গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
পহেলগাম হামলার পরে সাত দিন কেটে গিয়েছে। অথচ জঙ্গিদের মুখের স্কেচ থাকা সত্ত্বেও হামলাকারীদের নাগাল পেতে (সেনা পরিভাষায় কনট্যাক্ট এস্টাবলিশমেন্ট) এখনও ব্যর্থ নিরাপত্তা বাহিনী। যা ফের তৃণমূল স্তরে গোয়েন্দা ব্যর্থতার দিকেই আঙুল তুলে দিয়েছে। যদিও একটি সূত্রের দাবি, কুলগামের কাছে ওই হামলাকারীদের চিহ্নিত করে নিরাপত্তাবাহিনী। গুলি বিনিময়ও হয় দু’পক্ষের। কিন্তু পালিয়ে যায় জঙ্গিরা। যদিও সেনার পক্ষ থেকে সরকারি ভাবে এ বিষয়ে কিছুই জানানো হয়নি।
হামলার পরের দিন, গত বুধবার শ্রীনগরের পুলিশ কন্ট্রোল রুমের সামনে দাঁড়িয়ে জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের এক পদস্থ কর্তা গা এলিয়ে দেওয়া ভঙ্গিতে দাবি করেছিলেন, ‘‘জঙ্গিরা পালিয়ে যাবে কোথায়! দু’-এক দিনের মধ্যে ওদের নিকেশ করে ফেলা হবে। জঙ্গিরা জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পালালেও রসদ সংগ্রহে গ্রামে তাদের আসতেই হবে। তখনই ওদের চিহ্নিত করা হবে।’’ কিন্তু নিরাপত্তা কর্তাদের সেই আশায় জল ঢেলে এখনও কোনও গ্রামে জঙ্গিদের দেখা গিয়েছে বলে গোয়েন্দা তথ্য হাতে আসেনি। যার দু’টি অর্থ হতে পারে বলেই মনে করছেন স্বরাষ্ট্র কর্তারা। প্রথমত, জঙ্গিরা চূড়ান্ত পর্যায়ের সতর্কতা বজায় রাখার জন্য খাবার সংগ্রহে গ্রামগুলিকে এড়িয়ে চলছে। বন্ধ রেখেছে মোবাইল-সহ যে কোনও ধরনের ডিজিটাল যন্ত্র। যাতে তাদের গতিবিধির খবর না ফাঁস হয়। দ্বিতীয়ত, জঙ্গিরা গ্রামে গিয়ে রসদ সংগ্রহ হয়তো করেছে, কিন্তু তৃণমূল স্তরে গোয়েন্দা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ায় জঙ্গিদের গতিবিধির বিষয়ে খবর পাচ্ছে না নিরাপত্তাবাহিনী।
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতে, পহেলগামের ভৌগোলিক পরিস্থিতি জঙ্গিদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। চারদিকে ঘন জঙ্গলের সুবিধা নিয়ে এক দিকে জঙ্গিরা কোকেরনাগ, কিস্তওয়ারের মতো দূরের এলাকাগুলিতে চলে যেতে পারে। কিস্তওয়ারের জঙ্গল, দুর্গম পাহাড়ের মাধ্যমে যোগাযোগ রয়েছে ডোডার। আর এক বার ডোডা পৌঁছলে সেখান থেকে কাঠুয়া পর্যন্ত চলে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে জঙ্গিদের। আবার জঙ্গলের আড়ালের সুযোগ নিয়ে সোনমার্গ বা বালতালেও পৌঁছে যেতে পারে জঙ্গিরা। গোয়েন্দাদের একটি সূত্রের মতে, পহেলগামে হামলার পরে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে পালানোর পর জঙ্গিরা প্রথমে নজরে আসে অনন্তনাগের হাপত নগরে (ওই হাপত নগরের বাসিন্দা আদিল শাহই পর্যটকদের প্রাণ বাঁচাতে জঙ্গিদের বন্দুক কেড়ে নিতে গিয়ে নিহত হন)। সেখান থেকে জঙ্গিরা জঙ্গলের ভিতর দিয়ে কুলগামের দিকে এগিয়ে যায়। যেখানে নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে গুলি বিনিময় হয় জঙ্গিদের। সূত্রের দাবি, শেষ দফায় তাদের ত্রাল ও তার পরে কোকেরনাগে দেখা গিয়েছে। তাই গোটা এলাকা ধরেই তল্লাশি চালাচ্ছে সেনা, আধাসেনা ওজম্মু-কাশ্মীর পুলিশ।
প্রশ্ন উঠেছে, ওই জঙ্গি হামলার তথ্য কি আগে থেকেই ছিল? স্বরাষ্ট্র সূত্র বলছে, বালুচ জঙ্গিরা জাফর এক্সপ্রেসে হামলা চালানোর পরেই নিরাপত্তা বাহিনীকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল যে, ভারতে হামলা হতে পারে। কিন্তু নিশ্চিত ভাবে বলা হয়নি কোথায়, কখন হামলা হতে পারে। প্রশ্ন উঠেছে, জঙ্গিদের এত নির্ভুল স্কেচ কোথা থেকে পাওয়া গেল? তা হলে কি জঙ্গিদের বিষয়ে আগে থেকেই তথ্য ছিল গোয়েন্দাদের কাছে! নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতে, কাশ্মীরে বিগত ছ’মাস ধরে দু’শোর কাছাকাছি জঙ্গি সক্রিয় ছিল। যাদের মধ্যে ৫০-৬০ জন বিদেশি। বাকিরা সকলেই স্থানীয়। কোন জঙ্গি কমান্ডার কোন এলাকায় সক্রিয়, সে বিষয়ে মোটামুটি সার্বিক তথ্য থাকে গোয়েন্দাদের কাছে। কিন্তু জঙ্গিদের লক্ষ্য যে বৈসরনের পর্যটকেরা, সে বিষয়ে কোনও তথ্য ছিল না গোয়েন্দাদের কাছে।
অথচ, প্রাথমিক তদন্তে নেমে আটক পহেলগামের একাধিক সহিস, সন্ত্রাসে মদতদাতা ‘ওভার গ্রাউন্ড ওয়ার্কার’-দের জেরা করে জানা যাচ্ছে, হামলার ক’দিন আগে থেকেই ওই এলাকায় ডেরা বেঁধেছিল জঙ্গিরা এবং হামলা যে হতে পারে, সে বিষয়ে জানা ছিল কিছু স্থানীয়ের। যাদের মধ্যে একাধিক সহিসও রয়েছে। অথচ এদের চিহ্নিত করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হন গোয়েন্দারা। সূত্রের মতে, মূলত পর্যটক, সহিস ও সন্ত্রাসে মদতদাতা আটক ব্যক্তি ছাড়া ঘটনার সময়ে তোলা ভিডিয়োর ভিত্তিতে জঙ্গিদের স্কেচ করা হয়। যদিও তাতেও সাফল্য অধরা এখনও।
প্রশ্ন উঠেছে ত্রিস্তরীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার ব্যর্থতা নিয়েও। জঙ্গি গতিবিধি রোখার প্রশ্নে জম্মু ও কাশ্মীরে ত্রিস্তরীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকে। নিয়ন্ত্রণরেখায় অনুপ্রবেশ রোখার প্রশ্নে থাকেন সেনা জওয়ানেরা।মধ্যবর্তী বৃত্তের দায়িত্বে মূলত সিআরপিএফ এবং স্থানীয় পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকে জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ। পহেলগামের হামলা থেকেই স্পষ্ট, তিনটি বৃত্তকে ভেদ করে নিখুঁত লক্ষ্যে আঘাত হেনেছে জঙ্গিরা। কেন তিনটি বৃত্তের একটিও ওই জঙ্গিদের বিষয়ে সতর্কবার্তা জারি করতে ব্যর্থ হল, কোথায় গাফিলতি ছিল, তা খুঁজে বার করে ভবিষ্যৎ হামলা রোখাই মূল চ্যালেঞ্জ অমিত শাহদের কাছে।