Celebrity Interview

‘কলকাতা মানেই উন্নত চিন্তা আর শিল্প’, শহরে এসে বললেন রেখাকে উমরাও জানে রূপান্তরকারী মুজফ্‌ফর

কলকাতায় এসেছেন ‘উমরাও জান’ ছবির পরিচালক মুজফ্‌ফর আলি। সঙ্গে স্ত্রী মীরা আলি। দু’জনে মিলে ফ্যাশন দুনিয়ায় নাম করেছেন তিন দশক হল। আলাপচারিতায় বসলেন আনন্দবাজার ডট কমের সঙ্গে।

Advertisement
সুচন্দ্রা ঘটক
শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০২৫ ১৭:৪৩
আশির দশকে রেখাকে ‘উমরাও জান’ হিসাবে দেখিয়ে উনিশ শতকের এক অন্য রকম ইতিহাসের সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়েছিলেন মুজফ্ফর আলি।

আশির দশকে রেখাকে ‘উমরাও জান’ হিসাবে দেখিয়ে উনিশ শতকের এক অন্য রকম ইতিহাসের সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়েছিলেন মুজফ্ফর আলি। গ্রাফিক— আনন্দবাজার ডট কম।


Advertisement

যা দেখব, যা নিয়ে চলব, যার সামনে বসে কথা বলব— সব কিছু থেকেই তো নতুন কিছুর সৃষ্টি হয়! শিল্প আসলে জীবন। আলাদা কিছু নয় মোটেই! কলকাতায় এসে এমন কথা বার বার মনে হয় মুজফ্‌ফর আলির। কথোপকথনে যে প্রসঙ্গই উঠে আসুক না কেন, তা শিল্পে গিয়েই থামে লখনউয়ের নবাব পরিবারের সন্তান চলচ্চিত্রকার তথা পোশাকশিল্পী তথা চিত্রশিল্পী তথা কবির সঙ্গে আলাপচারিতায় বসলে।

আশির দশকে রেখাকে ‘উমরাও জান’ হিসাবে দেখিয়ে উনিশ শতকের এক অন্য রকম ইতিহাসের সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়েছিলেন আমদর্শকের। তার পর গড়িয়েছে সময়। নানা ধরনের শিল্পমাধ্যম নিয়ে কাজ করেছেন মুজফ্‌ফর। গত ৩৫ বছর ধরে তাঁর সংস্থা ‘হাউস অফ কোটওয়ারা’ তৈরি করেছে চিকনকারি-জরদৌসির বধূ-বস্ত্র, যা অওধি সংস্কৃতির অভিজ্ঞান হিসাবে মেক্সিকো থেকে মহারাষ্ট্র কাঁপাচ্ছে। তবে তিনি সামনে এসে বসলে লখনউ ঘরানার সাজে উমরাওরূপী রেখার কথা এখনও মনে পড়তে বাধ্য। ‘উমরাও জান’ ছবির সৃষ্টির প্রসঙ্গ সে ক্ষেত্রে অনিবার্য। মুজফ্‌ফর শুধু বলেন, ‘‘উমরাও তো শিল্পই!’’

গত ৩৫ বছর ধরে তাঁর সংস্থা ‘হাউস অফ কোটওয়ারা’ তৈরি করেছে চিকনকারি-জারদৌসির বধূ-বস্ত্র।

গত ৩৫ বছর ধরে তাঁর সংস্থা ‘হাউস অফ কোটওয়ারা’ তৈরি করেছে চিকনকারি-জারদৌসির বধূ-বস্ত্র। ছবি: ইনস্টাগ্রাম।

এ কাল-সে কাল এক করেছেন রুপোলি পর্দা থেকে ক্যানভাস হয়ে বস্ত্রের শিল্পে। পুরাতনের সঙ্গে নতুনের যোগাযোগ শিল্পে ধরে রেখেছেন। এখনও সে কাজই করে চলেছেন। কলকাতা শহরে এসেছেন তেমনই কাজে। সুফি সঙ্গীত ঘিরে ‘জাহান-এ-খুসরো’ নামে দিন তিনেকের অনুষ্ঠান করেন স্ত্রী মীরা আলির সঙ্গে। দেশ-বিদেশের নানা শহরে দেখিয়েছেন সে কাজ। এ বার কলকাতাকেও দেখাতে চান। মুজফ্‌ফর ও মীরার বক্তব্য, প্রত্যেক সময়ের শিল্পে দর্শন ও সংস্কৃতি নিজ নিয়মে তুলে ধরা হয়। তা সকলের কাছে পৌঁছে দিতে পারলে ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা সম্ভব।

স্ত্রী মীরা আলির সঙ্গে মুজফ্ফর আলি।

স্ত্রী মীরা আলির সঙ্গে মুজফ্ফর আলি। ছবি: ইনস্টাগ্রাম।

কথা গড়াতে থাকে। ধীরে ধীরে সিপিয়ারঙা হয়ে আসা আকাশ তখন দেখা যাচ্ছে বিলাসবহুল হোটেলের কাচের জানলার ও পারে। আশি পার করা শিল্পী সাংবাদিকের সঙ্গে গল্প করতে করতে মাঝেমধ্যে জানলার দিকে তাকাচ্ছেন। উল্টো দিকে বসে থাকা পোশাকশিল্পী-স্থপতি মীরা আকাশের ছবি তুলছেন। মুজফ্‌ফর বলেন, ‘‘যেখানেই যাই, আগে স্থানীয় সৃষ্টি যেমন দেখি, তার সঙ্গে দেখি চারপাশটা। কলকাতায় এলে তা করতেই ভাল লাগে। এ শহরটা তো উন্নত চিন্তা আর শিল্পের ঐতিহ্য বহন করে।’’

তাঁদের ‘হাউস অফ কোটওয়ারা’ ১৯৯০ সাল থেকে লখনউয়ের সাবেক ধারার সাজকে দুনিয়ার কাছে তুলে ধরছে সমকালের শিল্পের প্রেক্ষাপটে। চিকনের কাজ করা লেহঙ্গা-আনারকলির সাজ হোক বা জরদৌসির সূক্ষ্ম কাজে পশ্চিমি কায়দার পোশাক— সবেই যে আধুনিক কনেদের মন কেড়ে নেওয়া যায়, তা দেখিয়ে দিয়েছেন নিজেদের পৈতৃক ভিটের নামে নামকরণ করা সংস্থার মাধ্যমে।

মীরা বলেন, ‘‘ফ্যাশনজগৎ তো দেশের নানা প্রান্তের সাবেক সাজ তুলে ধরছে। তা সে মুখ ঢাকা ঘোমটা হোক বা ভারী গয়না।’’

মীরা বলেন, ‘‘ফ্যাশনজগৎ তো দেশের নানা প্রান্তের সাবেক সাজ তুলে ধরছে। তা সে মুখ ঢাকা ঘোমটা হোক বা ভারী গয়না।’’ ছবি: ইনস্টাগ্রাম।

লখনউয়ের ‘কোটওয়ারা হাউস’ নিজ চেষ্টায় সংরক্ষণ করেছেন মীরা। মুজফ্‌ফরের পৈতৃক ভিটে সেটি। বানিয়েছিলেন লখনউয়ের শেষ নবাব ওয়াজ়িদ আলি শাহ। তার পরে বহু প্রজন্ম পার। তারই মধ্যে নিজেদের অংশটি প্রায় সংগ্রহশালার মতো করে তুলেছেন ঐতিহ্য আগলে রাখায় মনোযোগী এই দম্পতি। তাঁদের ফ্যাশনের কাজ থেকে চলচ্চিত্র— সবেতেই কি সে কারণেই রয়ে যায় ইতিহাসের ছোঁয়া? মীরা বলেন, ‘‘আমরা হয়তো অনেক আগে থেকে সাবেক সাজ নিয়ে কাজ করছি, কিন্তু এখন তো সেটাই ট্রেন্ড। যে দিকেই দেখবেন, ফ্যাশনজগৎ তো দেশের নানা প্রান্তের সাবেক সাজ তুলে ধরছে। তা সে মুখ ঢাকা ঘোমটা হোক বা ভারী গয়না। ফলে নিজেদের আর বদলাতে হয়নি আমাদের।’’

মুজফ্‌ফর বলেন, ‘‘যেখানেই যাই, আগে স্থানীয় সৃষ্টি যেমন দেখি, তার সঙ্গে দেখি চারপাশটা।’’

মুজফ্‌ফর বলেন, ‘‘যেখানেই যাই, আগে স্থানীয় সৃষ্টি যেমন দেখি, তার সঙ্গে দেখি চারপাশটা।’’ ছবি: ইনস্টাগ্রাম।

মুজফ্‌ফর নিজের দর্শনের কথা বলেন। জানান, যে জায়গা থেকে আসছেন, সেখানকার স্মৃতি, আখ্যান, শিল্পকে সংরক্ষণ করা দায়িত্ব বলে মনে করেন তিনি। সে কারণেই কি রেখাকে নিয়ে 'উমরাও জান'-এর মতো লখনউয়ের এক তওয়াইফের কাহিনি-নির্ভর ছবি বানিয়েছিলেন মুজফ্‌ফর? অবলীলায় সহজ করে দেন শত শত বার উত্তর দেওয়া এক প্রশ্নকে। মুচকি হেসে বলেন, ‘‘শিল্পের সৃষ্টিতে অত পরিকল্পনা করা যায় কি? তখন রেখাকে কেউ সুযোগ দিচ্ছিল না, আমাকেও না। আমাদের দেখা হল, তাই ‘উমরাও জান’ তৈরি হল। ও তো উমরাও হওয়ার জন্য একেবারে তৈরিই ছিল।’’ তবে গল্প বললে তিনি ঐতিহ্য, ইতিহাসের কথা বলতেই পছন্দ করেন। ‘উমরাও জান’ সে ধারা বহন করেছে বটেই, মনে করিয়ে দেন নম্র লখনউভি ভঙ্গিতে কথা বলা মুজফ্‌ফর। জানান, তাঁর সব কাজ আসলে একে অপরের পরিপূরক।

কলকাতায় মুজফ্ফর ও মীরা।

কলকাতায় মুজফ্ফর ও মীরা। ছবি: সংগৃহীত।

এত বছর পেরিয়েও লখনউয়ের সংস্কৃতি, মানুষের জন্য কাজ করার কথা ভাবেন ওঁরা। মীরা যোগ করেন, ‘‘স্থানীয় নারীদের ক্ষমতায়নের কথাও সব সময়ে ভেবেছি আমরা। তাঁদের হাতের কাজ ও শিল্প যেমন গোটা বিশ্ব দেখছে, তেমন তাঁরাও স্বনির্ভর হচ্ছেন ‘হাউস অফ কোটাওয়ার’-এর সঙ্গে কাজের মাধ্যমে। নিজেদের এলাকার উন্নতি করা হচ্ছে সে দিক থেকে।’’ এ কাজে এখন হাত মিলিয়েছেন তাঁদের কন্যা সামা আলিও।

অওধের সাজ নিয়ে কাজ করা সংস্থা পথ চলা শুরু করেছিল ১৯৯০ সালে। তার আগে ১৯৮১-তে চারদিকে সাড়া ফেলে দিয়েছিল একগুচ্ছ জাতীয় পুরস্কার পাওয়া ছবি ‘উমরাও জান’। সেখানেও তো রেখার তেমনই সাজ ছিল। মুজফ্‌ফর কি তবে চলচ্চিত্র থেকে ফ্যাশনে, না কি ফ্যাশন থেকে চলচ্চিত্রে এলেন?

 মুজফ্ফর বললেন, ‘‘তখন রেখাকে কেউ সুযোগ দিচ্ছিল না, আমাকেও না। আমাদের দেখা হল, তাই ‘উমরাও জান’ তৈরি হল।’’

মুজফ্ফর বললেন, ‘‘তখন রেখাকে কেউ সুযোগ দিচ্ছিল না, আমাকেও না। আমাদের দেখা হল, তাই ‘উমরাও জান’ তৈরি হল।’’ ছবি: এক্স (সাবেক টুইটার)।

এ বার মুচকি হাসি। নবাবি ভঙ্গিতে কথা ভেসে আসে, ‘‘উত্তর যে নিজেই দিয়ে দিলেন! বিষয়টা আসলে ও রকমই। সব শিল্পমাধ্যমই একে অপরের পরিপূরক। একই সূত্রে সবটা বাঁধা। সেট সাজালাম, চরিত্রের ‘লুক’ তৈরি করলাম, তা শিল্প হল। আবার যাঁরা আমার ছবি দেখলেন, তাঁদের সাজালাম। সেটাও শিল্প। আমি আপনি কথা বললাম, নতুন শিল্পের সুযোগ তৈরি হল।’’

সত্যজিৎ রায় থেকে ঋত্বিক ঘটক, সকলের কথা মনে পড়ে মুজফ্‌ফরের কলকাতায় এসে। এই শহর তাঁকে শিল্পে অনুপ্ররণা জুগিয়ে এসেছে বরাবর। বলেন, ‘‘ফিরে ফিরে আসতে চেষ্টা করি। সব সময় হয় না। এলে খুব ভাল লাগে। এখানকার শিল্প আরও দেখতে চাই।’’ বাংলার মসলিনের কাজও টানে মুজফ্‌ফর আর মীরাকে। তবে এ তল্লাটের তাঁতিদের কাজ আরও বেশি করে দেখতে চান মুজফ্‌ফর। তার জন্য কলকাতার বাইরের কিছু জেলা ঘুরতে চান। এ বার এমন নানা ভাবনা নিয়ে এসেছেন। সব না করতে পারলে আবার আসবেন। কলকাতায় এলে তাঁর নিজের লখনউয়ের মতো ঐতিহ্যকে ধরে রাখার চেষ্টা চোখে পড়ে যে এখনও!

Advertisement
আরও পড়ুন