Sur Jahan World Music Festival

ইউরোপ থেকে রাজস্থান, বাউল থেকে সলিল চৌধুরী, তিন দিন সুরে ভাসবে কলকাতা

সুরের জগতে কোনও কাঁটাতার নেই, সীমান্ত সুরক্ষার তাগিদ নেই। সুর যেন তার নিজের গরজেই মিশে যায় অন্য স্রোতের সুরের সঙ্গে এই উৎসবে।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০২৫ ১১:৩২
প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি। সূত্র: শাটারস্টক।

আজকের সঙ্গীত দুনিয়ায় ওয়ার্ল্ড মিউজ়িক বা বিশ্বসঙ্গীত বিষয়টি নতুন নয়। বরং বলা যেতে পারে, নব্বইয়ের দশক থেকেই এই বিশেষ সঙ্গীত জ্যঁরটির প্রসার। তবে সঙ্গীতত্ত্ববিদেরা বলেন, ‘বিশ্বায়ন’ প্রক্রিয়াটিই নাকি শুরু হয়েছিল সুরের সুবাদে! এক ভূগোলের সুর অন্য ভূখণ্ডে ছড়িয়ে পড়া আর সেখানকার মাটির সুরের সঙ্গে তার কুটুম্বিতা দিয়েই গড়ে উঠেছিল সুরের ভুবন। শহর কলকাতা সেই সুরের ভুবনটিকেই লালন করে প্রতি বছর শীতের শেষে ‘সুর জাহান’ নামে এক উৎসবের মধ্যে দিয়ে। সুরের জগতে কোনও কাঁটাতার নেই, সীমান্ত সুরক্ষার তাগিদ নেই। সুর যেন তার নিজের গরজেই মিশে যায় অন্য স্রোতের সুরের সঙ্গে এই উৎসবে। ২০২৫-এর ‘সুর জাহান’ আয়োজিত হবে ৩১ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারি। স্থান গল্‌ফগ্রিন সেন্ট্রাল পার্ক। আয়োজনে ‘বাংলানাটক ডট কম’।

Advertisement

বিশ্বসঙ্গীত নিয়ে বাংলানাটক ডট কম-এর যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০১১ সালে। সল্টলেকের নিকো পার্ক সংলগ্ন মাঠে। তখন এই আয়োজনের নাম ছিল ‘সুফি সূত্র’। সুফিসঙ্গীতই ছিল সেই সময়ে এই অনুষ্ঠানের ধ্রুবপদ। উল্লেখ্য, সঙ্গীতের নবকলেবরে বিশ্বায়নে সুফিসঙ্গীত যে বড় ভূমিকা নিয়েছিল, সে কথা বিশ্বসঙ্গীতের রসবেত্তারা একবাক্যে স্বীকার করেন। কলকাতাবাসী সে বার একই মঞ্চে শুনতে পেয়েছিলেন বাংলাদেশের আনুশেহ আনাদিল এবং গোয়ার রেমো ফার্নান্ডেজ়কে। ২০১৫ থেকে সেই আয়োজনই নাম বদলে দাঁড়ায় ‘সুর জাহান’-এ। কেন এই নামবদল? প্রশ্নের উত্তরে বাংলানাটক ডট কম-এর মুখপাত্র অমিতাভ ভট্টাচার্য জানালেন, একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকটিতে বিশ্ব জুড়ে বিপুল পালাবদল চলছিল। যে মতবাদের মূল কথাটিই ছিল তার মুক্ত চরিত্র, সেই সুফিই প্রায় রাষ্ট্রধর্মে পরিণতি পেল কোথাও কোথাও। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের সঙ্গে সংযুক্ত কিছুকে তাঁদের আয়োজনের নামে স্থান দিতে মন চাইল না। অমিতাভ জানালেন, তাঁদের সংগঠন চেয়েছিল বহুত্বের উদ্‌যাপন। নাম বদল হলেও সেই উদ্‌যাপন আজও বহমান।

১৯৭৩ থেকে শিকড়ের সুরের সন্ধান করছে নেদারল্যান্ডসের ‘ফোককর্ন’ ব্যান্ড।

১৯৭৩ থেকে শিকড়ের সুরের সন্ধান করছে নেদারল্যান্ডসের ‘ফোককর্ন’ ব্যান্ড। ছবি: সংগৃহীত।

২০২৫-এর ‘সুর জাহান’-এ অংশ নিচ্ছে চারটি দেশ। আইসল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন এবং ভারত। সুইডেনের আলে মোলার এবং তাঁর সম্প্রদায় ওয়ার্ল্ড মিউজ়িকের দুনিয়ায় অতিপরিচিত নাম। এই আয়োজনে আগেও শামিল হয়েছেন আলে মোলার। ২০১৭, ২০২০-তে তাঁরা এসেছেন। ২০১৭-য় এসেছিল ‘আলে মোলার কোয়ার্টেট’, ২০২০-তে ২০ জনের বিরাট দল। এ বার আসছে ‘আলে মোলার ট্রায়ো’। এঁদের নিবেদনে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার লোকসঙ্গীতের সঙ্গে অনায়াসে মিশে যেতে পারে বিশ্বের অন্য প্রান্তের সুর। বেশ কিছু গ্র্যামি প্রাপ্ত মোলার নিজে বাজান ম্যান্ডোলিন। তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা অ্যাকোর্ডিয়ান, ফ্লুট বা ক্লোহর্নের মতো বাজনাও পরিবেশন করবেন কলকাতায়।

১৯৭৩ থেকে শিকড়ের সুরের সন্ধান করছে নেদারল্যান্ডসের ‘ফোককর্ন’ ব্যান্ড।

১৯৭৩ থেকে শিকড়ের সুরের সন্ধান করছে নেদারল্যান্ডসের ‘ফোককর্ন’ ব্যান্ড। ছবি: সংগৃহীত।

নেদারল্যান্ডসের ‘ফোককর্ন’ সে দেশের লোল্যান্ড মিউজ়িকের দল। ১৯৭৩ সালে গঠিত এই গানের দল সে দেশের পরম্পরাগত সঙ্গীত পুনরুদ্ধারের কাজে রত। দীর্ঘ সময় ধরে নেদারল্যান্ডসে বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের অভিবাসন ঘটার ফলে সে দেশের লোকসঙ্গীতের মূল ধারাটিই প্রায় অশ্রুত থেকে যায় বলে মনে করেন অনেকেই। ‘ফোককর্ন’ সেই হারিয়ে যাওয়া সুরস্রোতোধারার সন্ধনেই রত।

তুলনায় আইসল্যান্ডের সঙ্গীতগোষ্ঠী ‘উমব্রা আঁসেম্বল’ বয়সে নবীন। এই দলের যাত্রা শুরু ২০১৪-এ। চার নারীর এই ব্যান্ডের নিবেদনে সুফি প্রভাব স্পষ্ট। সেই সঙ্গে মিশেছে উত্তর ইউরোপের মধ্যযুগীয় সঙ্গীতের ধারা। এঁরা অবশ্য সমসাময়িক কম্পোজ়ারদের রচনাও বাজিয়ে থাকেন।

আইসল্যান্ডের সঙ্গীতগোষ্ঠী ‘উমব্রা আঁসেম্বল’।

আইসল্যান্ডের সঙ্গীতগোষ্ঠী ‘উমব্রা আঁসেম্বল’। ছবি: সংগৃহীত।

এ বছর সলিল চৌধুরীর শতবর্ষ। মহীতোষ তাপস তালুকদারের পরিচালনায় ‘সুরবন্ধন’ গোষ্ঠী পরিবেশন করবে সলিল-সঙ্গীতের উপর আধারিত একটি অনুষ্ঠান। বাংলা থেকে থাকছে ‘ফোকস’ অফ বেঙ্গল’। দেবোময় দাস এবং মনস্বিতা ঠাকুরের সৃজনে সাম্প্রতিকের সঙ্গে মিশবে চিরায়ত লোকসঙ্গীত, সঙ্গে থাকবেন জয়শঙ্কর চৌধুরী এবং প্রাণেশ সোম। ‘সুর জাহান’-এর প্রতি বারের সম্পদই হল বাংলার বাউল-ফকিরদের গান। এ বার আসছেন কেন্দুলির দোতরাবাদক কাঙাল খ্যাপা। থাকবেন মুর্শিদাবাদের নিমাই খ্যাপা এবং নদিয়ার অর্জুন খ্যাপা।

বাংলার চৌহদ্দি ছাড়ালে অগাধ ভারতবর্ষ। প্রতি বছরই কোনও না কোনও অঞ্চলের বিশেষ অঞ্চলের লোকশিল্পীরা আসেন ‘সুর জাহান’-এ। পশ্চিম রাজস্থানের মরুভূমির সুর নিয়ে উপস্থিত থাকবেন কসম খান লঙ্গা এবং তাঁর সম্প্রদায়। ওড়িশার কোরাপুট অঞ্চলের দুরুয়া জনজাতির শিল্পীরাও আসবেন তাঁদের নৃত্য ও সঙ্গীত নিয়ে।

প্রতি দিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত থাকছে অনুষ্ঠান। আর সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত চলবে সঙ্গীতের কর্মশালা। উভয় ক্ষেত্রেই প্রবেশ অবাধ। অমিতাভ জানালেন, গল্‌ফগ্রিন সেন্ট্রাল পার্কের সুবিধা এর অর্ধবৃত্তাকার অনুষ্ঠানস্থল। মঞ্চের সঙ্গে শ্রোতার দূরত্ব যে কারণে কম। শ্রোতারা প্রায় অবাধেই ডুব দিতে পারবেন সুরের রূপসাগরে। অনুষ্ঠানের উদ্বোধন হবে দেবজ্যোতি মিশ্রের পরিচালনায় বিশেষ এক কনসার্ট দিয়ে।

ওড়িশার জনজাতি দুরুয়াদের নাচ-গানের আসর।

ওড়িশার জনজাতি দুরুয়াদের নাচ-গানের আসর। ছবি: সংগৃহীত।

শুধু গান নয়, ‘সুর জাহান’-এ থাকবে হস্তশিল্পের আয়োজনও। বাংলার কাঁথা, মহারাষ্ট্রের ওয়ারলি চিত্রকর্ম, সম্বল্পুরের ইক্কতের সঙ্গে থাকবে অ্যাপ্লিকের প্রদর্শনীও।

‘সুরজাহান’-এর মূল আকর্ষণ অবশ্যই তার শেষ দিনের অনুষ্ঠানের ‘ফিন্যালে’। উৎসবে আগত সব দেশের, সব সম্প্রদায়ের শিল্পীদের সমবেত নিবেদনে খোলা আকাশের নীচে সুরের অনন্তধারাকে হৃদয়ে অনুভব করা যায় সেই বিশেষ মুহূর্তে। মহাবিশ্বের অন্তঃস্তলেও যে সুরই খেলা করে চলেছে অবিরাম, তার মূর্তরূপ শোনা এবং দেখা যাবে সেই দিন।

Advertisement
আরও পড়ুন