শীত মানেই খেজুর গাছ থেকে টাটকা রস। এ ভাবেই তা সংগ্রহ করা হয় গ্রাম বাংলায়। ছবি: সংগৃহীত।
শীতকাল আর পৌষপার্বণ মানেই তো সুমিষ্ট খেজুর রস, নলেন ও পাটালি গুড়, জয়নগরের মোয়া আর নানা রকম সুস্বাদু পিঠেপুলি। পিঠের কথায় পরে আসব। কিন্তু খেজুর রসে জ্বাল দিয়ে ভাত রান্নার কথা শুনেছেন কখনও? অথবা সেই ভাতের স্বাদ কেমন হতে পারে, আছে তার কোনও ধারণা? আমরা এসব ভাবতে না পারলেও, অভিনব সেই জিনিস নিজে খেয়েছিলেন এবং আর পাঁচ জনকে খাইয়েছিলেন ভোজন রসিক ও রন্ধনপটু স্বামী বিবেকানন্দ। শরীর ত্যাগের মাত্র কয়েক মাস আগের ঘটনা। ১৯০২ সালের জানুয়ারি মাসে জাপানি পণ্ডিত ও শিল্প সমালোচক ওকাকুরা, মার্কিন ভক্ত মিস ম্যাকলাউড, স্বামীজির শিষ্য স্বামী নির্ভয়ানন্দ এবং দুই সেবক নেদা ও নরেশচন্দ্র ঘোষকে নিয়ে বিবেকানন্দ তখন বুদ্ধগয়ায়। সেখানে এক বাঙালি ভদ্রলোক স্বামীজির সঙ্গে রোজ দেখা করতে আসতেন। আর প্রতি দিন এক কলসি তালের রস ও এক কলসি খেজুর রস পাঠাতেন। আর সকলে খেজুর রস খেলেও ওকাকুরাকে বিবেকানন্দ তালের রস খাওয়াতে বলতেন। তালের রস সাধারণত গ্রীষ্মে মেলে। তবে কিছু বারোমাসের গাছে শীতেও তালরস হয়। তাই হয়তো বুদ্ধগয়ায় ওকাকুরার ভাগ্যে সেই রস আস্বাদনের সুযোগ ঘটেছিল আর তাতে তাঁর বেশ নেশাও হত। বিবেকানন্দ ওঁকে নিয়ে খুব রগড় করতেন। বলতেন, এই হল আমাদের দেশের গ্রামের মদ। কলসি ভর্তি খেজুর রস দেখে কিন্তু বিবেকানন্দের মাথায় নতুন আইডিয়া এল। তিনি বললেন, রোজ অত খেজুর রস আসে, নষ্ট হয়, এক কাজ করো— আজ খেজুর রসের জলে ভাত রাঁধো। সেই ভাবে রান্না হল। আর সকলের সঙ্গে তিনিও খেলেন। মনে পড়ে যায় ভবা পাগলার সেই গান—
‘সুজন গাছে বাঁধালে হাঁড়ি মিলবে আসল চিনি/ রসিক বুঝে রসের মর্ম অরসিক বুঝে না তার আস্বাদন।' বিবেকানন্দের মতো রসিক না হলে কি আর রোজের সাধারণ ভাতের সঙ্গে খেজুর রসের এই অসাধারণ যুগলবন্দি ঘটাতে পারতেন? অবশ্য অতীতের পল্লিবাংলায় শীতের সকালে বাড়িতে বাড়িতে ‘জাউভাত’ খাওয়ার যে চল ছিল, সেটিও ভুললে চলবে না। অগ্রহায়ণ মাসে নতুন ধানের ছড়া এনে ঘরের দরজার মাথায় টাঙিয়ে দেওয়া হত। নবান্নের সময় নতুন আতপ চাল আর খেজুর গুড় দিয়ে পায়েস রান্নার সময় চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ত অপূর্ব সুবাস। নতুন চাল ওঠার পর থেকে পুরো শীতকাল জুড়ে সকালের জলখাবারে থাকত জাউভাত। তার মনোরম বিবরণ রয়েছে রবীন্দ্র স্নেহধন্যা রানী চন্দের স্মৃতিকথায়— ‘সকালবেলা এক মামী রান্নাঘরে ঢুকে বাসী কলসির জল ফেলে নতুন জল তুলে উনুন ধরিয়ে এক হাঁড়ি ভাত বসিয়ে দেন সব কাজের আগে। ক্ষেতের চাল— সুগন্ধি চাল; চাল ফুটতে না ফুটতে সৌরভ ছড়ায়। দিদিমা এ গাছ-ওগাছ থেকে বেগুনটা ঢেঁড়সটা, লতা-আলুটি ছিঁড়ে আলু কয়েকটা তুলে দেন ভাতে দিতে। সঙ্গে থাকে সরের গাওয়া ঘি। ছোট-বড় সকলে এই গলা ভাত খেয়ে ঠান্ডা হয়ে যে যার মতো কাজে হাত দেয়। জাউভাতের সঙ্গে সদ্য জ্বাল দেওয়া ঘন খেজুর রস— অমৃত। সুরভিত রস, সুবাসিত চাল— দুই মিলিয়ে এক প্রাণমাতানো সম্ভার।’’ রানী চন্দ লিখেছেন পূর্ববঙ্গে তাঁর মায়ের বাপের বাড়ির কথা। আর বিবেকানন্দ তো খাস উত্তর কলকাতার মানুষ। অর্থাৎ, বিগত শতকের অবিভক্ত বাংলায় বাঙাল-ঘটি নির্বিশেষে গ্রামে বা শহরে ভাত বা ফেনাভাতের সঙ্গে খেজুর রসের এমন এক কম্বিনেশন বেশ জনপ্রিয় ছিল। প্রশ্ন জাগে, এমন রসের খাওয়া বাঙালি ভুলল কবে থেকে?
আধুনিক যুগের শহুরে বাঙালি এবং শহুরে হয়ে ওঠার বাসনা-তাড়িত আজকের গ্রামের অধিবাসীরা তো ভুলেছে এমন কত কিছুই। পৌষ সংক্রান্তির আগে গ্রামের ঘরে ঘরে সব চেয়ে বেশি যেটা শোনা যেত, তা হল, ঢেঁকিতে পার দেওয়ার আওয়াজ আর তার সঙ্গে ঢেঁকির গান। গ্রামে গ্রামে ঢেঁকিতে গানের সুরের ছন্দে চাল গুঁড়ো করার ছবিও গ্রামবাংলার এক চিরন্তন বৈশিষ্ট্য। কিন্তু নগরায়নের দাপটে সবই আজ হারিয়ে গেছে। ছাতু কোটা, চিঁড়ে কোটা, মুড়ি ভাজা— এ সব তো আর আজকের মতো মেশিনে নয়, সব হত গ্রামের ঘরে ঘরে। রাসায়নিক সার, কীটনাশক দেওয়া ‘হাইব্রিড’ নয়, দেশি পদ্ধতিতে চাষ করা যব থেকে ছাতু ও নানা জাতের ধান থেকে হত চিঁড়ে-মুড়ি। সব ধানের চালে মুড়ি ভাল হয় না। পূর্ববঙ্গে মিষ্টি স্বাদের মুড়ি হত ঘিগজ, ভুসিয়ারা ধানের চাল থেকে। উত্তরবঙ্গে তুলাইপাঞ্জি, কালোনুনিয়ার মতো সুগন্ধি নাগেশ্বরী ধানের চাল থেকে মাটির হাঁড়িতে শুধু লবন ও বালি দিয়ে ভাজা মুড়ির স্বাদই আলাদা। আবার সুন্দরবন এলাকার ভাটি অঞ্চলে হোগলা, হামাই, ঘিওস কিংবা সুগন্ধি কানাইশাল বা দাদশাল ধানের চাল থেকে হাতে ভাজা মুড়ির বিশেষ কদর।
চিঁড়ে কোটা, মুড়ি ভাজার অনুপুঙ্খ বর্ণনা রয়েছে রানী চন্দের লেখায়। ভেজানো ধান খোলায় ভাজার সময় পুট পুট করে উঠলে, গরম থাকতে থাকতে তাকে পিটিয়ে চ্যাপ্টা করলেই চিঁড়ে হয়। সুগন্ধি ধানের সেই গরম চিঁড়ে খাওয়ার অভিজ্ঞতাও অনন্য। আবার সুন্দর করে ভাজা মুড়িকে তিনি তুলনা করেছেন মুক্তোর নোলকের সঙ্গে। আর তা যে কতই সুস্বাদু ছিল বোঝা যায় যখন তিনি লেখেন যে, বাড়িতে যে দিন মুড়ি ভাজা হত সে দিন তাঁরা টাটকা গরম মুড়ি খেয়ে কাটিয়ে দিতেন। বেতের নিশ্ছিদ্র সাজিতে দফায় দফায় তাঁরা মুড়ি খেতেন দিদিমার তৈরি ঝাঁঝালো কাসুন্দি মেখে, তেল নুন লঙ্কা মেখে, মুলো ছেঁচে, ক্ষোতের কচি মটরশুঁটি দিয়ে এবং অবশ্যই ঘন করে জ্বাল দেওয়া খেজুর রস দিয়ে।
চিঁড়ে কোটা, মুড়ি বা খই ভাজার মতো, শীতকালে খেজুর রস জ্বাল দিয়ে সারা বছরের জন্যে গুড়ও তৈরি হত বাড়িতেই। বিরাট উঠোনের ধারে এই সব কাজের জন্যে বসানো থাকত ‘দো-আখা’ উনুন। তাতে দু’মুখে আগুন ওঠে একই জ্বালানি থেকে। গ্রাম বাংলায় শীত পড়তে না পড়তেই বিভিন্ন সম্পন্ন গৃহস্থের বাড়িতে খেজুর গাছ কাটতে হাজির হত ধরা-বাঁধা গাছি বা শিউলি। কোমরে মোটা দড়ি বেঁধে কাস্তে কাটারি পিঠের দিকে গুঁজে গাছি-ভাই গাছ বেয়ে উঠে যায় উপরে। পুরনো, মরা ডাল কেটে সাফ করে। একটানা কড়া শীত পড়লে আবার আসে অন্ধকার থাকতে। বাড়ির সবাই শুকনো কাঠি-পাতার আগুন জ্বালিয়ে তাপ নিতে নিতে বসে থাকে খেজুর গাছের নিচে। কাঁসার বাটি-গেলাস কোলে নিয়ে। গাছি-ভাই গাছে উঠে এক একটা রসের হাঁড়ি নামিয়ে সবার হাতে ধরা পাত্রে রস ঢেলে দেয়। ঠান্ডায় হি-হি করে কাঁপতে কাঁপতে ভোরের আবছা আলোয় সেই রস পানের অনুভূতি স্বর্গীয়। মাটির কলসি কলসি ভাগের রস সেই সকালেই চলে আসে বাড়ির উঠোনে। খেজুর গাছ ঝুরনো, গাছ কাটা থেকে হাঁড়ি বাঁধা, হাঁড়ি নামানো সব কাজ গাছির। রস অর্ধেক গৃহস্থের, অর্ধেক তার। এমনই ছিল সেকালের হিসেব।
আজকাল গ্রাম বাংলার নানা প্রান্তে গুড়ের শালে দেখা যায় বড় বড় আয়তাকার ধাতব পাত্রে রস থেকে গুড় জ্বাল দেওয়ার চিত্র। সেই সব রসের মান নিয়ে বিস্তর অভিযোগ। কোথাও গাছে বাঁধা হাঁড়িতে আগে থেকে চিনি রাখা থাকছে, কোথাও রস জ্বাল দেওয়ার সময় মেশানো হচ্ছে চিনি, নলেন গুড়ের রাসায়নিক ‘এসেন্স’ আর ফটকিরি। নকল রস, নকল গুড়। আর সেই গুড় দিয়ে তৈরি পিঠে-পায়েসই হোক, মোয়া বা মিষ্টি, সবেতেই ভেজালের স্বাদ। কিন্তু আগেকার দিন ছিল আলাদা। সেখানে ভেজালের কোনও কারবার ছিল না। খাঁটি জিনিস, অনন্য স্বাদ-গন্ধ। গাছ থেকে নামানো রস জ্বাল দেওয়া হত লোহার কড়ায়। খেজুর গাছের শুকনো ডালপালা, ধানের তুষ, খেতে ধান কাটার পরে থেকে যাওয়া ধান গাছের গোড়া বা নাড়া, কাঠ কুটো ঠেলে দেওয়া চলত দো-আখায়। জলের মতো স্বচ্ছ রসে রং ধরানো ছিল ধৈর্যের পরীক্ষা। নিষ্ঠার সঙ্গে বহু ক্ষণ জ্বাল দিতে হয়। সূর্য ওঠার আগে রস ফুটে ওঠা চাই। বেলা হলেই গুড় লাল হয়ে যায়। সোনার মতো রঙের নলেন বা পাটালি হলে, সবার আনন্দ আর পরিশ্রম সার্থক। সেই সময় খেজুর রস থেকে গুড় করা ছিল রীতিমতো পারিবারিক উদ্যাপন। তাতে বাড়ির মেয়ে-বৌদের সোৎসাহ অংশগ্রহণ। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এমন সব বিনা পারিশ্রমিকের কাজে নারী নিপীড়নের বয়ান তখন অজানা ছিল। সেই সুখী গৃহকোণে তৈরি হত গুড়ই বা কত রকমের! রস জ্বাল দিতে দিতে ঘন হয়ে এলে তাতে নারকেল কোরা মিশিয়ে নাড়া হয়। তারপরে নারকেল মালার হাতায় করে গরম ঘন রস মাটির ছাঁচে ঢালা হয়। ঠান্ডা হয়ে জমাট বাঁধলে ছাঁচ থেকে সাবধানে বার করে নেওয়া হয় নারকেলি পাটালি। ক্ষীর মিশিয়ে ক্ষীর পাটালি। এলাচ-কর্পূর দিয়েও শৌখিন গুড়। সুপুরি গাছের পাতার খোলে শুধু রস ঢেলে হয় মুছি গুড়। পিঠে-পায়েস, সন্দেশ বানাতে লাগে। বছরভর পাটালি ভালো থাকে মুড়ির টিনে ঢুকিয়ে রাখলে। গলে যায় না, শক্ত থাকে। মুড়ি মিইয়ে গেলে সেই মুড়ি বদলে দিতে হয়।
আজকাল ভেজাল গুড়ে ছেয়ে যাওয়া দোকান-বাজার দেখে হারিয়ে যাওয়া সেই সময়ের কথা মনে পড়ে। ভেবে অবাক হই, প্রাকৃতিক সম্পদ কাজে লাগিয়ে খেজুর গুড় তৈরির কী অসামান্য ঐতিহ্য ছিল এই বাংলায়। প্রচুর মুনাফা, লোভ আর অসততার এই যুগে সেলাম জানাতে হয় মোতালেফদের মতো কিংবদন্তিতুল্য গাছিদের, অতুলনীয় দক্ষতার যে চরিত্রটিকে বাংলা সাহিত্যে অক্ষয় করে রেখে গিয়েছেন নরেন্দ্রনাথ মিত্র তাঁর ‘রস’ গল্পটিতে। আর সেই গল্প অবলম্বনে তৈরি হিন্দি ‘সওদাগর’ ছবিতে অমিতাভ বচ্চন আর নূতনের অভিনয়ের গুণে খেজুর রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরির শিল্প বাংলা ও বাঙালির সীমানা ছাড়িয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছে বাইরের দুনিয়াতেও। শুষ্ক খেজুর গাছে অপার্থিব রসের সঞ্চারের রহস্যে মুগ্ধ হয়ে সাংবাদিক-কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত লিখেছিলেন—
‘হায় রে শিশির তোর কি লিখিব যশ। কালগুণে অপরূপ কাঠে হয় রস।। পরিপূর্ণ সুধাসিন্ধু খেজুরের কাঠে। কাট ফেটে উঠে রস যত কাট কাটে।। দেবের দুর্লভ ধন জীরণের ঘড়া। এক বিন্দু পান করি বেঁচে উঠে মড়া।।’’ খেজুর গাছকে তিন দিন বিশ্রাম দিয়ে জিরেন কাটের রস এক বিন্দু ঠোঁটে ছোঁয়ালেই মৃত ব্যক্তি জীবন ফিরে পায়, কবি কল্পনায় এমনই তার মহিমা। কিন্তু গাছ থেকে রস, রস থেকে গুড় এবং সেই গুড় বেচে রোজগার করার পিছনে কী নিদারুণ পরিশ্রম, বাস্তব জ্ঞান, দক্ষতা ও নৈপুণ্য প্রয়োজন তার সাক্ষ্য রয়েছে ‘রস’ গল্পের আকর্ষণীয় কাহিনিতে— ‘বালিকাচায় ধার তুলে তুলে জুতসই করে নিতে হবে ছ্যান। তার পর সেই ধারালো ছ্যানে গাছের আগা চেঁছে চেঁছে তার মধ্যে নল পুঁততে হবে সরু কঞ্চি ফেড়ে। সেই নলের মুখে লাগসই করে বাঁধতে হবে মেটে হাঁড়ি। তবে তো রাতভরে টুপটুপ করে রস পড়বে সেই হাঁড়িতে। কেবল খাটতে জানলেই হয় না, গাছে উঠতে-নামতে জানলেই হয় না, গুণ থাকা চাই হাতের। যে ধারালো ছ্যান একটু চামড়ায় লাগলেই ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে মানুষের গা থেকে, হাতের গুণে সেই ছ্যানের ছোঁয়ায় খেজুর গাছের ভিতর থেকে মিষ্টি রস চুঁইয়ে পড়ে।’
সেকালে যেমন ছিল খেজুর গুড়, তেমনই অপর্যাপ্ত যোগান ছিল খাঁটি গরুর দুধের। সেই ‘লালচে রঙের সুগন্ধি’ দুধের কথা লীলা মজুমদারের গল্পে আছে। উনুনের পড়ন্ত আঁচে কড়ায় বসানো সেই দুধে ‘আধ ইঞ্চি পুরু সর পড়ত, সোনালি রং, তাতে চাঁদের গায়ের মতো ফুট ফুট দাগ।’ ঘরে ওঠা নতুন ফসল, নতুন আলু, নতুন সর্ষে ওঠার আনন্দ আর পর্যাপ্ত দুধ-ছানা-ক্ষীরের যোগানই কৃষি-নির্ভর গ্রামীণ সমাজে পৌষপার্বণকে করে তুলত মধুময়। পৌষ লক্ষ্মীকে ঘরে আনার জন্য ছিল নানা তোড়জোড়। কবিকণ্ঠে তারই আহ্বান—
‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে, আয় রে চলে, আয় আয় আয়।
ডালা যে তার ভরেছে আজ পাকা ফসলে, মরি হায় হায় হায়॥’
শঙ্খ আর উলুধ্বনির মাঝে ধানের মরাই থেকে গোবর ছড়া দিয়ে নিকানো উঠোনের তুলসী মঞ্চ, ঘরের দুয়ারে নিষ্ঠাভরে কুলো, সপ্তডিঙা মধুকর, প্যাঁচা, লক্ষ্মীদেবীর পা এবং ধানের ছড়ার আলপনা দিয়ে কড়ি ও গাছকৌটোয় ধান ভরে, দোরে দোরে ধানের শিসের বিনুনি শিকলে বেঁধে দেওয়ার মঙ্গলাচরণের মধ্যেই ছিল সুস্থায়ী, সুখী পরিবারে পিঠে-পুলির সম্ভারের বৈচিত্র্য ও সমৃদ্ধির প্রতিফলন। বাড়ির মেয়েরা আর ছেলেপুলেরা মিলে ছড়া কাটা হত— ‘আউনি বাউনি চাউনি / তিন দিন কোথাও না যেয়ো / ঘরে বসে পিঠে-ভাত খেয়ো।’ সকালের রান্নাবান্নার পাট তাড়াতাড়ি চুকিয়ে মা-ঠাকুমারা গোল হয়ে বসতেন পিঠে তৈরির কাজে। নিরামিষ উনুনে নতুন করে আঁচ পড়ত। মাটির সরায় করে প্রথমেই চাপানো হত আস্কে পিঠে বা ভাপা পিঠে। প্রথমটি আগুনে ফেলে নিবেদন করা হত ব্রহ্মাকে। তার পরে পাতে পড়ত পরিবারের সকলের। আনন্দের জোয়ারে পূর্ণ হিমেল পৌষ মাস বাঙালির কাছে আবহমান কাল ধরে একান্ত প্রিয়। তাই পৌষকে প্রলম্বিত করার আকুতি প্রকাশ পেয়েছে পল্লীবাংলার লোকজ ছড়ায়—
‘আইস পৌষ যাইয়ো না। মুখভার করি থাইকো না। ঘরের দাওয়ায় বসো। ধানের গোলায় বসো। কুটুম বাড়িতে বসো— সোনার পৌষিয়া। মোগর বাড়ি আসো পউষ, থাকো পউষ পিঠার ধামা লইয়া।।’
লক্ষ করার মতো বিষয় হল, পৌষ সংক্রান্তি মূলত একটি শস্যোৎসব। এশিয়ার ধান-প্রধান দেশগুলিতে চাল জাতীয় যত রকমের সুস্বাদু খাবারদাবার তৈরি হয়, তেমনটি সারা বিশ্বের আর কোনও শস্যদানা থেকে হয় না। আমাদের বাংলায় অগ্রহায়ণ মাসের শেষে হৈমন্তি ধান কাটার পর পৌষ পড়তেই শুরু হয়ে যায় নতুন ধানের বহু রকম খাবার বানানোর বিরাট আয়োজন। ঐতিহ্যসম্পন্ন পিঠে তার অন্যতম, যা ছিল শ্রীচৈতন্যেরও প্রিয়। উৎকলরাজ প্রতাপরুদ্রের সভা পণ্ডিত বাসুদেব সার্বভৌম পুরীতে নিজের বাড়িতে আমন্ত্রণ করে শ্রীচৈতন্যকে যে উপাদেয় খাদ্যে পরিতৃপ্ত করেছিলেন তার বর্ণনা রয়েছে শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’তে। সেই খাদ্য তালিকায় পিঠের বৈচিত্র্য ছিল অগুনতি—
‘মুদ্গবড়া, মাষবড়া, কলাবড়া মিষ্ট। ক্ষীরপুলি, নারিকেল পুলি আর যত পিষ্ট।। কাঞ্জিবড়া, দুগ্ধচিড়া, দুগ্ধ লকলকি। আর যত পিঠা কৈল কহিতে না শকি।।’
তবে পিঠেরও যে শ্রেণিবিন্যাস আছে তার ইঙ্গিত রয়েছে ‘ঠাকুরমার ঝুলি’তে পিটা-কুড়ুলির ব্রতে। সেখানে তো রানি আর দাসী দু’জনেই পিঠা গড়তে গেলেন। রানী করলেন ‘আস্কে পিটা, চাস্কে পিটা আর ঘাস্কে পিটা। দাসী চন্দ্রপুলি, মোহনবাঁশি, ক্ষীরমুরলি, চন্দনপাতা।’ মানুষ তখন সহজেই বুঝতে পারল কে আসলে রানি আর কে দাসী। সে তো নয় রূপকথা। পিঠার ফিরিস্তি রয়েছে কোনও কোনও ছড়ায়—
‘জামাই ভুলাইনা পিঠা কন্যা ভুলাইনা পিঠা শ্বশুর ভুলাইনা পিঠা ওকি -- পিঠার নাম টিয়াঠুঁটি পিঠার নাম একিবেকী।’
আগেকার দিনে প্রতিটি কন্যাকে মা-ঠাকুমার কাছে পিঠে তৈরি শিখতে হত। বিভিন্ন রান্নায় হাতেখড়িও হত এ ভাবেই। আর শুধু মিষ্টি পিঠে তো নয়, মাছ-মাংসের পুর ভরা নোনতা বা ঝাল পিঠের প্রচলনও আছে নানা অঞ্চলে। এক নববধূ যে ভাল পিঠে তৈরি করতে শেখেনি, তাকে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে পিঠে বানাতে হল। যে পিঠে সে তৈরি করল সেটি হল অতিরিক্ত ঝাল ও লবণে পোড়া। জামাই রাগ করে সে পিঠে খেল না। প্রচলিত ছড়ায় লোকমুখে উঠে এসেছে সেই প্রসঙ্গও—
‘পিঁয়াজের পাতা ঝিকিমিকি গোলাপ ফুলের বাসনা, কেন জামাই খাস না? যেমন তোমার রাঁধুনি তেমনি পিঠার বাঁধুনি, আমার মাইয়ে পিঠা বানায় গন্ধে ভরে গাঁ। কন্যা তোমার পিঠা খাইয়া বিলাই বলে না।।'
পাটিসাপটা-চিতই পিঠে-দুধপুলি-গোকুল পিঠে-কাঁকন পিঠে-ভাপা পিঠে-আস্কে পিঠে-সরুচাকলি-চন্দ্রপুলি-পাতসিজা ইত্যাদি পিঠের কত রকমারিত্ব। আবার এই সময়েই পয়রা গুড়ের রসে চোবানো বিউলির ডালের রসবড়াও অতুলনীয়। এ ছাড়াও রয়েছে কত রকমের আঞ্চলিক পিঠে। যেমন রাঢ়ভূমি বাঁকুড়ার শিলাবতী নদীর তীরে সিমলাপালের বৈশিষ্ট্য তার কাখরা আর গড়গড়া পিঠে। সেই পিঠে তৈরির চল উৎকল ব্রাহ্মণ পরিবারে। তার ইতিহাস স্বতন্ত্র। সে প্রসঙ্গ বারান্তরে। শুধু এটুকু এখানে বলা থাক, সুগন্ধি আতপ চালের মন্ডের খোলসে ছানা ও খোয়া ক্ষীরের পুর দিয়ে ঘিয়ে ভাজা কাখরা পিঠে আর নলেন গুড়ে পাক দেওয়া নারকেল কোরার পুর ভরা ভাপে সেদ্ধ গড়গড়া পিঠের স্বাদ অনবদ্য। ওড়িশার প্রভাব সম্পন্ন বিশেষ ধরণের এই দু’টি পিঠে আপাতত জিয়োগ্রাফিকাল ইন্ডিকেশন (জি আই) তকমা পাওয়ার অপেক্ষায়।
কিন্তু পিঠে-পুলির বিপুল বৈচিত্রসম্পন্ন পৌষপার্বণের আদত কৃষি সংস্কৃতি কি আমরা হারিয়ে ফেলেছি? পরিবারের স্নেহ-ভালোবাসায় বহু যত্নে বানানো নানা পিঠে-পুলি এখন শহুরে জীবনধারায় দোকানের পণ্য। সেখানেও আধুনিক ফিউশনের প্রভাব। নতুন প্রজন্মের কাছে তাই হয়তো বেশি জনপ্রিয় নলেন গুড়ের আইসক্রিম, চকোলেট পাটিসাপটা। কর্মব্যস্ত জীবনে বাড়িতে ঝক্কির পিঠে তৈরি যখন কষ্টকল্পনা, তখন বাঙালির নিয়মরক্ষায় দোকান আর পাড়ার পিঠে-পুলি উৎসবই ভরসা। ঐতিহ্যের শিকড় ভুলে যাওয়া নিরুপায় নাগরিক এখন কৃত্রিমতার গ্রাসে আচ্ছন্ন। আলপনা দেওয়া পল্লীর নিকানো উঠোন কিংবা ঘরে তৈরি পিঠে-পায়েসের স্মৃতির অস্তিত্ব এখন কেবল বাঙালির নস্টালজিক চেতনায়।