(বাঁ দিক থেকে) প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, একনাথ শিন্ডে, হেমন্ত সোরেন এবং রাহুল গান্ধী। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
লোকসভা ভোটের ছ’মাসের মধ্যে পর পর উত্তর এবং পশ্চিম ভারতের দুই রাজ্যে রাজনৈতিক আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে ফেলল বিজেপি। অক্টোবরে হরিয়ানার পর নভেম্বরে মহারাষ্ট্রের বিধানসভা ভোটে দুরমুশ করল বিরোধীদের। লোকসভা ভোটে ওই দুই রাজ্যেই বিরোধীদের কাছে ধাক্কা খেয়েছিল তারা। কিন্তু তাদের অশ্বমেধের ঘোড়া থেমে গিয়েছে পূর্ব ভারতে এসে। ঝাড়খণ্ডে ‘ইন্ডিয়া’র কাছে পর্যুদস্ত নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের দল। অথচ লোকসভা ভোটে আদিবাসী প্রভাবিত ওই রাজ্যে জয় পেয়েছিল তারা।
অন্য দিক থেকে দেখতে গেলে এ বার দুই রাজ্যের বিধানসভা ভোট বা বাংলা-সহ আরও ১৪টি রাজ্যের লোকসভা-বিধানসভা উপনির্বাচনেও ‘প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার’ চিহ্ন দেখা যায়নি। মহারাষ্ট্রে কংগ্রেস-শিবসেনা (ইউবিটি)-এনসিপি-র (শরদ) ‘মহাবিকাশ আঘাড়ী’কে ধরাশায়ী করে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরেছে বিজেপি-শিবসেনা (একনাথ শিন্ডে)-এনসিপির (অজিত) জোট ‘মহাজুটি’। আবার ঝাড়খণ্ডে অঙ্ক কষে জেএমএমে ভাঙন ধরিয়ে চম্পই সোরেনকে দলে টেনে, বিদ্রোহী বাবুলাল মরান্ডিকে ফিরিয়ে এনে, সুদেশ মাহাতোর আজসুর (অল ঝাড়খণ্ড স্টুডেন্টস ইউনিয়ন) সঙ্গে জোট গড়েও সুবিধা করতে পারেনি বিজেপি। কংগ্রেস-আরজেডি-নকশালপন্থীদের সঙ্গে নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে রাঁচীর কুর্সি পুনর্দখল করে নতুন নজির গড়েছেন ঝাড়খণ্ড আন্দোলনের ‘গুরুজি’ শিবু সোরেনের পুত্র হেমন্ত। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে দু’রাজ্যেই আসন বেড়েছে শাসকের।
উপনির্বাচনেও বাংলায় তৃণমূল, পঞ্জাবে আপ, কর্নাটকে কংগ্রেস, উত্তরপ্রদেশে বিজেপি ‘শাসকদল সুলভ’ আধিপত্য বজায় রেখেছে। তবে পড়শি ঝাড়খণ্ডের মতোই বাংলাও জোরালো ধাক্কা দিয়েছে বিজেপিকে। ছ’টি বিধানসভা আসনেই (কোচবিহারের সিতাই, আলিপুরদুয়ারের মাদারিহাট, উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়া ও নৈহাটি, বাঁকুড়ার তালড্যাংরা এবং পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার মেদিনীপুর) বিপুল জয় পেয়েছে তৃণমূল। এর মধ্যে সিতাই এবং হাড়োয়া আসনে সব বিরোধী প্রার্থীরই জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে।
ফেব্রুয়ারি মাসে দেশের রাজধানী দিল্লিতে বিধানসভা ভোট হওয়ার কথা। তার আগে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজ্যে (জনসংখ্যার নিরিখে) জয় এবং সার্বিক ভাবে উপনির্বাচনের ফল বিজেপিকে কিছুটা স্বস্তি দিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। পাশাপাশি, মহারাষ্ট্রের বিপুল জয় সোমবার থেকে শুরু হতে যাওয়া সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে ‘আদানি ঘুষকাণ্ড’ নিয়ে বিরোধীদের সম্ভাব্য আক্রমণের মোকাবিলাতেও উজ্জীবিত হবেন মোদী-শাহের দলের সাংসদেরা।
মহারাষ্ট্র
মহারাষ্ট্রের ভোটে এ বার মহিলাদের সমর্থন ঢেলে এনডিএ দিকে গিয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। যা গেরুয়া শিবিরের নিরঙ্কুশ জয়ের পথ প্রশস্ত করেছে। মুখ্যমন্ত্রী একনাথ শিন্ডের ‘লাডলি বহিন যোজনা’ সেখানে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। যে প্রকল্প অনেকটা বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লক্ষ্মীর ভান্ডারের মতো। ভোটের মুখে মহিলাদের আর্থিক সাহায্যের অঙ্ক ১,৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২,১০০ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন শিন্ডে। কয়েকটি বুথফেরত সমীক্ষায় তার ‘প্রভাব’ স্পষ্ট ধরা পড়েছিল। পাল্টা বিরোধী শিবির মহিলাদের ৩,০০০ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও তাতে আস্থা রাখেনি জনতা।
দিল্লিতে আম আদমি পার্টির সরকারের বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকিনীতির সমালোচনায় বিজেপি সরব হলেও মহারাষ্ট্রে কিন্তু কেজরীওয়ালের পথে হেঁটে বিদ্যুৎ বিলে ৩০ শতাংশ ভর্তুকি দেওয়ার ঘোষণা করেছে তারা। এ ছাড়া, কৃষকদের ভোট পেতে কৃষক সম্মাননিধি যোজনায় ১২ হাজার টাকার পরিবর্তে ১৫ হাজার টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে বিজেপি। ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য অন্তত ২০ শতাংশ বাড়ানোর কথা ঘোষণা করা হয়েছে, যা মহারাষ্ট্রের মতো কৃষিপ্রধান রাজ্যে বিজেপিকে সুবিধা দিয়ে থাকতে পারে। ভোটের আগে পেঁয়াজ রফতানির উপর বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করেও মোদী সরকার হাসি ফুটিয়েছিল কৃষকদের মুখে।
এরই পাশাপাশি ‘বাটেঙ্গে তো কাটেঙ্গে’ স্লোগান তুলে হিন্দু ভোটব্যাঙ্ককে এককাট্টা করা, বিশেষত ওবিসি ভোটব্যাঙ্ককে অটুট রাখার কৌশল নিয়েছিলেন মোদী-শাহরা। ‘মেরুকরণের’ সেই কৌশলও কাজে দিয়েছে। প্রয়াত বালাসাহেব ঠাকরের পুত্র উদ্ধবের বদলে শিন্ডের নেতৃত্বাধীন শিবসেনাকেই বেছে নিয়েছেন হিন্দুত্ববাদী মরাঠা ভোটারেরা। ভোটের আগে বিরোধী জোটের নেতারা বিশেষত, উদ্ধব এবং শরদ পওয়ার জোটের প্রচার ছেড়ে নিজেদের আসন বাঁচাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাতে চিড় খায় বিরোধী ঐক্য। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আসনরফা নিয়ে বিরোধী জোটের টানাপড়েনও বিপর্যয়ের অনুঘটক হয়েছে। শরদ-উদ্ধবেরা আশা করেছিলেন ২০২১ সালে বাংলায় নীলবাড়ির লড়াইয়ের মতোই, ‘গদ্দারেরা’ দল ভাঙায় মানুষের সহানুভূতি তাঁদের দিকেই থাকবে। কিন্তু তা হয়নি।
অথচ মাত্র ছ’মাস আগের লোকসভা ভোটে মহারাষ্ট্রের ৪৮টি আসনের মধ্যে বিরোধী জোটের ঝুলিতে গিয়েছিল ৩০টি (কংগ্রেস ১৩, উদ্ধবসেনা ৯ এবং শরদপন্থী এনসিপি ৮)। পাশাপাশি, সাংলি আসনে জয়ী নির্দল প্রার্থী কংগ্রেস শিবিরে ভিড়ে গিয়েছিলেন। অন্য দিকে, লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ৯টি এবং তার দুই শরিক শিবসেনা (শিন্ডে) এবং এনসিপির অজিত গোষ্ঠী যথাক্রমে ৭টি এবং ১টি আসনে জিতেছিল। পাঁচ বছর আগের থেকে লোকসভায় প্রায় দু’ডজন আসন কম পেয়েছিল এনডিএ জোট। তার পরে বিধানসভাতেও ভাল ফলের আশা করেছিল ‘ইন্ডিয়া’। কিন্তু সেই প্রত্যাশা ধূলিসাৎ হয়ে গেল। বাবাসাহের অম্বেডকরের পুত্র তথা প্রাক্তন সাংসদ প্রকাশ অম্বেডকরের ‘বঞ্চিত বহুজন অঘাড়ী’র (ভিবিএ) সঙ্গে জোট না হওয়া মরাঠাভূমে ‘ইন্ডিয়া’র বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠছে উদ্ধবের ‘অনমনীয় মনোভাব’ নিয়েও।
২০১৯ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির হাত ছেড়ে কংগ্রেস এবং এনসিপির হাত ধরেছিল এনডিএ-র প্রবীণতম জোটসঙ্গী উদ্ধবের শিবসেনা। মতাদর্শের দিক থেকে বিপরীত প্রান্তে থাকা দুই দলের সমর্থন নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীও হন বালাসাহেব ঠাকরের পুত্র। একক বৃহত্তম দল হলেও বিরোধী আসনে বসতে হয় বিজেপিকে। পাঁচ বছর পরে তারই ‘মধুর’ প্রতিশোধ নিলেন দেবেন্দ্র ফডণবীসেরা।
ঝাড়খণ্ড
ঝাড়খণ্ডে হেমন্ত সোরেনের নেতৃত্বাধীন জেএমএম-কংগ্রেস-আরজেডির জোট সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসতে মরিয়া বিজেপি তাদের প্রধান অস্ত্র করেছিল বাংলাদেশিদের ‘বেআইনি’ অনুপ্রবেশের ধুয়ো তুলে ভোটের ধর্মীয় মেরুকরণকে। তার সঙ্গে সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি এবং হেমন্তের জেলযাত্রাকেও হাতিয়ার করেছিল বিজেপি। কিন্তু ফল বলছে, সেই কৌশল ‘বুমেরাং’ হয়েছে। পাশাপাশি, পুরনো বিশ্বস্ত নেতাদের ব্রাত্য করে এক দশক পরে ‘পদ্মে’ ফেরা বাবুলাল মরান্ডিকে কার্যত ‘মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী’ হিসেবে তুলে ধরার কৌশলও কাজে দেয়নি।
ঝাড়খণ্ডের জনতার লোকসভা এবং বিধানসভায় ভোটদানের ‘প্রবণতা’ যে আলাদা, ২০১৯ সালের অভিজ্ঞতায় সে বিষয়ে সচেতন ছিল বিজেপি। তাই এ বার লোকসভা ভোটে আদিবাসীপ্রধান রাজ্যে সাফল্য পাওয়ার পরেও প্রাক্তন উপমুখ্যমন্ত্রী সুদেশ মাহাতোর ‘অল ঝাড়খণ্ড স্টুডেন্টস ইউনিয়ন’র (আজসু) সঙ্গে জোট গড়েছিল মোদী-শাহের দল। সঙ্গে ছিল বিহারের নীতীশ কুমারের দল জেডিইউ এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী চিরাগ পাসোয়ানের দল এলজেপি (রামবিলাস)। কিন্তু তাতে ফল মেলেনি।
ভোটের ফল বলছে, বিজেপির বিরুদ্ধে হেমন্তের তোলা চক্রান্তের অভিযোগই আদিবাসী সমাজে মান্যতা পেয়েছে। মানুষ বিশ্বাস করেছেন, ‘রাজনৈতিক চক্রান্ত’ করেই কেন্দ্রীয় এজেন্সির সাহায্যে শিবুপুত্র হেমন্তকে দুর্নীতি মামলায় ‘ফাঁসিয়েছে’ মোদীর সরকার। পাশাপাশি, চম্পইয়ের বিরুদ্ধে জেএমএমের দেওয়া ‘গদ্দার’ তকমা বিশ্বাসযোগ্যতা পেয়ে গিয়েছে। মোদীর তোলা ‘এক হ্যায় তো সেফ হ্যায়’ স্লোগানেও সাড়া দেননি ঝাড়খণ্ডবাসী। এক দিকে সংখ্যালঘু ভোটাররা এককাট্টা ভাবে ভোট দিয়েছেন ‘ইন্ডিয়া’কে। অন্য দিকে, হেমন্ত সিএএ-এনআরসি নিয়ে যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, তা ছাপ ফেলেছে আদিবাসী মননে। দিনের শেষে তাই মুখরক্ষা হয়েছে ‘ইন্ডিয়া’র।