Virtual World

অলস মস্তিষ্ক পচনের বাসা

এখানে ‘শয়তান’-এর নামান্তর ‘পচন’। কারণ সদ্য পেরোনো বছরের সেরা শব্দটি ছিল ‘ব্রেন রট’। কী ভাবে পচন ধরছে আমাদের মস্তিষ্কে?

Advertisement
সায়নী ঘটক
শেষ আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০২৫ ১০:২৯

সত্যজিৎ রায় দেখিয়েছিলেন, ‘মস্তিষ্ক প্রক্ষালন যন্ত্র’। অর্থাৎ মগজ ধোলাই। রাষ্ট্র বা ক্ষমতাশালী, বিত্তশালীদের শিখিয়ে দেওয়া বুলি তোতাপাখির মতো আউড়ে চলেছে সাধারণ জনতা। আমজনতার মগজ নানা ভাবে ‘ওয়াশড’ হতে হতে এখন তাতে রীতিমতো পচন ধরেছে! সদ্য পেরিয়ে যাওয়া বছরে অক্সফোর্ড ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে বেছে নিয়েছিল ‘ব্রেন রট’ শব্দটিকে। ইন্টারনেটের হীরক রাজ্যে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা কার্যত শূন্যে পর্যবসিত হওয়ার কথা বলা হচ্ছে এখানে। অর্থাৎ, প্রতিনিয়ত মুঠোফোন কিংবা কম্পিউটার স্ক্রিনের মাধ্যমে যে অবিরাম কনটেন্টের প্লাবনে ভাসছে আমাদের মন আর মাথা, তা আসলে অকেজো করে দিচ্ছে আমাদের চিন্তাশক্তি, স্মৃতিশক্তি, একাগ্রতা ও আরও অনেক কিছু। এক কথায়, অলস মস্তিষ্কে পচন ধরছে।

Advertisement

প্রাপ্তবয়স্করা তো বটেই, বিশেষ করে অপরিণত শিশুমন, তাদের মস্তিষ্ক অলক্ষ্যে নিয়ন্ত্রিত, আক্রান্ত হচ্ছে অনলাইন কনটেন্টের দাপটে। যে কনটেন্ট বেশির ভাগ সময়েই লঘু, চটকদার এবং ক্ষণস্থায়ী। এর ভয়াবহতা এখন উপলব্ধি করা গেলেও তা থেকে বেরোনোর রাস্তা জানা নেই। কিংবা জানা থাকলেও তা বাস্তবে প্রয়োগ করা কঠিন হয়ে পড়ে। কী ভাবে আটকানো সম্ভব এই ব্রেন রটিং? এর ভবিষ্যৎই বা কী?

পচন অনেক পুরনো

‘ব্রেন রট’ শব্দবন্ধের ব্যবহার কিন্তু আজকের নয়। শুধু আক্ষরিক অর্থে নয়, ব্যবহারিক জীবনেও কিন্তু এই মস্তিষ্কের অলসতা বহু দিনই গ্রাস করেছে আমাদের। এ প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সুহৃতা সাহা বলছেন, ‘‘আমরা অনেক সময়েই বিভিন্ন বিষয়ে ডিক্লাইনড থিয়োরিতে বিশ্বাস করি। অর্থাৎ, আগে সব ভাল ছিল, এখন খারাপ হয়ে গিয়েছে। এই ভাবে ডিনায়াল-এ থাকাটা কিন্তু ঠিক নয়। এটা মানতেই হবে, আমরা নিজেরাই এখন এমন অনেক কিছুতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি, যা থেকে পিছনে ফেরা সম্ভব নয়। ইন্টারনেটের ব্যবহারটাও সে রকমই। সুফল থাকার পাশাপাশি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মুখোমুখিও হতে হবে।’’ এ ক্ষেত্রে তিনি মনে করিয়ে দিলেন, কোচিং ক্লাসে মানেবই বা নোটসের কথা, যেখানে অনেক সময়েই শিক্ষার্থীকে গুলে খাইয়ে দেওয়া হয়। তার নিজস্ব চিন্তাশক্তি বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায় না।

‘‘ব্রেন রট বরাবরই ছিল, অন্য রূপে। এখন প্রযুক্তির মাধ্যমে তা আমাদের জীবনকে এতটা গ্রাস করেছে বলে বেশি করে আমাদের নিষ্কর্মা হয়ে পড়াটা চোখে পড়ছে। ওটিপি দিয়েই জীবনের সব প্রয়োজন মিটে যাচ্ছে, মাথা খাটানোর দরকার কমে আসছে,’’ বললেন তিনি।

তাৎক্ষণিকতায় সুখ

অলস মস্তিষ্ক সব সময়েই খুঁজে নিতে চায় তাৎক্ষণিক সুখ। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রিমা মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘‘অনলাইন কনটেন্ট আমাদের মস্তিষ্ককে গভীর ভাবে চিন্তা করতে বাধা দেয়। অনলাইন শপিং, অ্যাপের মাধ্যমে পছন্দের খাবার কিংবা পোশাকটা সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে যাওয়ার মধ্যে যে তাৎক্ষণিক তৃপ্তি রয়েছে, সেটা কিন্তু আদতে ভয়ঙ্কর। পরদিনই হয়তো মনে হচ্ছে, ওই পোশাকটা আমার দরকার ছিল না, অথচ কিনতে ইচ্ছে করছিল বলেই কিনে ফেলেছি। আবার যদি কেউ ইউটিউব দেখে কোনও রান্না শেখেন কিংবা গিটারের কর্ড প্র্যাকটিস করেন অথবা উল বুনতে শেখেন... তখন তাকে আর ব্রেন রটের পর্যায়ে কিন্তু ফেলা যাবে না।’’ অর্থাৎ আমরা ‘কী’ দেখছি, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

মানুষ গড়ার সময়

এই আলোচনা বিশেষ করে ছোটদের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডেভেলপমেন্টাল স্টেজে রয়েছে যে শিশু, তার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে এটি। কোভিড-পরবর্তী সময়ে শিশুদের হাতে হয়তো মোবাইল দিতেই হয়েছে, অনলাইন ক্লাস করার জন্য। তবে সেই গ্যাজেটে যদি আটকে পড়ে শিশুটি, তা হলে তার বেসিক সোশ্যাল স্কিলগুলোই তৈরি হবে না।

যে বয়সে কথা বলা শেখার কথা, আর পাঁচটা বাচ্চার সঙ্গে খেলা, ভাব, আড়ি ইত্যাদি নিয়ে থাকার কথা, সে যদি হাতে একটা ফোন পেয়ে যায়, বাড়ি থেকে বেরোনোর ইচ্ছেটাই তৈরি হবে না। কমিউনিকেশন, ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাকুইজ়িশনে ঘাটতি পড়ে যাওয়া পরোক্ষে প্রভাবিত করবে তার পড়াশোনাকেও। একটানা মন দিয়ে কোনও কিছু করার অভ্যেস তৈরিই হবে না। কল্পনাশক্তি দুর্বল হয়ে পড়বে। ‘‘অনলাইন গেমে সে বেশির ভাগ সময়ে নিজের জয়-পরাজয় নিয়ন্ত্রণ করছে। খেলার মাঠে যে হারতেও হয়, দল বেঁধে খেলার যে মজা... এগুলো কিছুই সে জানবে না,’’ বললেন চিকিৎসক রিমা মুখোপাধ্যায়।

অভিভাবকের ভূমিকা

অঞ্জন দত্ত যেমন বলেছিলেন ‘টিভি দেখো না’, সেটাই একটু বদলে নিয়ে আজকালকার মা-বাবারা সন্তানদের বলছেন, ‘ফোন দেখো না’। কিন্তু নিজেরা অবসর সময়ে সেই ফোনেই সিরিজ়-সিনেমা দেখছেন। সমাজতত্ত্ববিদ এবং মনোবিদরা বলছেন, শুধু ‘দেখো না’ বলে ঘ্যানঘ্যান করলে আদতে কোনও লাভ হবে না। সেই শিশুকে মুঠোফোনের বিকল্প হিসেবে এমন কিছু দিতে হবে, যা তাকে আকর্ষণ করবে। বিকেলে বা ছুটির দিনে ছোটদের নিয়ে বেড়াতে বেরোলে কিংবা কোনও খেলাধুলোয় তাকে যুক্ত করলে আপনা থেকেই তার অ্যাক্টিভিটি বাড়বে। ফোন বা টিভির সামনে বসিয়ে দেওয়াটা ব্যস্ত মা-বাবার পক্ষে সহজতর অপশন হলেও তা সন্তানের পক্ষে ভাল নয়। বেড়াতে গেলে ট্রেন, বাসের বাইরেটা দেখতে দেখতে যাওয়ার মুগ্ধতা যদি রিলস দেখায় বা সেলফি তোলায় সীমিত হয়ে পড়ে, তা হলে মুশকিল। মনে রাখতে হবে, সন্তানকে সারাক্ষণ বিনোদন জুগিয়ে চলা মা-বাবার দায়িত্ব নয়। ছোটদের জিজ্ঞাসু মনকে নিজের মতো করে বিকশিত হতে দিন।

সন্তানকে আগলে চলার পাশাপাশি অভিভাবকদের নিজেদের দিকেও তাকানো দরকার। প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে এই আসক্তি নিয়ন্ত্রণ করা দ্বিগুণ কঠিন। অধ্যাপক সাহা বললেন, ‘‘সোশ্যাল মিডিয়ায় সমানে যে ফিডগুলো আসে, আমাদের যা দেখাতে চাওয়া হচ্ছে, তাই গিলছি আমরা। সত্যি তো এখন ‘ক্রিয়েট’ করা যায়। আমরা আজকাল ঝগড়া করি না। কারণ কথাবার্তাই কমে এসেছে, ঝগড়াটা হবে কোথা থেকে? অন্যের সঙ্গে তর্ক করার ধৈর্য হারিয়ে গিয়েছে আমাদের। সেই জায়গায় এক প্রকার ঔদাসীন্য চলে এসেছে। এর ফলে স্বাভাবিক ভাবেই একাকিত্ব, অবসাদ বাড়ছে।’’

তবে উপায়?

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রিমা মুখোপাধ্যায় জানালেন, অনলাইন কনটেন্টের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তির সমস্যা নিয়ে যাঁরা তাঁর কাছে আসেন, তাঁদের চিকিৎসা করার আগে প্রথমেই কারণ খোঁজা হয়। অর্থাৎ, কেন এই আসক্তি? ‘‘সকলের ক্ষেত্রে মোবাইল অ্যাডিকশনের কারণ এক নয়। কারও কাছে এটা একটা এসকেপ রুট। পরিশ্রমসাধ্য, কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হতে চায় না বলে এই সহজ রাস্তাটা সে বেছে নিয়েছে। আবার কারও একাকিত্ব কাটানোর প্রয়োজন মেটাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া চ্যাট। যাদের মনঃসংযোগ করায় সমস্যা রয়েছে, তারা অনেক সময়েই লঘু জিনিসপত্রে মন দিয়ে সময় নষ্ট করে। এ ভাবে বিভিন্ন মানুষকে বিভিন্ন ভাবে পর্যালোচনা করে তার পরে সেই মতো তাদের গাইড করার চেষ্টা করি আমরা,’’ বললেন চিকিৎসক রিমা মুখোপাধ্যায়।

তবে ব্রেন রট যে সব সময়ে দুর্গন্ধযুক্ত নয়, সে কথাও মনে করিয়ে দিলেন সোশিয়োলজিস্ট অধ্যাপক সাহা, ‘‘টেকনোলজির যে শুধুই কুফল রয়েছে, তা তো নয়। তবে টেকনোলজি না জানলেই আপনি ‘আনস্মার্ট’ বলে যে ধারণাটা চাউর করা হয়েছে, সেই ফাঁদে পা না দিলেই হল। স্মার্টফোন শব্দটার মধ্যেই তো সেই ইঙ্গিত রয়েছে। আমাদের সুফলটা নিয়ে বাকিটা বর্জন করতে জানতে হবে। একটা ক্রমাগত অভ্যেস তৈরি করতে হবে নিজেদের, সন্তানদেরও।’’

অর্থাৎ কোনও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নয়, রাশ রাখতে হবে নিজেদের হাতে। সে রাশ আলগা হতে দেওয়া যাবে না। তা হলেই মাথায়, মনে চেপে বসবে অদৃশ্য শত্রু। অজান্তেই নিয়ন্ত্রণ করবে মন, মাথাকে। নতুন বছরের রেজ়োলিউশন হোক এটাই, যাতে এই বছর-শেষে ‘ব্রেন রট’-এর মতো আর কোনও শব্দকে সেরার শিরোপা না পেতে হয়!

Advertisement
আরও পড়ুন