christmas

Christmas & Cake: কেকের আমি, কেকের তুমি? কেক দিয়ে যায় শহর চেনা

কলকাতার শীতকাল মানে তো ধর্মতলা দেখাও। কেকের দোকানের ভিড়ে পা মেলানো। কিছুটা ঠেলাঠেলি। দুর্গাপুজোর মতোই।

Advertisement
সুচন্দ্রা ঘটক
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০২১ ০৮:৪৫
কেক তখন তুলতুলে হল কি না, তা নিয়ে মাথাব্যথা সুযোগ ছিল কম। ২৫ ডিসেম্বর যে অন্তত একটি কেক হল, পুলি-পিঠেতে সারতে হল না, সেটিই বড় পাওয়া।

কেক তখন তুলতুলে হল কি না, তা নিয়ে মাথাব্যথা সুযোগ ছিল কম। ২৫ ডিসেম্বর যে অন্তত একটি কেক হল, পুলি-পিঠেতে সারতে হল না, সেটিই বড় পাওয়া। ফাইল চিত্র।

কলকাতা। শীতকাল। বড়দিন। ধর্মতলা। কেক উৎসব।

এখন যাদের মিলেনিয়াল বলে, তাদের বুঝি এ সবে কিছুই যায় আসে না? যায় আসে না তো বটেই। না হলে কেউ নিউ মার্কেটের ইহুদি বেকারির কেক না জেনে, না চেখে বড় হয়ে গেল? স্কুল-কলেজ পার করে ফেলল। এমনও হয় নাকি এই কলকাতা শহরে? হয়েছে তো বটেই। তারা তো ‘ক্রিসমাস’ পালন করে। বড়দিন আর বড়ুয়ার কেক তাদের কাছে এক নয়। যেমনটা তাদের মায়েদের ছিল। বাবারা ছুটির দিনের আগে কাজ শেষে ট্রেনে ওঠার সময়ে কিনে নিতেন একটি লাল বাক্স। অথবা কলেজ স্ট্রিটের কাকা আনতেন সান্তাবুড়োর ছবি আঁকা টিনের কৌটো। তার ভিতরে চকোলেট রঙের কাগজে মোড়া খানিকটা শক্ত কেক।

Advertisement

কেক তখন তুলতুলে হল কি না, তা নিয়ে মাথাব্যথা সুযোগ ছিল কম। ২৫ ডিসেম্বর যে অন্তত একটি কেক হল, পুলি-পিঠেতে সারতে হল না, সেটিই বড় পাওয়া। জীবন বদলে গিয়েছে খানিক। কেকের দোকান অনেক। ফোনে দু’-তিন মিনিট তুকতাক করলেই মোটরবাইকে চেপে সাহেবি মোড়কের বাক্সে কেক চলে আসে।

এখন নাকি ডিসেম্বরে আমেরিকা, ইউরোপের ক্রিসমাস মার্কেট দেখতে যাওয়ার জন্য মন আনচান করে। নেটফ্লিক্সে যেমনটা দেখেছে, তেমন কিছু নেই কেন জীবনে, তা নিয়েই চিন্তা। আর কাজের মাঝে অনুজ সহকর্মীদের সঙ্গে সেই আড্ডার শেষে তিরিশ পেরনোদের মাথায় হাত পড়ে। ভিন্‌ দেশি ক্রিসমাস মার্কেট যে তাদের টানে না, এমন নয়। তাই বলে ওটিটি-র জ্বালায় ধর্মতলার কেক ব্যবসা লাটে উঠবে নাকি? সে চিন্তায় প্রায় ঘুম ওড়ে। কলকাতা কি তবে বদলেই গেল? কপালে ভাঁজ পড়ে মধ্য তিরিশ পেরনোদের। কোভিডের পর কলকাতা কেন, বহু শহরের স্বভাবই বদলেছে। তাই বলে এমন বদল কি মেনে নেওয়া যায়? যেখানে কেক মানে মূলত আধুনিক দোকান। বিলিতি মেজাজের বাক্স। মিষ্টির দোকানের মতো লালের উপর হলুদ ছাপ কিংবা একেবারে সাদা প্যাকেট নয়। সেই কেকের স্বাদ কি আরও বেশি হয়?

এ কেক সেরা কি না, সে তর্কে মিলেনিয়ালদের পাশে চাইলে থাকাই যেতে পারে। কিন্তু কলকাতার শীত উৎসব যে ফিকে হয়নি, তা জানান দেয় ছোট-বড় কিছু বেকারিই।

এ কেক সেরা কি না, সে তর্কে মিলেনিয়ালদের পাশে চাইলে থাকাই যেতে পারে। কিন্তু কলকাতার শীত উৎসব যে ফিকে হয়নি, তা জানান দেয় ছোট-বড় কিছু বেকারিই। ফাইল চিত্র।

আলোচনা চলছিল বড়দিন নিয়ে। বলা ভাল, ক্রিসমাস নিয়ে। কোথায় গেলে ক্রিসমাসের আমেজ ভাল পাওয়া যাবে, তা ঘিরেই কথা বাড়ে। গড়াচ্ছিল তর্কের দিকে। বিদেশেই নাকি যেতে হবে। ইউরোপ, আমেরিকায় না গেলে ডিসেম্বরের আমেজ বোঝা যায় না। ঠিক যেমন কলকাতা শহর ছাড়া দুর্গাপুজো দেখা যায় না। দাবি করছিল ‘ওটিটি প্রজন্ম’। ‘প্রাক্‌ ওটিটি’-রা অবাক হয়ে জানতে চাইছিল, ‘হ্যাঁ রে, তোরা নিউ মার্কেটে যাস না এ সময়ে? ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, সদর স্ট্রিটেও নয়?’ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিস ঘরের ভিতর জমছিল আরও প্রশ্ন। পাল্টা প্রশ্নও। এ শহর কবে এত একঘেয়ে হয়ে গেল? দুর্গাপুজো দেখে বলে ক্রিসমাস চেনে না? বাঙালি মঠে তো যিশু পুজোও হয়। সে কথাও কি মনে রাখে না?

কিন্তু করোনা জর্জরিত সময়ে এ সব প্রশ্ন আরও কঠিন। বেরনো কমেছে। মোটরবাইকে চেপেই বাড়িতে আসে খাবারদাবার। কিন্তু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পথেই নামতে হয়।

আছে আছে। কবির বক্তব্যের জোর আছে! কলকাতার মধ্যে যে আরও একটি নয়, হাজার কলকাতা আছে! কবি নন শুধু, সাধারণেও দেখতে পায়। সেখানে ওটিটি নেই। ইতিহাস আছে। ঠেলাঠেলি, গাদাগাদিকে শহরের ঐতিহ্য বলতে চাইলে, তা-ও আছে। সে কালের সাহেব পাড়ায় ফিকে হতে থাকা সাহেবিয়ানাও আছে। হাজার বদলের মাঝেও যে সব আগলে রাখতে পেরেছে এ শহর।

শুধু কলকাতা নয়, শহরতলিরও সব গলিতে এখন কেকের দোকান আছে। অফিস ফেরত বাবারা ট্রেনে ওঠার আগে নয়, ট্রেন থেকে নেমেও দিব্যি কিনতে পারেন কেক। কিন্তু নিউ মার্কেট থেকে কেক কেনা তো শুধু কেনা নয়, উৎসবও বটে। কলকাতার শীতকাল মানে তো ধর্মতলা দেখাও। কেকের দোকানের ভিড়ে পা মেলানো। কিছুটা ঠেলাঠেলি। দুর্গাপুজোর মতোই। তা সে ‘ক্রিসমাস’-এর নামে হবে, নাকি বড়দিন— সে বিতর্ক না হয় তোলাই থাকল অন্য সময়ের জন্য।

এই লাইনের সকলের ঘরেও বাইক আরোহীরা পৌঁছে দিতেন আধুনিক দোকানের অত্যাধুনিক তুলতুলে কেক। কিন্তু কলকাতা যে লাইনে দাঁড়াতে পছন্দ করে।

এই লাইনের সকলের ঘরেও বাইক আরোহীরা পৌঁছে দিতেন আধুনিক দোকানের অত্যাধুনিক তুলতুলে কেক। কিন্তু কলকাতা যে লাইনে দাঁড়াতে পছন্দ করে। ফাইল চিত্র।

লিন্ডসে স্ট্রিটে ঢুকতে তাই কলেজ স্কোয়ারের পুজো দেখার মতো এক পা ফেলে অপেক্ষা করতে হয় মিনিট কয়েক। সে ভাবে আধ ঘণ্টার চেষ্টায় ডিসেম্বরের ঠান্ডায় গলগল করে ঘামতে ঘামতে কোনও মতে পৌঁছনো যায় নিউ মার্কেটে ঢোকার একটি দুয়ারে। তখন মনে হয়, সব মিলেনিয়াল ঝুট হ্যায়। এত্ত ভিড়! নিশ্চই সকলে কেক কিনতেই যাচ্ছেন। মন আবার নিজের প্রতি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে ঠাট্টা করে। বলে, যা দেখতে চাও, তা-ই তো দেখ! ভিড় মানেই কি পুরনো বেকারির কেক কেনা নাকি? নিজে যেখানে যাচ্ছ, সকলে কি সেখানেই যাবে নাকি!

কিন্তু মন সব সময়ে ভুল হয় না। সত্যিই নিজে যেখানে যাচ্ছি, শুধু সেখানেই যাচ্ছেন সকলে। আগে নিউ মার্কেটের সবচেয়ে বড় বেকারিতে ভিড় জমত। এখন তা আরও বেড়েছে। পিছনের কম চেনা বেকারিতেও লাইন। এ কেক সেরা কি না, সে তর্কে মিলেনিয়ালদের পাশে চাইলে থাকাই যেতে পারে। কিন্তু কলকাতার শীত উৎসব যে ফিকে হয়নি, তা জানান দেয় ছোট-বড় এই সব বেকারিই। দশ মিনিটের নিউ মার্কেট সফর দেড় ঘণ্টায় মোড় নেয়। ভিড় ঠেলে এক দোকান থেকে আর এক দোকানে যেতে কত যে সময় লাগে! তার উপর রয়েছেন পনির, চিপসের দোকানের ধারের কেক বিক্রেতারা। যাঁরা দাঁড়াতে পারলেন না বড় লাইনে, তাঁরা ভিড় করলেন সেখানে। ১০০ টাকায় ছোট ছোট কেক। এই লাইনের সকলের ঘরেও বাইক আরোহীরা পৌঁছে দিতেন আধুনিক দোকানের অত্যাধুনিক তুলতুলে কেক। কিন্তু কলকাতা যে লাইনে দাঁড়াতে পছন্দ করে। পুজো দেখার লাইন যেমন বছর বছর বাড়ে, তেমনই বেড়েছে আনামী কেকের দোকানের লাইনও।

অফিস ফেরার মন মসৃণ হয়। ওটিটি পন্থী সহকর্মীদের জন্য কেক কেনা হয়নি। লাইনে দাঁড়ানো মানে আরও ঘণ্টা দুয়েকের ধাক্কা যে। তবে মন জোর পেয়েছে। নতুন বছরে পুরনো দোকানের কেক অবশ্যই খাওয়াতে হবে তাদের। কলকাতার শীত উৎসবে সামিল করতেই হবে ওটিটি-প্রেমীদের। পন করে নিয়েছে মধ্য তিরিশ পার!

Advertisement
আরও পড়ুন