সন্তানদের পূর্ণ বিকাশের সুযোগ দিতে কেমন হওয়া উচিত অভিভাবকত্ব? ছবি: সংগৃহীত।
কেউ কেউ বলেন, সন্তান পালন মুখের কথা নয়। মনোবিদেরা বলছেন, সে কারণেই বোঝা দরকার, কী ভাবে শিশুকে লালনপালন করলে তার ভাল হবে। কতটা শাসনে আর কতটাই বা সোহাগে বড় করা যাবে তাকে?
অভিভাবকত্ব নিয়ে এক এক জনের এক এক রকম ভাবনা। কোনও বাবা-মা মনে করেন, শিশুর বড় হওয়ার প্রতি মুহূর্তের কার্যকলাপ নজরে রাখলে, আখেরে সন্তানেরই মঙ্গল হবে। আবার কারও মতে, নিয়ন্ত্রণ নয়, স্বাধীনতাই জরুরি। অভিভাবকত্বের বিভিন্ন ধরন-ধারণ থেকেই তার নামকরণ। এই তালিকায় সংযোজন লাইট হাউস পেরেন্টিং।
নামকরণ কি যথার্থ?
মাঝ সমুদ্রে পথভ্রষ্ট নাবিককে দিশা দেখায় বাতিঘর বা লাইট হাউস। ডুবো পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে জাহাজডুবি যাতে না হয়, বা অন্য কোনও বিপদের আভাস থাকলে আগাম সতর্ক করার জন্যই তা তৈরি। লাইট হাউস পেরেন্টিং হল, বাতিঘরের মতো সর্বদা সন্তানকে পথনির্দেশ করা। মনোবিদ অনিন্দিতা মুখোপাধ্যায়ের কথায়, এখানে শিশুকে জাহাজ বা নাবিক এবং বাতিঘরকে অভিভাবকের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। যেখানে বাবা-মায়েরা সব সময়ে সন্তানের পাশে থাকবেন, তবে তাঁদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করবেন না। পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ বলছেন, ‘‘এর মূল কথাই হল ভারসাম্য। অতিরিক্ত নজরদারি যেমন নয়, তেমনই শিশু সমস্যায় পড়লে বাবা-মা তাকে দিশা দেখাবেন বা আগাম বিপদ সম্পর্কে সচেতন করবেন।’’
জেন আলফা এবং জেন জি-র জন্য ক্রমশই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে লাইট হাউস পেরেন্টিং। এতে শিশুরা তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করতে পারে। সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার সুযোগ পায়। অনিন্দিতার কথায়, হেলিকপ্টার পেরেন্টিং যেমন শিশুর পক্ষে ক্ষতিকর, এটি উপকারী। হেলিকপ্টার পেরেন্টিংয়ে অভিভাবকেরা সন্তানের প্রতিটি পদক্ষেপে তীক্ষ্ম নজরদারি চালান। যা অনেক সময়ে তাদের অবসাদ, কষ্টের কারণ হয়ে ওঠে। আবার ছেলে-মেয়েকে লালনপালন করতে গিয়ে কখনও কখনও বাবা-মায়েরা বড্ড বেশি ছাড় দিয়ে ফেলেন। তা-ও কাম্য নয়। লাইট হাউস পেরেন্টিংয়ে অতিরিক্ত নজরদারি এবং ছাড় দেওয়ার মধ্যবর্তী একটি পন্থার কথা বলা হয়েছে। যা অত্যন্ত ইতিবাচক।
কোথা থেকে উদ্ভব?
চিল্ড্রেনস হসপিটাল অফ ফিলাডেলফিয়ার অধ্যাপক কেনস গিনসবার্গ। ২০১৫ সালে ‘রেজ়িং কিডস টু থ্রাইভ ব্যালেন্সিং লাভ উইথ এক্সপেকটেশনস অ্যান্ড প্রোটেকশন’ বইতে তিনি লাইটহাউস পেরেন্টিংয়ের কথা বলেন।
কী এর শর্ত?
নিঃশর্ত ভালবাসা তবে লাগামহীন ছাড় নয়: সন্তানকে ভালবাসলেও তার অন্যায় আবদার বা অন্যায় আচরণকে প্রশয় দেওয়া নয়।
প্রত্যাশা: সন্তানের কাছে থেকে বাবা-মা কী চাইছেন, তা স্পষ্ট করে বলা। সেই প্রত্যাশা বাস্তবসম্মত হওয়া প্রয়োজন। তবে তা যেন সন্তানের কাছে চাপ না হয়ে দাঁড়ায়। লাইট হাউস পেরেন্টিং প্রত্যাশাপূরণের জন্য সন্তানকে উদ্বুদ্ধ করার কথা বলে।
সুরক্ষা: বাবা-মায়েরা সন্তানের সুরক্ষার কথা ভাববেন স্বাভাবিক। তবে খুদের প্রতিটি পদক্ষেপে অভিভাবক হস্তক্ষেপ করবেন না। বরং ছোটখাটো সমস্যা যাতে শিশু নিজে সামলে নিতে পারে, সেই স্বাধীনতা তাকে দিতে হবে।
সমস্যার সমাধান করা নয়: শিশুর জীবনে সমস্যার সমাধান করে দেওয়া নয়, বরং দিক নির্দেশের কথা বলে লাইট হাউস পেরেন্টিং। সন্তান যাতে জীবনের বিভিন্ন সময়ে স্বাধীন ভাবে ভাবতে পারে, সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সেই বিষয়ে তাকে অনুপ্রেরণা দেওয়া দরকার।
কথোপকথন: সন্তান এবং অভিভাবকের মধ্যে সম্পর্ক সহজ হতে হবে। যাতে যে কোনও কথা নির্দ্বিধায় বাবা-মাকে এসে বলতে পারে যে কোনও বয়সি ছেলেমেয়েই।
এই ধরনের অভিভাবকত্ব বাস্তবায়িত করতে হলে সন্তানকে শাসন, ভালবাসা, ছাড় দেওয়ার ক্ষেত্রে বাবা এবং মায়ের সুর একইরকম হওয়া দরকার মনে করালেন অনিন্দতা। পায়েল বলছেন, ‘‘অভিভাবকেরা সন্তানের রোল মডেল। তাই আচার, আচরণ, সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে বাবা-মাকে নিজের দায়িত্ব পালন করতে হবে।পরিবারের নিয়মকানুন, রুচি এগুলি শুরু থেকেই তাদের কাছে স্পষ্ট করে দিলে তাদের মধ্যে নিয়মানুবর্তীতা তৈরি হবে। স্বাধীনতা মানে যে দায়িত্ব, তা-ও বুঝিয়ে দেওয়া প্রয়োজন।’’
কোন বয়সের জন্য প্রযোজ্য ?
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসে কোন বয়সের ছেলে-মেয়েরা এই অভিভাবকত্বে লাভবান হবেন? মনোবিদ মনে করাচ্ছেন, ২-৩ বছর বয়স থেকে খাওয়া, ঘুমোনো, ঘোরা-বেড়ানো নিয়ে কিন্তু খুদের মতামত তৈরি হয়। ভাল লাগা, খারাপ লাগা, ইচ্ছা-অনিচ্ছা তারা প্রকাশ করতে পারে। সুতরাং অভিভাবকত্বের এই ধারা বা ভাবনা শিশুর বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে জরুরি, বাবা-মায়ের শাসন, ভালবাসা, ভাবনার সুর একই রকম হওয়া।
শুধুই কি ভাল?
এই অভিভাবকত্বে সমস্যাও রয়েছে। এ ক্ষেত্রে শিশুকে স্বাধীন ভাবে মত প্রকাশ, সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়। কিন্তু সমস্ত শিশুর একই বয়সে একই রকম বুদ্ধিমত্তা বা পরিণত মন তৈরি হয় না। সে ক্ষেত্রে কতটা ছাড় বা স্বাধীনতা তাকে দেওয়া যায়, তা দেখতে হবে।
সন্তানের ভাবনা, মন বুঝতে পারাও কিন্তু খুব জরুরি। এক এক রকম বয়সে তাদের এক এক রকম সমস্যা হয়। কৈশোরের সন্তানের মন-মেজাজ বোঝা একটু কঠিনও হয়ে পড়ে। কোনও ছেলে-মেয়ে অভিভাবকদের থেকে বাড়তি স্বাধীনতা চায়, আবার কেউ কেউ বাবা-মায়ের হস্তক্ষেপ আশা করে। সুতরাং লাইট হাউস পেরেন্টিং সকলের জন্যই একই রকম ফলপ্রসূ হবে তেমনটা নয়।
লাভ কোথায় ?
ইতিবাচক পরিবেশে বড় হওয়ার বেশ কিছু সুফল রয়েছে। পায়েল বলছেন, ‘‘এই ধরনের অভিভাবকত্বে বেড়ে ওঠা ছেলেমেয়েরা সাধারণত, পড়াশোনায় ভাল হয়, সামাজিক মেলামেশা সঠিক ভাবে করতে পারে, আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এগিয়ে চলার ক্ষমতা রাখে।’’