ছবি কথা বলে। ছবি: সংগৃহীত।
প্রতি শীতেই কলকাতা নতুন কিছু করে। পাতাঝরার মরসুমে শুধু শহর নয়, শহরতলির আকাশেও কান পাতলে শোনা যায় উৎসবের সুর। সাহিত্য, চলচ্চিত্র, শিল্প, সংলাপের জমকালো উদ্যাপনে শীত পোহায় সংস্কৃতিমনস্ক বাঙালি। এই শীতে বাঙালি মাতবে এক অন্য উৎসবে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই কলকাতায় বসবে ‘বেঙ্গল বিয়ানেল’-এর আসর। ৬ ডিসেম্বর, কলকাতায় শুরু হবে এই প্রদর্শনী। চলবে ৫ জানুয়ারি, ২০২৫ পর্যন্ত। কিন্তু কলকাতা একা নয়, শিল্পের এই উৎসবে শামিল শান্তিনিকেতনও। ২৯ নভেম্বর লাল মাটির দেশে এই প্রদর্শনীর সূচনা হয়েছে। চলবে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
শিল্পচর্চার পীঠস্থান ‘ল’বিয়েনেল ডি ভেনেজিয়া’ বিশ্বের নিরিখে অন্যতম প্রসিদ্ধ শিল্প উৎসব। অনেকেই ভেনিসের এই শিল্প প্রদর্শনীর বিষয়ে অবগত। ২০১৯ সালে পৃথিবীখ্যাত এই শিল্প প্রদর্শনীতে আমার তোলা ‘অ্যাংস্ট’ সিরিজ়ের মোট ৩৫টি ছবি দেখানো হয়েছিল। তখন সেই উৎসবের ব্যাপ্তি দেখে মনে হয়েছিল, আমার শহরেও এমন উদ্যাপন হলে ভাল হয়। অবশেষে সেটাই হতে চলেছে। তাই জোর দিয়ে বলতে পারি, অতীতে শিল্পের এমন উদ্যাপন দেখার সুযোগ হয়নি শহরের। প্রথম বারের জন্য সেই উৎসব হতে চলেছে কলকাতায়। মনে মনে তাই উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছি আমি।
কাজের সূত্রে দেশ-বিদেশের ভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতির বহু মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। কলকাতা আমার জন্মস্থান জানার পরে তাঁদের অনেকেই ঈর্ষান্বিত হয়েছেন। সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেছেন, কলকাতা-সহ গোটা বাংলা যে ভাবে শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা করে, তা এক কথায় অনবদ্য। এই সূত্রে শীতের কলকাতার একটা ঘটনার কথা ভীষণ মনে পড়ছে। নন্দনে তখন চলচ্চিত্র উৎসব চলছিল। আমি গিয়েছিলাম কাছের এক বন্ধুর পরিচালিত সিনেমা দেখতে। সঙ্গে ছিলেন আমার অন্য এক বন্ধু। দর্শকের লাইন তখন দীর্ঘ হতে শুরু করেছে। হঠাৎই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে। এমন সময় একজন বৃদ্ধ আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর হাতে কিছু পত্র-পত্রিকা। কথায় কথায় জানালেন, সেগুলি তাঁর স্ব-প্রকাশিত কবিতার বই। সেখান থেকেই একটি তিনি আমাকে দিতে চাইছিলেন। সমস্ত বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে আমার নিজের শহরের এমন সাধনা দেখে নতজানু হতে ইচ্ছে করে। ভারতীয় শিল্প এবং সংস্কৃতির প্রতি আমার শহর এবং রাজ্যের এই ভালবাসা, এই সাধনা চিরন্তন। সংস্কৃতি চর্চার এই আকরভূমির মুকুটে এ বার নতুন পালক। শান্তিনিকেতনে উৎসবের বাদ্যি বেজে গেলেও, ‘বেঙ্গল বিয়েনেল’-এর তোড়জোড় শুরু করেছে কলকাতা।
শান্তিনিকেতনের বিয়েনেল নিয়েও আমি কম উত্তেজিত নই। শান্তিনিকেতনের প্রদর্শনীতে রয়েছে শিল্পী সুধীর পট্টবর্ধনেj অনবদ্য কাজ। মিঠু সেন এবং সন্ন্যাসী লোহারের যৌথ উপস্থাপনায় পরিবেশিত হবে ‘আই অ্যাম অল চিকি’র মতো প্রযোজনা। থাকছে পুষ্পমালা এন-এর মতো বর্ষীয়ান শিল্পীর পারফরম্যান্স। আমি তো দীর্ঘ দিন ধরেই সারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাজের ভক্ত। এই প্রদর্শনীতে শিল্পীর সঙ্গে জোট বাঁধবেন নোবেল প্রাপক অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়।
ভারতীয় ফোটোগ্রাফি শিল্পে দয়ানিতা সিংহ একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। সদ্য সদ্য যখন ছবি তুলছি, প্রথম ওঁর ছবির প্রদর্শনী দেখেছিলাম পার্ক স্ট্রিটে। এত বছর পরেও সেই মুগ্ধতা কাটেনি। কলকাতায় জাদুঘরে ওঁর তোলা ‘মিউজিয়াম অফ তানপুরা’ সিরিজ়ের প্রদর্শনী দেখার জন্য অধীর অপেক্ষায় রয়েছি। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলে আন্তর্জাতিক মানের শিল্পী প্রয়াত অঁরি কার্টিয়ার ব্রেসঁর ‘শ্রী অরবিন্দ আশ্রম’ সিরিজ়ের ছবির প্রদর্শনী হতে চলেছে। যাঁরা শিল্পীর কাজ আগে দেখেননি, তাঁদের জন্য এটি অনেক বড় একটি সুযোগ। তা ছাড়াও কলকাতার প্রদর্শনীতেও থাকছে অন্য তাবড় সব শিল্পীদের অসাধারণ কিছু শিল্পকলা। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সুনয়নী দেবীর চিত্রকলা প্রদর্শিত হবে। শিল্পময় শীতকালের আঁচে মন সেঁকে নেওয়ার এমন সুবর্ণসুযোগ শিল্পeনুরাগী বাঙালি এর আগে পেয়েছেন কি না, তা নিয়ে সত্যিই আমার সন্দেহ আছে।
(লেখক): আলোকচিত্রী। ২০২১ সালে আনন্দবাজার অনলাইনের ‘বছরের বেস্ট’ সম্মান প্রাপক।