Children Imagination

একঝাঁক ইচ্ছেডানা

ক্রমশ বদলাতে শুরু করেছে বাচ্চাদের কল্পলোক। দেশজ গল্পকথার চরিত্রদের জায়গায় শিশু-কিশোররা এখন অ্যানিমে, নিনজা, মার্ভেলের জগতে বুঁদ

Advertisement
নবনীতা দত্ত
শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০২৪ ০৯:৪৭

ফেলুদার বাড়ি ২১ নম্বর রজনী সেন রোড, শার্লক হোমসের ঠিকানা ২২১ বি, বেকার স্ট্রিট... এমন কত তথ্য মনে করে রেখে দেওয়া ও কিশোরবয়সে বন্ধুমহলে সে সব বলতে পেরে কলার তোলার মতো একটা ব্যাপার ছিল এক দশক আগেও। ফেলুদা না ব্যোমকেশ নিয়ে যেমন দল ভাগ হয়ে যেত, তেমনই শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের অদ্ভূতুড়ে গল্পের হাতছানিও কম ছিল না। সে সব দুষ্টু-মিষ্টি, ভিতু ভূতরা ভয় দেখাত কম, বরং বন্ধুর মতো আশপাশেই ঘুরঘুর করত। ছোটরা আবার মাঝদুপুরে চোখ বড় বড় করে ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র রাক্ষস-খোক্কসের গল্প শুনে ঠাকুমা-দিদিমাদের পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে যেত। বিকেলে বা ছুটির সকালে আবার কত কচিকাঁচা বারান্দার গ্রিল থেকে পা দুলিয়ে-দুলিয়ে আধো বুলিতে গেয়ে উঠত, ‘মাসি পিসি বনগাঁ-বাসী বনের ধারে ঘর, কখনো মাসি বলেন না যে খইমোয়াটা ধর।’

Advertisement

ছোটদের সেই কল্পলোকে রাক্ষস-খোক্কস, ভূত-পেত্নিদের সঙ্গে দেব-দেবী, পৌরাণিক চরিত্রের সহাবস্থানও ছিল সুন্দর। অ্যালিসের সঙ্গে খরগোশের গর্তে ঢুকে পড়া থেকে আরব্য রজনীর কার্পেটে চড়ে মেঘরাজ্যে পাড়ি দেওয়াও কঠিন ছিল না। সেই রূপকথার মতো ছোটবেলায় ‘সেপ্টোপাসের খিদে’, ‘টেরোড্যাকটিলের ডিম’-এর মতো গল্প যেন বহির্জগতের দরজা খুলে দিত। এই কল্পলোকের সন্ধান মিলত গল্পকথায়। কাকাবাবু-সন্তু, মোগলি, অ্যালিস, ফেলুদা, টেনিদা, ঘনাদা বা টিনটিনের সঙ্গে কত ছুটির দুপুর কেটে যেত অনায়াসে। তবে বেশির ভাগ চরিত্রের সঙ্গেই প্রথম পরিচয় বইয়ের পাতায়। ফলে বইয়ের বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে কল্পনায় তৈরি হতে থাকত একটা অন্য পাড়া, অন্য জগৎ। কিন্তু এই কল্পনার জগৎই ক্রমে পাল্টে যাচ্ছে ছোটদের মধ্যে।

আমরা তো আর ছোট নেই

বই পড়ার অভ্যেস অনেকটাই কমে গিয়েছে টিভি আর মুঠোফোনের সৌজন্যে। স্ক্রিনেই ছোটরা চিনে নেয় মোগলি, অ্যালিস, ফেলুদাদের। তবে সেই চরিত্রদের প্রতি তাদের টানই বা কতটা! বরং তার জায়গায় এখন ওদের বেশি টানছে পেপা পিগ, ব্লুয়ি, মাঙ্গা, কোরিয়ান রিল, ফুডমেকিং ভিডিয়ো, মিনিয়েচার ওয়র্ল্ড। যোধপুর পার্ক বয়েজ় স্কুলের প্রধান শিক্ষক অমিত সেন মজুমদার বললেন, “ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে গল্পের বই পড়ার অভ্যেস কমে গিয়েছে। লাইব্রেরিতে আমরা নতুন বই এনে দিই, স্টোরিমেকিং কম্পিটিশন করি। কিন্তু ওদের তেমন আগ্রহ নেই। তবে ওরা গ্রাফিক নভেল পছন্দ করে। পুজোসংখ্যায় ফেলুদার কমিকস বেরোলে পড়ে। আর বিদেশি, বিশেষত জাপানি, কোরিয়ান কার্টুন বা কমিকস বেশি পছন্দ। এরা মাঙ্গাও খুব পছন্দ করে।” তার সঙ্গে রয়েছে রিলস, ভিডিয়ো গেম। ফলে এদের কল্পনার জগৎ একটু অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে।

অ্যানিমে শুধু পছন্দ নয়, তেমন জীবনযাপনের চেষ্টাও দেখা যাচ্ছে টুইন থেকে টিনদের মধ্যে। পাঠভবন স্কুলের টিচার ইন-চার্জ ভারতী চট্টোপাধ্যায় যেমন বললেন, “একটা এলিয়েন কালচার এদের পছন্দ। আমাদের প্রজন্ম সেটার সঙ্গে একেবারেই পরিচিত নয়। এদের অ্যানিমে যেমন প্রিয়, কে-পপ ব্যান্ডেরও ভক্ত এরা। হো চি মিন সরণিতে এমন প্রদর্শনীও হয়, যেখানে পড়ুয়ারা অ্যানিমে চরিত্রের মতো সেজে যায়। ও রকম চুল বাঁধে, জামা পরে। ফলে তাদের কল্পনার জগৎটাও কিন্তু সেই ধাঁচের।” বলা যেতে পারে ওদের একটা কালচারাল শিফট হচ্ছে। তবে ছাত্রছাত্রীরা রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে নাচ বা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণও করছে, বলে জানালেন ভারতী। সেটায় যে তাদের উৎসাহ নেই, এমনও নয়। তবে নিজের সংস্কৃতি কম জানছে, ভিনদেশি কালচারের সঙ্গে বেশি পরিচিত হচ্ছে।

তবে ভিন্ন মত পোষণ করলেন দিল্লি পাবলিক স্কুল, নিউটাউনের প্রিন্সিপাল সোনালি সেন, “আমার স্কুলের ছেলেমেয়েরা যেমন বই পড়ে, তেমন সিনেমাও দেখে। তবে ইংরেজি বই পড়ার চল বেশি। আবার এক দিকে যেমন রঙ্গোলি করছে, অন্য দিকে ইকেবানা বানাচ্ছে। আমার মনে হয় এটাই দরকার। নিজের ঐতিহ্যও ভুলবে না, আবার বিশ্বের সাহিত্য, শিল্পের এক্সপোজ়ারও পাবে।” শিশুদের সার্বিক গঠনে তা সহায়ক। তবে কোরিয়ান কালচারের প্রতি এই প্রজন্মের আগ্রহ প্রায় সকলেই একবাক্যে মেনে নিলেন।

কিছু অভ্যেস তৈরি করাও জরুরি

সন্তানের পঠনপাঠন, চিন্তাভাবনার জগৎ কেমন তৈরি হবে, সেটা অভিভাবকের উপরেও নির্ভর করে। ছোট থেকেই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যজিৎ রায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গল্প-উপন্যাসের চরিত্রদের সঙ্গে যদি পরিচয় করানো যায়, তা হলে সেই অভ্যেস তাদের বড় হয়েও থাকবে। আর মা-বাবাকেই উদ্যোগী হতে হবে নিজেদের সংস্কৃতির সঙ্গে এদের পরিচয় করানোর জন্য। এই প্রসঙ্গে ব্রাহ্মগার্লস স্কুলের টিচার ইন-চার্জ রুবি চক্রবর্তী বললেন, “এমন অনেক ছাত্রছাত্রী পড়তে আসে, যারা ফার্স্ট জেনারেশন লার্নার। ফলে বাড়িতে যদি সারাদিন সিরিয়াল, রিলস চলে, সেগুলোই দেখবে। আর কল্পনাশক্তিও সেই অবধি সীমিত থাকবে। তবে আমাদের স্কুলের অনেক মেয়েকেই দেখি বই নিয়ে আলোচনা করলে, বলতে পারে। ওরা অনেকেই বই পড়ছে।”

এ বিষয়ে আর একটি দিকও উল্লেখযোগ্য। সন্তান ইংরেজিতে স্বচ্ছন্দ বলে এখন অনেকেই ফেলুদা, কাকাবাবু ইত্যাদি বাংলা বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ কিনে দেন। তবে মনে রাখতে হবে সেটাই অভ্যেস করে ফেললে হবে না। কোনও সংগ্রহের একটা দুটো গল্প হয়তো ইংরেজিতে কিনে দিলেন। তার পর সেই চরিত্র সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি হলে, সেটা বাঙালি চরিত্র হলে সেই ভাষার বই কিনে দিন। সাহিত্য যে ভাষায় রচিত, সে ভাষাতেই সন্তানদের পড়তে দিন। এতে যেমন ওরা দুটো ভাষাতেই স্বচ্ছন্দ হবে, বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যের আলাদা রূপ-রস-গন্ধও অনুভব করবে।

এখানে ওদের যুগোপযোগী গল্প বলার অভ্যেসও জরুরি। এ বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উল্লেখ করলেন পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ, “অ্যানিমে বা বিদেশি নভেলের কনটেন্ট অনেক সমসময়ের। সেইজন্যই হয়তো ওরা একাত্ম বোধ করছে। অন্য ভাষায় সেই কাজ হচ্ছে। কিন্তু আমরা ওদের বাংলায় যে গল্পের বই বা শিশুসাহিত্য পড়তে দিচ্ছি, তা কয়েক দশক আগের কনটেন্ট। সেটার সঙ্গে হয়তো ওরা রিলেট করতে পারছে না। যুগোপযোগী করতে এখন যেমন পর্দায় ফেলুদার হাতেও ফোন, সে ভাবে সমসাময়িক শিশুসাহিত্য পেলে হয়তো ওরা পড়বে। সব দোষ কিন্তু শিশুদের নয়।” তা ছাড়া বাড়িতে অভিভাবকদের গল্প বলার অভ্যেস করতে হবে। সেই গল্প সন্তানের চেনাজানা জগৎ ছুঁয়ে হলেই ভাল। আর ধীরে ধীরে গল্পের বই ধরাতে হবে। নিজে গল্প শুনে অনুধাবন করে কল্পনায় একটা ছবি তৈরি হয়। তাই বই পড়াও খুব জরুরি।

বাচ্চাদের কল্পলোকের বিস্তারের জন্য শুধু বই পড়া নয়, জরুরি প্রকৃতির কাছে যাওয়া। গাছপালা, পশুপাখি, পতঙ্গ পর্যবেক্ষণ করে বড় হলে, তার কল্পনার জগৎও অনেক বাড়বে। সৃজনশীল ক্ষেত্রে এই কল্পনাশক্তি জরুরি। সেটা সাবলীল ভাবেই তৈরি হোক ছোট থেকে।

মডেল: রাইমা গুপ্ত, অনুমেঘা কাহালি, আরুষ দে, ওঙ্কার ভট্টাচার্য, নিকিকেতা ঘড়ুই; ছবি: সর্বজিৎ সেন; মেকআপ: অভিজিৎ কয়াল (অনুমেঘা ও নিকিকেতা), কুশল মণ্ডল।

আরও পড়ুন
Advertisement