পোশাক শিল্পী সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়ও পুরুষদের জন্য তৈরি করেছিলেন কলিদার কুর্তা। ছবিতে তাঁরই নকশা করা পোশাকে মডেলরা। গ্রাফিক— শৌভিক দেবনাথ।
সেলিমেরা নতুন করে আনারকলির প্রেমে পড়ছেন! কিন্তু তাতে নতুন কী! সেলিমেরা তো যুগে যুগেই আনারকলির প্রেমে পড়েন, পড়ে থাকেন। নতুন কেন? কারণ, এ আনারকলি সে আনারকলি নয়।
মোগল সম্রাট আকবর-পুত্র প্রেমে পড়েছিলেন দরবারের নর্তকী আনারকলির। আর হাল আমলে সেলিমেরা আনারকলি পোশাকের প্রেমে পড়ছেন এবং পরছেনও। অর্থাৎ, পরিধান করছেন।
‘আনারকলি’ বা কলিদার (ঘেরদেওয়া) কুর্তা পরতেন রাজদরবারে নর্তকীরা। ‘মুঘল-এ-আজ়ম’ ছবির ‘প্যার কিয়া তো ডরনা কেয়া’ গানের দৃশ্য মনে করুন। স্বচ্ছ কলিদার কুর্তা পরে আকবরের দরবারে ঘুরে ঘুরে নাচছেন ‘আনারকলি’ মধুবালা। যত বার তিনি ঘুরছেন, তত বারই কুর্তার ঘের ফুলের মতো গোল হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে চারপাশে। আনারকলির নামে সেই কুর্তারও নাম হয়েছিল আনারকলি। এত দিন যার উপর আধিপত্য চালিয়েছেন নারীরাই। কিন্তু ‘ইউনিসেক্স’ ফ্যাশনের যুগে পুরুষেরাও ভাগ বসাচ্ছেন আনারকলিতে। বলিউডের রণবীর সিংহ থেকে শুরু করে আলি ফজ়ল, আয়ুষ্মান খুরানা, রাজকুমার রাও, বিজয় ভার্মা, এমনকি, টলিউডের টোটা রায়চৌধুরী, সৌরভ দাসেরাও আনারকলি কুর্তা পরে ক্যামেরার সামনে হাজির হয়েছেন। সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়, জে জে বাল্যর মতো পোশাকশিল্পীরা তৈরি করছেন পুরুষদের আনারকলি কুর্তা।
তবে পুরুষদের জন্য আনারকলির নামটা সামান্য বদলে নিয়েছেন পোশাকশিল্পীরা। আনারকলির কুর্তার পৌরুষ-করণ হয়েছে ‘ম্যানারকলি’ নাম নিয়ে। তা পরছেনও অনেকেই।
রণবীরের সিংহের কথাই ধরা যাক। দীপিকা পাড়ুকোনের সঙ্গে বিয়ের সকালে গায়েহলুদের সময়ে তাঁকে দেখা গেল বগরু প্রিন্টের গোলাপি রঙের আনারকলি পরে নাচতে। চোখে সানগ্লাস, ব্যাকব্রাশ করা চুল, জরির জ্যাকেট— সব দিব্যি মানিয়ে যাচ্ছে।
আবার বাজিরাও মাস্তানি ছবির প্রচারেও কদমছাঁট চুলে খয়েরি রঙের কলিদার কুর্তা পরে হাজির হয়েছিলেন রণবীর। বিয়ের রিসেপশনেও পরেছিলেন সাদার উপর সোনালি সুতোর কাজ করা ম্যানারকলি। রিচা চড্ডার স্বামী আলি ফজ়ল আবার সাদা আনারকলি পরেছিলেন একই রঙের হাঁটুঝুল জ্যাকেটের সঙ্গে। আয়ুষ্মান খুরানা, রাজকুমার, বিজয়ের মতো অভিনেতারা বরাবরই ফ্যাশনের বাঁধা গত ভেঙে এসেছেন নিজেদের পোশাকে। ম্যানারকলি শোভিত হয়ে ক্যামেরার সামনে ধরা দিয়েছেন তাঁরাও। বিজয় তো একটি পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানেও হাজির হয়েছিলেন আনারকলি পরে।
ইদানীং বহু ব্র্যান্ডই আনারকলির সম্ভার নিয়ে এসেছে পুরুষদের জন্য। কলকাতার কিছু কিছু দোকানে শেরওয়ানি, পাঞ্জাবি, কুর্তার পাশে শোভা পাচ্ছে ম্যানারকলি বা পুরুষদের আনারকলি। কেউ কেউ স্কার্ফ বা জ্যাকেটের সঙ্গে মিলিয়ে পরছেন সে কুর্তা। কলকাতার পোশাকশিল্পী অভিষেক রায় বলছেন, ‘‘আনারকলি পুরুষদের পোশাক হিসাবে ভাল লাগতেই পারে। বিশেষ করে একহারা লম্বাটে চেহারার পুরুষ, যাঁদের মুখের গড়নে খানিক ধারালো ভাব আছে, তাঁদের আনারকলি পরলে বেশ ভাল লাগবে।’’
আর এক পোশাকশিল্পী সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘আনারকলি তো সেই রাজারাজরাদের সময় থেকেই পরা হচ্ছে। একটা সময় তা পুরুষদের পোশাকের দুনিয়া থেকে বিস্মৃত হলেও পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি। পুরুষ কত্থকশিল্পীরা তো আনারকলি পরেই মঞ্চে নেচেছেন।’’ খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, কর্ণ জোহর পরিচালিত ‘রকি অউর রানি কি প্রেম কহানি’ ছবিতে টোটাও আনারকলি পরেছিলেন।
পুরুষদের পোশাকের ব্যান্ড অভীষ্টা বেনারসি, তসর এবং খাদির আনারকলি নিয়ে এসেছে পুরুষদের জন্য। ক্রিম, বেগনি, আশমানি, তসর, কালো, মাটিরঙা সেই সব আনারকলি নকশাহীন। পোশাক পরিকল্পকেরা বলছেন, শীতকালে কাশ্মীরি বা জামেভার শালের সঙ্গে এমন একটি আনারকলি পরে যে কোনও অনুষ্ঠানে গেলে তা আলাদা করে নজর কাড়বে। আবার এই ম্যানারকলিকেই একটু ‘ক্যাজুয়াল লুক’ দেওয়া যাবে খাদির জ্যাকেট, সুতির স্কার্ফ দিয়ে। তবে পোশাকশিল্পীরা আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন আনারকলির ‘প্রেমিক’দের জন্য। তাঁরা বলছেন, আনারকলি দেখে পরার শখ তো হতেই পারে। কিন্তু এই পুজোয় যদি আনারকলি পরে চমকে দেওয়ার ইচ্ছে থেকেই থাকে, তবে ‘সেলিমে’রা নিজের চেহারার দিকে একটু নজর দিন। তাঁরা এ-ও বলছেন, যে কোনও পোশাকই কাউকে মানাতে পারে, যদি তা ঠিক ভাবে ‘ক্যারি’ করতে পারেন।