিছু প্রতিষ্ঠান সমস্ত শর্ত মেনে নিলেও হার্ভার্ড তাতে পুরোপুরি সম্মত হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানান, মার্কিন প্রশাসনের দাবি শিক্ষাঙ্গনের স্বাধীনতা এবং সাংবিধানিক অধিকারের পরিপন্থী।

ট্রাম্প প্রশাসনের নয়া শর্তাবলির বিরোধিতা করে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট অ্যালেন এম গার্বার জানান, ওই শর্তগুলি মানলে শিক্ষাব্যবস্থা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতার সঙ্গে আপস করা হবে।

ওই শর্তগুলি সাংবিধানিক অধিকারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলেও দাবি করেন অ্যালেন। এক বিবৃতিতে অ্যালেন লেখেন, “বিশ্ববিদ্যালয় নিজের স্বাধীনতাকে সঁপে দেবে না বা নিজের সাংবিধানিক অধিকারকেও ত্যাগ করবে না।”

ট্রাম্পের প্রশাসন হার্ভার্ডকে সর্বশেষ যে শর্তাবলি পাঠিয়েছিল, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া এবং অধ্যাপকদের দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে বলা হয়েছিল। একটি নির্দিষ্ট মতাদর্শে বিশ্বাসীদের প্রভাব যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর থেকে কমে, সে বিষয়েও পদক্ষেপ করতে বলা হয়।

শর্তাবলির মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ এবং পাঠ্যক্রমের ক্ষেত্রেও সরকারি ভাবনাকে গ্রহণ করতে বলা হয়েছে বলে অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। এই শর্তগুলির মাধ্যমে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কী পড়াবে, কাকে ভর্তি করবে, কাকে নিয়োগ করবে, তাঁরা কী বিষয়ে পড়বেন বা গবেষণা করবেন— সেগুলির উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ করেন অ্যালেন।

এই শর্তগুলি ট্রাম্প প্রশাসনের এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে না বলেও দাবি করে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানান, ইহুদি বিদ্বেষ রুখতে তাঁরা বেশ কিছু পদক্ষেপ করেছেন।

ট্রাম্প প্রশাসনের দাবির কাছে মাথা নত না-করার কারণে কোপের মুখে পড়ে অভিজাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। হার্ভার্ডের সিদ্ধান্তের পরেই তাদের উপর ‘শাস্তির খাঁড়া’ নামে। হার্ভার্ডকে ২২০ কোটি ডলারের সহায়তা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয় মার্কিন প্রশাসন।

সংবাদমাধ্যম ‘নিউ ইয়র্ক টাইম্স’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই ২২০ কোটি ডলারের সাহায্য বন্ধের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ৬ কোটি ডলারের একটি চুক্তিও স্থগিত রাখা হয়েছে। কয়েক জন বিজ্ঞানী এবং গবেষককেও ইতিমধ্যে গবেষণা বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আরও বেশ কিছু গবেষণা ও প্রকল্পের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে চলে গিয়েছে বলে খবর।

অন্য দিকে, আমেরিকার স্বরাষ্ট্র দফতরের সচিব ক্রিস্টি নোয়েম বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে বলেন, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কিছু বেআইনি এবং জঙ্গি কার্যকলাপ হচ্ছে। তাই কর্তৃপক্ষের কাছে বিদেশি পডু়য়াদের ভিসা সংক্রান্ত এবং আরও কিছু তথ্য চেয়ে পাঠিয়েছেন তিনি।

নোয়েম এ-ও হুঁশিয়ারি দেন যে, হার্ভার্ড যদি শর্ত পূরণ করতে না-পারে, তবে ওই বিশ্ববিদ্যালয় আগামী দিনে বিদেশি পড়ুয়াদের ভর্তি নিতে পারবে না। পাশাপাশি, দু’টি বহুমূল্য ইকুইটি অনুদান বন্ধের কথাও জানিয়ে দেওয়া হয়।

পাশাপাশি, বৃহস্পতিবার নিজস্ব সমাজমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জানিয়েছেন, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় এত দিন যে বিশেষ করছাড় পেত, তা বন্ধ করা হতে পারে। উল্লেখ্য, আমেরিকায় জনস্বার্থে কাজ করা বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে ওই করছাড়ের সুবিধা দেওয়া হয়।

সে প্রসঙ্গে সমাজমাধ্যমে ট্রাম্প লেখেন, ‘‘জনস্বার্থে কাজ করলে তবেই কর ছাড় মেলে। হার্ভার্ডে যে ভাবে জঙ্গি অনুপ্রাণিত হয়ে রাজনৈতিক কার্যকলাপ চলছে, তাতে হার্ভার্ডকে রাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে কর দিতে হবে।’’ বিশ্ববিদ্যালয়টি ‘হাস্যকর এবং বামপন্থীদের আখড়া’ বলেও মন্তব্য করেন ট্রাম্প।

হার্ভার্ডের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, তাঁরা চিঠি পেয়েছেন। এ বিষয়ে আইন মেনেই পদক্ষেপ করবে হার্ভার্ড। তবে তাঁরা আগের অবস্থানেই অনড়। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা বিসর্জন দেবেন না তাঁরা।

একই সঙ্গে হার্ভার্ডের তরফে জানানো হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুদান বন্ধ করে আদতে মানবসভ্যতার ক্ষতি করবে ট্রাম্প সরকার। অনুদান বন্ধ হলে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার কাজ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

হার্ভার্ডের প্রাক্তনীরাও আমেরিকার সরকারের ওই সিদ্ধান্তের নিন্দা করেছেন। এর মধ্যে রয়েছেন নোবেল প্রাপকেরাও। উল্লেখ্য, এর আগে আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমলেও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে প্যালেস্টাইনের সমর্থন এবং ইজ়রায়েলের বিরোধিতা করে বিক্ষোভ দেখানো হয়েছিল। বিক্ষোভ শান্ত করতে পদক্ষেপ করে প্রশাসন। কিন্তু অনুদান বন্ধ করা হয়নি।
সব ছবি: সংগৃহীত।