সম্মেলন: অ্যাকাডেমিতে সোসাইটি অব কনটেম্পোরারি আর্টিস্টস দলের বার্ষিক প্রদর্শনী নিল্পকর্ম।
শিল্প-সাহিত্য ও চলচ্চিত্র মানবিক মূল্যবোধের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে চলে। সময়কাল চিহ্নিত হয় শিল্পীর রচনায়, যা এক একটি যুগের স্বাক্ষরিত দর্পণ। আমরা সদ্য পেরিয়েছি এক দমবন্ধ অবস্থা। গোটা বিশ্বকে নিমেষে পাল্টে দিয়েছে কোভিডের মতো অতিমারি। স্বভাবতই এই অবরুদ্ধ পরিস্থিতির ছাপ পড়েছে বোধসম্পন্ন শিল্পীমানসে। নির্মিত হয় আর একটি যুগের ইতিহাস।
সম্প্রতি সে রকমই দৃষ্টান্তের দলিল নিয়ে উপস্থিত হলেন সোসাইটি অব কনটেম্পোরারি আর্টিস্টস। অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের তিনটি গ্যালারি জুড়ে উদ্যাপিত হল ৬৫তম বার্ষিক প্রদর্শনী। সৃষ্টির সুনামে কয়েকজন ইতিমধ্যেই শীর্ষস্থানীয়। যেমন বর্ষীয়ান শিল্পী গণেশ হালুই। জলরঙের চিত্রপটে স্বাক্ষরের উপরে লেখেন কবির লাইন, ‘জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে, বন্ধু হে আমার, রয়েছ দাঁড়ায়ে’। গভীর প্রত্যয়ের চিহ্ন শোভিত হয় বিন্দু ও সাঙ্কেতিক রেখায়। বস্তুত বিমূর্ত দর্শনের চাবিকাঠি যেন তাঁর মুঠোয় ধরা। স্বনামধন্য শিল্পী লালুপ্রসাদ সাউয়ের কন্টির বিশিষ্ট প্রতিকৃতির ভঙ্গি বরাবরের মতোই বেশ লাগে।
শিল্পী আদিত্য বসাকের কাজের নাম ছিল ‘কসমিক সার্কাস’। শিল্পীর মতে, ‘‘আমরা আসলে একটা কসমিকের মধ্যে রয়েছি, যার সম্পর্কে ধারণা খুব বেশি নেই। শুধু অনুভব করতে পারি। মহাজাগতিক সে সব সঙ্কেত বার্তা আসে টেলিস্কোপের মাধ্যমে।’’ সেই জায়গা থেকে শিল্পীর বেসিক প্রয়োগ ডার্ক। ছোটবেলায় শোনা বিশ্বযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ ও নকশাল পিরিয়ডের রেশ নিয়ে আচ্ছাদিত ছবির প্রেক্ষাপট। তবুও এ অন্ধকার নিরেট নয়। মানুষের কিছু সুকৃতি থেকেই যায়। তাই আলোর স্ফুলিঙ্গ হাতছানি দেয়। লাল, নীল, হলুদের মায়ায় প্রজ্জ্বলিত হয় জীবনের আশা।
শিল্পী প্রদীপ মৈত্রর অভিজ্ঞ বিশ্লেষণে জলরঙের চলতি ব্যবহার ধাক্কা খায়। পেপার-হোয়াইট ছেড়ে নিপুণ দক্ষতার এক একটি ডিটেলিং অকল্পনীয়। শিল্পীর ‘ডিজেনারেশন’ লকডাউনের উদ্বেগজনিত দর্পণ। লাইব্রেরির কোণে রাখা স্তূপাকৃতির স্পর্ধিত ঘোষণা। শিক্ষাব্যবস্থার পতনের সাথে বিলুপ্ত হতে থাকে ঐতিহাসিক ঝাড়বাতি, মহাকাব্য, চলন্তিকা, লণ্ঠনের মতো শৈশবের কিছু স্মৃতি। উল্লম্ব কাগজে জলরঙের অন্যতম শ্রেষ্ঠত্বে উঠে আসে বাস্তবের প্রতীকীকরণ। বিশিষ্ট শিল্পী অতীন বসাকের ছাপচিত্র ‘টারবুলেন্স’ (পেন্টেড ইন্টাগ্লিয়ো) বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ার মিশ্র অভিব্যক্তি। কাগজ কেটে কেটে কোলোগ্রাফ। ইয়েলোর সঙ্গে ব্যালান্স করে কখনও টেম্পারা বা অ্যাক্রিলিকে করা। ব্রেনের শিরা-উপশিরায় ক্ষতের গ্রাস বুঝিয়ে দেয় চলমান ক্রাইসিস। ‘অনামা’ পরিবেশনে শ্রীকান্ত পালের মিশ্র মাধ্যমে উল্লিখিত কাজটি ডাইসেকশনের স্মার্ট উপস্থাপন।
শিল্পী নিরঞ্জন প্রধানের ব্রোঞ্জের ‘বুদ্ধ’ সার্থক একটি কাজ। সুবিদিত ভাস্কর বিমল কুণ্ডুর কাজের মাধ্যম ছিল উড ফাইবার, কার্ডবোর্ড, লেদার। শিরোনাম, ‘ব্যাড টাইম’। উত্তর কলকাতায় বসতবাড়ির সুবাদে শিল্পীর দরদি দৃষ্টিতে সংগৃহীত হয় প্রাচীন সামগ্রী। আসল সারটুকু কব্জা করে প্রোমোটারের দল। তবুও ৩০০ বছরের শাল কাঠের কড়ি-বরগায় যে টেক্সচার পাওয়া যায়, তার মজাই আলাদা। প্রদর্শিত একটি নমুনায় ছিল তার যথোপযুক্ত আপ্যায়ন। কাঠের চেয়ারে উপবিষ্ট ফাইবারের বাস্তুসাপ। অখিল চন্দ্র দাসের ব্রোঞ্জ-নির্মিত ‘গোট’ কাজটি সরল জীবনের প্রতীক। এক্সপ্রেশন ধরার জন্য কখনও মাথা বড়, গান মেটালের সঙ্গে কপার মিশিয়ে কাস্টিং বার করা। তারপর পরিষ্কার পদ্ধতি। অত্যন্ত পরিশ্রমের কাজ। এ ছাড়া করোনার সময়ে ব্যাঙের গতিবিধির পরিবর্তন শিল্পীকে ভাবিয়েছিল। সামান্য জীবও যে অতিমারির কবল থেকে রেহাই পায়নি, তারই চূড়ান্ত উদাহরণ ছিল ব্রোঞ্জের ‘ফ্যামিলি’ কাজটিতে।
‘ইন্ট্রোস্পেকশন’ বা আত্মদর্শন পরিশোধনে ফ্যান্টাসির ভাষা বেছে নেন রাজেন মণ্ডল। ফ্রেশ জল দিয়ে নোংরা পাইপ ধোয়ার মতই, প্রত্যেক দিনের স্বীকারোক্তিতে ধৌত হয় জীবনের গ্লানি। পশ্চাৎপটে জল বা আকাশের পূর্বাভাসে বয়ে চলে সাদা-কালোর এচিং প্রক্রিয়া। বরিষ্ঠ চিত্রকর মনোজ মিত্রের মিশ্র মাধ্যমের ধূসর ছায়ায় ‘আনটাইটলড’ কাজটি যথার্থ প্রতিবেদন। শিল্পী মানু পারেখের ‘ফ্লায়িং ফ্লাওয়ার্স’ বিমূর্ত কল্পের ভাবনায় পর্যবসিত। ডেভিড মালাকারের মিশ্র মাধ্যমও নজরে পড়ে।
শিল্পী অতনু ভট্টাচার্যের বিমূর্ত কাজগুলিতে গভীর আবেগ ছড়িয়ে পড়ে। সিরিজ়টির নাম ‘ব্লাইন্ড সেন্স’ দেওয়ার কারণ সব কিছু মিলেমিশে এর এক অন্ধ অনুভব। চার-পাঁচ ফুটের টানাপড়েনে একটি সংশয় চলতেই থাকে। স্তরের পর স্তর অতিক্রম করে আচমকাই একটি শেপ নেয়। গাঢ় অন্ধকার ভেদ করে উঁকি দেয় নিজস্ব আলোর পথ। অতনু ভট্টাচার্য আশাবাদী শিল্পী। সম্পূর্ণ বিমূর্ত কাজটির রঙের বুননে ছিল ক্যামেলের গুঁড়ো রং। সঙ্গে গাম একাসিয়ার মিশ্রণ।
জলছবির আর এক পারদর্শী শিল্পী ভোলানাথ রুদ্র। ছবির নাম ‘হিচ’। বাদামি বর্ণের ঢালাই করা শূন্যে কল্পবিজ্ঞানের দড়ির গ্রন্থি। মন্দ নয় পঙ্কজ পানোয়ারের ফাইবার গ্লাসের নির্মাণ। সৌমেন খামুরাইয়ের ‘ম্যাজিক মেড বাই মেলডি’ কোভিড পরিস্থিতির আনুভূমিক এক উপলব্ধি, যা রাতের জ়েব্রা ক্রসিং, ইলিউশনের মতো কম্পোজ়িশনে উঠে আসে।
‘মহাত্মা ভার্সাস গান্ধী’ ১৩২ ইঞ্চির সেরামিকের এক আশ্চর্য জাদু। স্রষ্টা আশিস চৌধুরী। ঠাসা বইয়ের লাইব্রেরির কনসেপ্ট বলে দেয়, শুধুই গান্ধীকে নিয়ে আর্কাইভ— ত্যাগের মহিমায় ব্যারিস্টার গান্ধী থেকে জাতির জনক গান্ধী। দূরত্ব বজায় রেখে, নানা পার্সপেক্টিভে দৃশ্যায়িত হয় দুই গান্ধীর রৈখিক ব্যক্তিত্ব। সমস্তটাই সেরামিকের উপরে পেন্টিংয়ের মাধ্যমে করা। ইনস্টলেশন প্রসেসটিই ছিল বিস্ময়ের একটি আকর।
সব মিলিয়ে প্রদর্শনীটি বুঝিয়ে দেয়, নতুন পুরনো মিলিয়ে আজও জ্বলজ্বল করে চলেছে এই শিল্পীদল, স্বমহিমায়।