Sexual Assault in Assam

‘সব কাপড় খুলে ফেলার পরে লজ্জার বাকি কী থাকে!’ কলম ধরলেন অসমের সেই নির্যাতিতা

ওরা চেঁচাচ্ছে ‘অসভ্য, জংলি, কুলির জাত’। ওরা আমার তলপেটের নীচে মারছে লাথি। টানছে চুল। হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। চিৎকার করে কাঁদছিলাম, ‘আমায় বাঁচাও। এমন কোরো না।’ কেউ শোনেনি।

Advertisement
অসমের নির্যাতিতা
শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৩ ০৭:৪৫
Representational Image

প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

ওই তো পুলিশ দাঁড়িয়ে। দৌড়ে গেলাম তাঁদের দিকে। চেঁচাতে থাকি, ‘ওরা আমায় মারছে গো! বাঁচাও!’ সপাটে এসে লাগে লাঠির বাড়ি। ককিয়ে উঠি। ততক্ষণে ঘাড়ের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তিন-চারটে হাত। আমার ব্লাউজ, শাড়ি ছিঁড়ে দিচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি না এ কী ঘটছে আমার সঙ্গে! গুয়াহাটিতে, মন্ত্রীদের বাড়ির সামনে, প্রকাশ্য দিবালোকে, এ ভাবে নির্যাতন করতে পারে কেউ!

ওরা চেঁচাচ্ছে ‘অসভ্য, জংলি, কুলির জাত’। ওরা আমার তলপেটের নীচে মারছে লাথি। টানছে চুল। হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। চিৎকার করে কাঁদছিলাম, ‘আমায় বাঁচাও। এমন কোরো না।’ কেউ শোনেনি।

Advertisement

সব কাপড় খুলে ফেলার পরে লজ্জার বাকি কী থাকে! থাকে প্রাণের ভয়। যে ভাবে লাথি-ঘুষি এসে পড়ছিল, ভাবলাম আমার বাকি ভাইদের মতো আমার লাশও হয়তো পড়ে থাকবে গুয়াহাটির রাস্তায়। আর ফিরতে পারব না আমার বাড়িতে। মণিপুরের দুই মহিলার ভিডিয়ো যখন প্রথম দেখলাম, ২০০৭ সালের ২৪ নভেম্বর দিনটা ফিরে এল চোখের সামনে। যেমনটা আপনারাও দেখেছেন আমায়। রুক্ষ চুল উড়ছে। কালো-রোগা একটা নগ্ন শরীরের দৌড়ে চলারসেই ছবি।

আমিই সেই মেয়ে।

অসমের আদিবাসীদের তফসিলি জনজাতি ঘোষণার দাবিতে আদিবাসী ছাত্র সংগঠনের হয়ে সকাল থেকে জড়ো হয়েছিলাম দিসপুর সচিবালয়ের কাছেই, বেলতলার দিকে। দাদারা বলেছিল, সব অনুমতি নেওয়া আছে। শুধু স্লোগান দিতে হবে। মাত্র ১৬-১৭ বছর বয়স। উৎসাহ বিপুল। হঠাৎ আমাদের কয়েক জন এক বিধায়কের গাড়িতে আক্রমণ করায় শুরু হল ঝামেলা। পুলিশ ও জনতা আমাদের তাড়া করে। বাচ্চা কোলে মেয়েরা প্রাণ বাঁচাতে নালায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই জনতা ঘিরে ফেলে আমায়। ভরসা ছিল পুলিশ। কিন্তু সাহায্য চাইতে গিয়ে উল্টে পুলিশের কাছেই মার খেলাম। পরের ১ ঘণ্টা শুধু দৌড়েছি। একটু সাহায্য চেয়ে। কে যেন বুট জুতো পরেই আমার তলপেটের নীচে সপাটে লাথি কষাল। সেই ছবিও তো ফলাও করে বেরিয়েছিল কাগজে!

ঘণ্টাখানেক পরে আমার ধুঁকতে থাকা দেহটা দেখতে পেয়ে হাত বাড়িয়ে দেন বগীরাম বর্মণ নামে এক দোকানদার। নিজের টি-শার্ট খুলে আমায় পরিয়ে দেন। বলেন, ‘পালাও, সামনের মাঠের দিকে। ওখানে তোমাদের মানুষরা রয়েছে।’ অর্ধনগ্ন অবস্থায় মাঠে পৌঁছে ভেবেছিলাম, আশ্রয় পাব। বদলে ফের পুলিশের মার। আমায় ওই অবস্থায় দেখেও কান ধরে, হাঁটু গেড়ে বসিয়ে রাখা হয়েছিল।

এর পর কেটে গিয়েছে ১৬ বছর। নাহ্, কোনও দল, মহিলা কমিশন কেউ আমায় সাহায্য করেনি। আদিবাসী ভোটের দায়ে কমিশন (মণিসানা সিংহ কমিশন) করেছিল, লাভ হয়নি। সরকার মামলা করেছিল। এক বারই আমায় গুয়াহাটির আদালতে ডেকেছিল। তত দিনে অনেক পরে লোকমুখে খবর পেলাম, আমার মামলা ডিসমিস হয়ে গিয়েছে। আমায় কিচ্ছু না জানিয়ে! এতগুলো মানুষের স্পষ্ট ছবি থাকার পরেও মাত্র কয়েক জনকে ধরে জামিন দিয়ে দেওয়া হয়। আমাদের সেই আর্থিক ক্ষমতা নেই যে সুপ্রিম কোর্টে যাব।

সাংবাদিকদের ডাকলাম। কাজে দেয়নি। বেলতলা কাণ্ডের পরে মুখ্যমন্ত্রী বা বিরোধী দলের কোনও নেতা আমার জন্য একটা শব্দও খরচ করেননি। যে দাবিতে সেই দিনের আন্দোলন, সেই আদিবাসীদের অসমে আজ পর্যন্ত তফসিলি জনজাতির মর্যাদা দেওয়া হয়নি, শুধু ভোটের আগে মিলেছে ঝুটো প্রতিশ্রুতি।

মণিপুরের ওই দুই মহিলাও কি ন্যায়বিচার পাবেন? অভিজ্ঞতা বলছে, এখন ‘আহা-উহু’-র ঝড় বইলেও ন্যায়বিচার পাওয়া সহজ হবে না। মেয়েরা, বিশেষ করে জনজাতির মেয়েরা কি এ ভাবেই সহজবধ্য থেকে যাবে? ভোট ও রাজনীতি বাদে তাঁদের দাম থাকবে না? মণিপুর-কাণ্ড নিয়ে বিদেশেও প্রতিবাদ চলছে। পুলিশ অনেককে ধরেছে। তাদের ফাঁসি হোক। এরা পার পেয়ে গেলে সাহস বাড়তে থাকবে।

আসলে, নিজে নগ্ন হয়েছি বলেই রাজাদের নগ্ন চেহারা চিনতে পেরেছি। তাই ভাবি, মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এখনও কোন মুখে শাসন করছেন! প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে বলব, ‘বেটি বচাও’ স্লোগান আপনি বন্ধ করুন। তিন মাস হয়ে গেল কেন মণিপুরে যেতে পারলেন না? আর রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু? কেন মহিলা হয়েও আপনি চুপ? আপনিও তো আদিবাসী। আপনার হাতে অনেক ক্ষমতা। আপনি চুপ থাকলে মেয়েরা বিশ্বাস হারিয়ে ফেলবে যে!

ওই ঘটনার পরে বেশ কয়েক বার গুয়াহাটি গিয়েছি। যাতায়াতের পথে ওই এলাকা দিয়ে যেতেই হয়। শিরদাঁড়া বেয়ে প্রতি বার একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। আসলে এই সব ঘটনার একটাই ভবিতব্য। প্রথমে সহানুভূতি, পরে রাজনীতি আর শেষ পর্যন্ত বিস্মৃতি। তাই কোনও দল-সংগঠনের পরোয়া না করে ভাবছি নিজেই মণিপুরে দুই কন্যার হয়ে রাস্তায় নেমে পড়ব। আবারও। হাতে থাকবে প্ল্যাকার্ড। মুখে স্লোগান।

মণিপুরের বোনেরা। আমিও তোমাদেরই মতো এক মেয়ে।

(২০০৭ সালের ২৪ নভেম্বর এসটি হওয়ার দাবিতে আদিবাসী ছাত্র সংগঠনের প্রতিবাদসভা ছিল গুয়াহাটিতে। প্রতিবাদকারীরা মারমুখী হয়ে উঠলে পুলিশ ও স্থানীয় জনতা তাঁদের উপরে চড়াও হয়। একাধিক প্রাণ যায়। জখম দুই শতাধিক। সচিবালয়ের সামনে নগ্ন করে দৌড় করানো হয় নাবালিকা এক আদিবাসী কন্যাকে। কারও সাজা হয়নি। সেই কন্যাই জানালেন তাঁর অভিজ্ঞতা, আনন্দবাজারের পাঠকদের জন্য)

অনুলিখন: রাজীবাক্ষ রক্ষিত

Advertisement
আরও পড়ুন