বহুরূপে: দেবভাষা প্রদর্শশালায় চিত্রলেখা আয়োজিত প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।
শিল্পকলার জগতে নারীদেহের মূর্ত ও বিমূর্ত উপস্থাপন সেই আদিকাল থেকে। প্রাগৈতিহাসিক যুগের পাথরের ক্ষুদ্রকায়া মূর্তি ‘দ্য ভিনাস অব উইলেনডর্ফ’ মাতৃত্বের প্রতীক রূপে আজ বিশ্ববন্দিত। সুতরাং সেই সময় থেকে নারীর কোমল, নমনীয়, পেলব অথবা ভয়ঙ্কর, রুদ্রাগ্নি রূপের নানাবিধ প্রকাশ শিল্পকলা ও সাহিত্যের জগতে এক বিশেষ প্রতিপাদ্য। এ চর্চা শুধু আমাদের দেশের সনাতনী ও সমকালীন শিল্পকলার মধ্যেই সীমিত নয়, পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র তা বহু আকারে বিদ্যমান। এহেন নারী অবয়বের বিভিন্ন রূপের ডালি নিয়ে সম্প্রতি পরিবেশিত হল ‘উয়োম্যান’ নামের এক তাৎপর্যপূর্ণ প্রদর্শনী, দেবভাষা প্রদর্শশালায়। প্রদর্শনীটির আয়োজনে ‘চিত্রলেখা চ্যারিটেবল ট্রাস্ট’ এবং সব ছবিগুলি দেবভাষা: বই ও শিল্পের আবাস থেকে সংগৃহীত।
নারীরূপের উপস্থাপনা মাত্রই এক ছন্দোময়তা, কাব্য ও রহস্যের অনুভূতি জোগায়। যেমন ‘বনলতা সেন’-এর রূপের রহস্য আজও বাঙালির মননে জাগ্রত। অথবা সুবিখ্যাত ‘মোনালিসা’র স্মিত হাসির মধ্যে পৃথিবীব্যাপী দর্শক আজও খুঁজে বেড়ান তার যথার্থ মর্ম। তেমনই, রাজপুত মিনিয়েচারে কিষাণগড় শৈলীতে আঁকা ‘বানি থানি’র আদর্শবাদী, অপরূপ প্রতিকৃতিটি যেন ছান্দিক কাব্যের এক নির্ঝর সৃষ্টি। ফলত দেখা যায়, নারীর বহুমাত্রিক রূপ যুগে যুগে শিল্পী, কবি, সাহিত্যিকদের কাছে অনুপ্রেরণার প্রতীকস্বরূপ।
সম্প্রতি প্রদর্শিত এই প্রদর্শনীতে তেমনই কয়েকজন প্রথিতযশা শিল্পীর মননে ‘নারী’ বিষয়ক বেশ কিছু কাজ আমরা দেখতে পাই। যেমন অনিতা রায়চৌধুরীর দু’টি কালি-তুলি ও চারকোলের ড্রয়িংয়ে বিশ্রামরতা নারীর শায়িত ও বসে থাকার রূপ খুব অনায়াসে তাঁর বলিষ্ঠ রেখার বাঁধুনিতে প্রকাশ পেয়েছে। তেমনই সনৎ করের ‘সতী’ নামাঙ্কিত এক এচিং প্রিন্টে নারীর এক বিমূর্ত রূপকল্প ফুটে উঠেছে। আয়ত চক্ষুকে প্রাধান্য দিয়ে এই নারীমূর্তি কোনও বাস্তবানুগ উপস্থাপন নয়, বরঞ্চ শিল্পীর অনুভূতির এক উৎকৃষ্ট রূপায়ণ। অন্য দিকে, হরেন দাসের মেজ়োটিন্ট মাধ্যমে করা দুই নারীর জানালা দিয়ে বাইরের সমুদ্রসৈকত দেখার যে আলো-আঁধারির কম্পোজ়িশন, তা যেন উন্মুক্ত প্রকৃতির প্রতি নারীর মুক্তির জন্য এক আস্বাদ সৃষ্টি করে।
শিল্পী রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর নিজস্ব আঙ্গিকে রঙিন এক প্রসাধনরতা নায়িকা, হাতে তোতাপাখি-সহ, খুব অলঙ্কৃত ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। নারীদের যে আভূষণে অলঙ্কৃত হওয়ার সহজাত রুচি, সেটি এই ছবির মধ্যে স্পষ্ট ভাবে দেখা যায়। অন্য কাজটিতে কথোপকথনরত সখীসম দুই নারী, শিল্পীর পেলব-সুডৌল রেখার মাধ্যমে সুন্দর ভাবে প্রকাশ পেয়েছে। প্রদর্শনীতে যোগেন চৌধুরীর ছোট আকারের তিনটি নারী-প্রতিকৃতি খুবই লক্ষণীয়। মূলত চারকোল, কন্টি, প্যাস্টেল দিয়ে কাগজে করা তিনটি কাজের মধ্যে এক বৃদ্ধার অবয়ব বিশেষ ভাবে নজর কাড়ে। সাদা চুল, পাড়হীন সাদা শাড়ি পরিহিতা এই প্রৌঢ়ার রং ও রেখার বুনট বিশেষ ভাবে আকর্ষক। আবার হলুদ প্যাস্টেল ঘষা প্রেক্ষাপটে নারীর নায়িকাসুলভ উপস্থাপন, যৌবনের উচ্ছলতায় যেন ভরপুর!
প্রত্যেক শিল্পীর দেখার, অনুভবের ও উপস্থাপনের ভাষা ও আঙ্গিক যে আলাদা, তার পরিচয় পাওয়া যায় সোমনাথ হোর ও রেবা হোরের কাজগুলির মধ্য দিয়ে। সোমনাথ হোর তাঁর এচিং ও কালি-তুলির ড্রয়িংয়ের মধ্য দিয়ে তাঁর চিরাচরিত কাঠামোগত সংযুক্তি যেমন প্রকাশ করেছেন, তেমনই রেবা হোর তাঁর রঙিন ক্রেয়ন ড্রয়িংয়ের সাবলীল রেখার জালে তুলে ধরেছেন কখনও কোনও শায়িতা যুবতী, অথবা কেশবিন্যাসরতা দুই নারী। শুধু একটি কাজে, উজ্জ্বল গুঁড়ো রঙের ইমপ্যাস্টো ব্যবহারে এক নারীমুখের অস্পষ্ট অবয়ব নজর কাড়ে। এ ক্ষেত্রে শিল্পী দম্পতি হিসাবে দু’জনের বিষয়গত সাম্য থাকলেও, মাধ্যম বর্ণন ও উপস্থাপনের অভিব্যক্তি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।
প্রদর্শকক্ষে লালুপ্রসাদ সাউয়ের দু’টি কন্টির কাজ বিশেষ ভাবে আকর্ষক। ‘দম্পতি’ নামক কাজটিতে এক নারী ও পুরুষ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে, দেখা যায়। ছবিটিতে রেখার খেলা বিশেষ ভাবে নজর কাড়ে। অর্থাৎ নারীর পরনের শাড়িতে তির্যক রেখার বিন্যাস এবং পুরুষের পাঞ্জাবিতে রেখাসমূহ উল্লম্ব। এই নানাবিধ রেখার সমন্বয়ে ছবিটিতে এক বিশেষ দৃষ্টিভ্রম (অপটিক্যাল ইলিউশন) ফুটে উঠেছে, যা কিনা চিত্রপটের এক সুদৃশ্য সক্রিয়করণ ঘটিয়েছে। আর একটি উল্লেখনীয় কাজ শিল্পী গণেশ হালুইয়ের ‘বালিকা’। কন্টি, চারকোলে সৃষ্ট কাজটিতে বালিকার বিস্ময় ভরা দৃষ্টি দর্শককে অনায়াসে মুগ্ধ করে।
নারীচরিত্রের এহেন বিবিধ বর্ণনে সমৃদ্ধ এই প্রদর্শনী এক অভিনব নিবেদন৷ আগামী দিনে এমন নতুন ভাবনায় সিঞ্চিত আরও বহু প্রদর্শনীর আশা রাখেন শিল্পপ্রেমী দর্শকরা।