গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
পাহাড়ের বুকে বিস্তীর্ণ এলাকায় জুড়ে ঘন পাইন বন। সেই পাইন বনে ঘেরা সবুজ তৃণভূমি। দক্ষিণ কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ের এই বৈসরন উপত্যকা পর্যটকদের কাছে ‘মিনি সুইৎজ়ারল্যান্ড’ বলেই পরিচিত। রোদ ঝলমলে অলস দুপুরে সবুজে ঘেরা ওই উপত্যকায় বসে গল্প করে, ঘুরে বেড়িয়ে সময় কাটান পর্যটকেরা। পাইন গাছের ফাঁক দিয়ে দূরে তুষারাবৃত পাহাড়ও উপভোগ করা যায় সেখানে। অনেকে ঘোড়া সাফারিও করেন।
সেই বৈসরন উপত্যকাই ‘মৃত্যু উপত্যকা’য় পরিণত হল মঙ্গলবার! পাইন বন থেকে বেরিয়ে আসা জঙ্গিদের গুলিতে ঝাঁঝরা হলেন ২৬ জন। কিন্তু ওই এলাকাকেই কেন হামলার জন্য বেছে নিল জঙ্গিরা? অনেকের মত, পর্যটনস্থলটি বাদ দিলে, বৈসরন উপত্যকার আশপাশের এলাকা ভীষণই দুর্গম। মূলত এই কারণেই ওই জায়গাটি বেছে নিয়েছিল জঙ্গিরা। জায়গাটি ঘন পাইন বনে ঘেরা হওয়ায় জঙ্গিরা অনায়াসেই সেখানে লুকিয়ে থাকতে পেরেছিল। সবুজ তৃণভূমিতে পর্যটকদের ভিড় বাড়তেই তারা বেরিয়ে এসে হামলা চালায়।
অনন্তনাগ থেকে দু’টি রাস্তা দু’দিকে চলে গিয়েছে। একটি গিয়েছে শ্রীনগরের দিকে, অন্যটি পহেলগাওঁয়ের দিকে। পহেলগাঁওয়ের দিকে যাওয়ার ওই জাতীয় সড়ক ৫০১-এর উপরেই অমরনাথ যাত্রার বেসক্যাম্প পড়ে। ওই রাস্তার দু’পাশই পাইন বনে ঘেরা দুর্গম এলাকা। তার ভিতর দিয়ে একটিই মাত্র রাস্তা গিয়েছে, যেটি বৈসরন উপত্যকায় পৌঁছোয়।
হেঁটে বা ঘোড়ার পিঠে করে ছাড়া পহেলগাঁও থেকে বৈসরন উপত্যকায় পৌঁছোনো মুশকিল। অনেকটা খাড়া পাহাড় ভাঙার পরে এক সময়ে ছবির মতো সবুজ উপত্যকাটা চোখের সামনে বেরিয়ে পড়ে। পাইন-ঘেরা সেই প্রান্তরে পর্যটকেরা হেঁটে বা ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়ান। আবার শীতে বরফ পড়লে এই উপত্যকার চেহারা আলাদা। তখন স্কি করার মরসুম। স্থানীয়দের মুখে-মুখে জায়গাটার ডাকনাম হয়ে গিয়েছে ‘মিনি সুইৎজ়ারল্যান্ড’। মঙ্গলবার সেই প্রান্তর-লাগোয়া খাবারের দোকানগুলোয় ভিড় করেছিলেন পর্যটকেরা। অনেকে ঘুরছিলেন মাঠে। ছবি তুলছিলেন। তখনই হামলা।
কেউ কেউ মনে করছেন, পহেলগাঁও থেকে বৈসরন উপত্যকা পর্যন্ত যাওয়ার আর অন্য কোনও সংযোগকারী রাস্তা না থাকার কারণে ওই জায়গাটি জঙ্গিরা বেছে নিয়েছিল। তাঁদের মত, হামলাকারীরা বুঝেছিলেন, বৈসরণ উপত্যকায় হামলা চালালে, তৎক্ষণাৎ ভারতীয় সেনার পক্ষে সেখানে পৌঁছোনো সম্ভব হবে না। আর হামলাকারীরাও অনায়াসে আবার পাইন বনে ঘেরা জঙ্গলে মিলিয়ে যেতে পারবেন।
ঘটেছেও তা-ই। প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুযায়ী, মঙ্গলবার দুপুর আড়াইটে নাগাদ বৈসরনের একটি রিসর্টের সামনে ঘোড়ায় চড়ছিলেন কয়েক জন পর্যটক। বাকিরা ইতিউতি ছড়িয়ে খাওয়াদাওয়া, গল্প করছিলেন। আচমকাই জংলা পোশাক পরা, মুখ ঢাকা কয়েক জন সশস্ত্র জঙ্গি পাইন বন থেকে বেরিয়ে আসে। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, সামনে যে পর্যটককেই তারা দেখেছে, নাম-ধর্মপরিচয় জিজ্ঞেস করে কপালে গুলি করেছে। এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘‘অন্তত জনা পাঁচেক জঙ্গি এসে, ধীরেসুস্থে খুনগুলো করে আবার পাহাড়ি ঢাল বেয়ে চলে যায়। দেখে মনে হয়েছে, যেন ওরা আগে থেকে জানত, কোথায় যেতে হবে, কী করতে হবে, কাকে কাকে মারতে হবে।’’
হামলার দায় নিয়েছে পাক জঙ্গি গোষ্ঠী লশকর-ই-ত্যায়বার ছায়া সংগঠন ‘দ্য রেজ়িস্ট্যান্স ফোর্স’ (টিআরএফ)। গোয়েন্দাদের সন্দেহ, জম্মুর কিশতওয়ার এলাকা দিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে দক্ষিণ কাশ্মীরের কোকেরনাগ হয়ে বৈসরনে এসেছিল জঙ্গিরা। বস্তুত, জঙ্গিদের বিবৃতির সূত্র ধরেই গোয়েন্দাদের একাংশ মনে করছেন, সুনির্দিষ্ট আক্রোশের বশেই এই হামলা চালানো হয়েছে। ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের পরে উপত্যকার ব্যবসা-বাণিজ্যে বহিরাগতদের উপস্থিতি বেড়ে যাওয়া নিয়ে বিভিন্ন স্তরে ক্ষোভ জমছিল। তার জেরে এই হামলা হয়ে থাকতে পারে।