New Year Party

‘আজ কী রাত...’ পার্টি তো হল, কিন্তু আখেরে লাভ কী হল?

প্রাচ্যে বছরশেষের উদ্‌যাপন হত গানে, আড্ডায়, খানাপিনায়। মিলনের উৎসব কখনওই মত্ত আস্ফালনের চেহারা নেয়নি। পাশ্চাত্য 'পার্টি'র যা ধারণা, প্রাচ্যে তা অনেকটাই আলাদা। বিজাতীয় এক রেওয়াজ আত্মীকরণ করে তার নিজস্ব অর্থই ভুলতে বসেছে সমাজ।

Advertisement
সুদীপ ঘোষ
শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৮:২৯
How is new year party important at all, where does it lead us to

আজ রাতে অনেকেই হয়তো ‘পার্টি’ করবেন, এর আসল অর্থ জানেন কি? ফাইল চিত্র।

ইংরেজি ভাষার কবি ও প্রাবন্ধিক থমাস স্টার্নস ইলিয়ট জন্মেছিলেন আমেরিকায়। কিন্তু লেখকজীবনের বেশির ভাগ সময়টা কটিয়েছিলেন এক জন ব্রিটিশ নাগরিক হিসাবে। তাঁর দুনিয়াখ্যাত দীর্ঘকাব্য ‘দ্য লাভ সং অফ জে অ্যালফ্রেড প্রুফ্রক’ কবিতায় একটি বাক্য ছিল—‘এপ্রিল ইজ় দ্য ক্রুয়েলেস্ট মান্থ…’ যার বাংলা করলে মানে হয়, এপ্রিল নিষ্ঠুরতম মাস। কবিতার বাক্যাংশটি শুনে এ বার কি থমাস স্টার্নস ইলিয়ট নামটি চেনা-চেনা মনে হচ্ছে? বাংলা ,এবং কিছুটা হলেও দুনিয়াও, ভদ্রলোককে যে নামে বেশি চেনে, সেই নামটি হল টি এস ইলিয়ট। সেই কবির কথাই বলা হচ্ছে এই লেখায়। ১৯৪৮ সালে ইলিয়ট সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। নোবেল পাওয়া কোনও সাহিত্যিক ভুল কিছু লিখতে পারেন, এমন দাবি করা অর্বাচীনতা। কিন্তু উপমহাদেশের এক সাহিত্যের ছাত্র হিসাবে মনে হয়, ইলিয়ট ‘দ্য লাভ সং...’ কাব্যে মাসটি হয়তো একটু গুলিয়ে ফেলেছিলেন। এপ্রিল না-হয়ে মাসটি ডিসেম্বর হলে হয়তো জুতসই হত। কেন বললাম? কারণ ডিসেম্বর মাসটিই হল মানুষের সব হারানোর মাস। ‘দ্য লাভ সং...’ কাব্যে ইলিয়ট যা বোঝাতে চেয়েছেন, তা হল মনুষ্যজীবনের যাপন ধর্মের অসার্থকতা। কিন্তু সেই অনুভূতি তো ডিসেম্বর দেয়, এপ্রিল তো দেয় না।

Advertisement

বছরের শেষ মাস ডিসেম্বর। এই একটিই মাস, যার শেষ দিনে প্রত্যেকে একটি বছরের সব স্মৃতিকে পিছনে ফেলে দিতে চায়। কী অদ্ভুত! পরম ঔৎফুল্লের সঙ্গে। কিন্তু ভুলতে চাইলেও কি এত সহজে এত স্মৃতির ভান্ডারকে অবলীলায় ভুলে থাকা যায়? ফেলে আসা বছরটার আনন্দ, দুঃখ, বেদনা, হার-জিত, অপারগতা, ব্যর্থতা, বন্ধুতা, দেওয়া-নেওয়া, তার প্রত্যেকটিই তো এক জন দুনিয়াদারকে আরও একটু, সামান্য হলেও, সাবালক করল। সেগুলিকে এত সহজে বিস্মৃত হওয়া যায়? একটু হলেও তো বড় হলাম, জীবনকে আরও গভীর ভাবে বুঝতে শিখলাম। সেটিকে পাথেয় করেই তো নতুন বছরটিতে পদার্পণ করব। সেই শিক্ষাগুলিই (যদি জীবনের এই শিক্ষাগুলি আত্মস্থ করতে পারি অবশ্য!) তো আমাকে আরও খানিকটা আত্মবিশ্বাসী হয়ে নতুন বছরে পা ফেলতে সাহায্য করবে। সেই ধ্রুবকে কী ভাবে অস্বীকার করব? অস্বীকারই যদি করি, তা হলে তো যাপনানুভূতিটিই অস্বীকৃত হয়ে গেল। তা হলে কি এগোলাম, না পিছোলাম? দ্বিতীয়টিই সম্ভবত। আর এখানেই খটকা।

পার্টি মানে শুধুই কি মত্ত উল্লাস?

পার্টি মানে শুধুই কি মত্ত উল্লাস? ফাইল চিত্র।

আজ রাতে অনেকেই হয়তো ‘পার্টি’ করবেন। ‘পার্টি’ মানে কী? হুল্লোড়, মোচ্ছব, উল্লাসের আস্ফালন! কেন? না, একটি বছর দিব্যিই তো পেরিয়ে এলাম! তাতে ঠিক কী প্রমাণিত হল? কিস্যু না! আরও কতটা জীবনের পথে হাঁটতে হবে, সে খেয়াল আছে? আরও কত দুঃখ, বেদনা, ব্যর্থতা, আঘাতের ক্ষতের মুখোমুখি হতে হবে, পেরোতে হবে আরও কত বধাবিঘ্ন, যাপনচড়াই ধরে পেরোতে হবে আরও কত জীবনপর্বতশৃঙ্গ, তার হিসাব আছে? না, সামনের সব পাঞ্জার কথা ভুলে, এক রাতের জন্য উল্লাসের মত্ত আস্ফালনে নিমজ্জনই লক্ষ্য।

‘পার্টি’র ধারণাটি কিন্তু মোটেই দেশি নয়। ঔপনিবেশিকের হাত ধরে প্রাচ্য সভ্যতায় এর আগমন। প্রাচ্যের সব দেশেই আনন্দের উদ্‌যাপন কিন্তু বরাবর ছিল। কিন্তু সেটি ‘মোচ্ছবের’ রূপ কখনওই নেয়নি। মজলিস হত, জলসা হত, আড্ডা হত, উৎসব হত, মিলনানুষ্ঠান হত। পানাহার সে সবের অংশ ছিল অবশ্যই। কিন্তু প্রধান অংশ ছিল না কোনও দিনই। বলতে চাইছি, সব ক্ষেত্রেই একটি সামাজিক মোচড় রাখা হত প্রাচ্য সভ্যতায়। সমাজবদ্ধতাই ছিল প্রাচ্যের সব ‘উল্লাস’-এর মূল লক্ষ্য। কিন্তু ‘পার্টি’র ধারণাটি প্রাচ্য দুনিয়ায় সম্পূর্ণ বিজাতীয়। জোর করে চাপিয়ে দেওয়া। রাজার খেয়াল বলা যায়। পাশ্চাত্যের দর্শন। ‘পার্টি’র দর্শন কিন্তু মোটেও অন্তর্ভুক্তিতে বিশ্বাস করে না। সেখানে কোনও উল্লাসপ্রেমী দিব্যি একা থাকতে পারেন। কেউ কিছু বলবে না, কারও কিছুই আসবে-যাবে না। সমাজমাধ্যমের একাকী যাপনে তা হয়তো সুবিধাজনক, কিন্তু চূড়ান্ত ক্ষতিকর, মানসিক ভাবে। অনেকের মধ্যে থেকেও, একাকী যাপন। সমাজবদ্ধতাকে বুড়ো আঙুল দেখানোর, অস্বীকার করার, একটি প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া। অর্থাৎ, একটি সভ্যতাকে শিকড়বিচ্ছিন্ন, আত্মবিস্মৃত করার জন্য, খুব ধূর্তচিন্তিত একটি প্রক্রিয়া। এমন তার জৌলুস, তার উল্লাস, যে দেখবে তার মাথা সহজেই ঘুরে যাবে। সে বাধ্য হবে নকলনবিশিতে। সাধে কি আর শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেব সাহেবদের মনোহরণের জন্য বাড়ির দুগ্গাপুজোতেই বহির্দালানে নিজের সাহেবপ্রভুদের পানাহারের ব্যবস্থা করতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন! পুরনো কলকাতায় তো প্রচলিত প্রবাদের লব্জই ছিল, ‘মা রাতে গান শোনেন শোভাবাজারের দেববাড়িতে’। ‘পার্টি’প্রসূত এই একাকী যাপনের ফল কী হতে পারে, আধুনিক সময় চোখে আঙুল দিয়ে প্রমাণ করে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। সমস্যা হল, কারওই তাতে চোখ খুলছে না।

ঠিক এ রকমই নানা বিজাতীয় অভ্যাস আমরা প্রতিনিয়ত মানিয়ে নিচ্ছি, দুনিয়ার তথাকথিত ‘সভ্যতা’র সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে। সভ্যতার দুধটুকু শুষে নিতে অপারগ এই জাতি, হাঁস যেমন পারে। কিন্তু এই হাঁসের প্রসঙ্গেই আর এক বিজাতীয় তত্ত্বের উত্থাপন করা যেতে পরে। সেটিও একটি ঔপনিবেশিক কথন। ইংরেজিতে একটি শব্দ আছে, ‘সোয়ানসং’। যার কাছাকাছি মানে হতে পরে, ধ্বংস বা মৃত্যুর আগের সেরা উল্লাসের আস্ফালন, যা কোনও অর্কেস্ট্রার ‘শেষ অঙ্ক’-র সঙ্গে তুলনীয়; শ্রেষ্ঠ সুরক্ষেপণে প্রয়াণ! প্রাচ্য সভ্যতা কি ধীরে-ধীরে, দিনে-দিনে তার সেই শ্রেষ্ঠ সুরক্ষেপণের দিকে ধাবমান? এই বছরের শেষে না-হয় সেই প্রশ্নটি নিয়েই একটু মনোনিবেশ করা যাক...

Advertisement
আরও পড়ুন