Article 370 Verdict

অসাংবিধানিক নয় ৩৭০ ধারা বাতিল, তবে রাজ্যের মর্যাদা দিতে হবে, সুপ্রিম কোর্টের রায় আর কী বলল?

কাশ্মীরকে রাজ্যের মর্যাদা দিয়ে অবিলম্বে বিধানসভা নির্বাচনের নির্দেশও দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। জানিয়েছে, নির্বাচন করাতে হবে ২০২৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০২৩ ২২:৪৮
An image of Jammu and Kashmir

গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল করে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বিলোপের সিদ্ধান্ত অসাংবিধানিক নয় বলে সোমবার জানিয়ে দিল সুপ্রিম কোর্ট। প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির সংবিধান বেঞ্চের রায়— ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকারের সুপারিশে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তা বৈধ।

Advertisement

কাশ্মীরকে রাজ্যের মর্যাদা দিয়ে অবিলম্বে বিধানসভা নির্বাচনের নির্দেশও দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। জানিয়েছে, নির্বাচন করাতে হবে ২০২৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে।

২০১৯ সালের ৫ অগস্ট কেন্দ্র সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা লোপ করে। সাবেক জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যকে দুই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল জম্মু-কাশ্মীর এবং লাদাখে ভাগ করা হয়। তার পরেই সুপ্রিম কোর্টে এই পদক্ষেপের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে মামলা হয়। সোমবার সেই মামলার রায় ঘোষিত হল। প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় ছাড়াও সংবিধান বেঞ্চে ছিলেন বিচারপতি সঞ্জয় কিসান কল, বিচারপতি সঞ্জীব খন্না, বিচারপতি বিআর গাভাই এবং বিচারপতি সূর্য কান্ত।

মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্য, অনুচ্ছেদ ৩৭০-এ জম্মু ও কাশ্মীরকে যে বিশেষ অধিকার দেওয়া হয়েছিল, তা সাময়িক। কাশ্মীরের গণপরিষদ বাতিল হয়ে যাওয়ার পরেও রাষ্ট্রপতির ওই অনুচ্ছেদ বাতিল করার অধিকার ছিল। ফলে যা হয়েছে, তা অসাংবিধানিক নয়। এর পাশাপাশি জম্মু ও কাশ্মীরকে পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের মর্যাদা দিতে কেন্দ্রকে নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। অর্থাৎ, আর তা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে পড়বে না।

পাঁচ সদস্যের সংবিধান বেঞ্চ সোমবার তিন ভাগে ৩৭০ অনুচ্ছেদের মামলার রায় ঘোষণা করে। প্রথমে প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় রায় পড়ে শোনান। বিচারপতি গাভাই এবং বিচারপতি সূর্য কান্তের রায় প্রধান বিচারপতির রায়ের সঙ্গেই একত্রে পড়ে শোনানো হয়। আলাদা করে রায় পড়েন বিচারপতি কল এবং বিচারপতি খন্না। শীর্ষ আদালতে জানিয়েছে, ১৯৪৭ সালে অক্টোবরে মহারাজা হরি সিংহের আমলে যে দিন ভারতের সঙ্গে জম্মু ও কাশ্মীর যুক্ত হয়েছে, সে দিন থেকেই ওই রাজ্যের আলাদা করে কোনও অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্ব নেই। তা ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।

প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের বিধানসভা ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। তার পর সেখানে জারি করা হয়েছিল রাষ্ট্রপতি শাসন। এখনও তা-ই চলছে। ২০১৯ সালের ৫ অগস্ট জম্মু-কাশ্মীর সংক্রান্ত নির্দেশিকা জারি করেছিলেন রাষ্ট্রপতি। এর মাধ্যমে সংবিধানে ৩৬৭(৪) নম্বর অনুচ্ছেদ যোগ করা হয়েছিল। ফলে সংবিধানের ৩৭০(৩) নম্বর ধারায় ‘রাজ্যের সংবিধান সভা’-র বদলে ‘রাজ্যের বিধানসভা’ শব্দটি যোগ হয়েছিল। সে দিনই সংসদে বিশেষ মর্যাদা লোপ এবং জম্মু-কাশ্মীর ভাগের বিল পাশ হয়। পরের দিন রাষ্ট্রপতি জানান, ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ আর কার্যকর হচ্ছে না।

নতুন বিন্যাসেই বিধানসভা ভোট?

রাষ্ট্রপতি শাসনের মধ্যেই জম্মু ও কাশ্মীরে আসন পুনর্বিন্যাস সংক্রান্ত বিল লোকসভায় পাশ করিয়েছে মোদী সরকার। ২০২০ সালের মার্চ মাসে জম্মু ও কাশ্মীরের আসন পুনর্বিন্যাসের জন্য সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি রঞ্জনাপ্রকাশ দেশাইয়ের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির তরফে ২০২২ সালের মে মাসে জম্মুতে ছ’টি এবং কাশ্মীরে একটি আসন বৃদ্ধি করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। সেই প্রস্তাব মেনেই পাশ হয়েছে বিল।

জম্মু-কাশ্মীর সংশোধিত পুনর্গঠন বিলে জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভার আসনসংখ্যা ৮৩ থেকে বাড়িয়ে ৯০ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার পক্ষ। বিলে যাযাবর গোষ্ঠী থেকে দু’জন (যাঁদের এক জন মহিলা) ও পাক অধিকৃত কাশ্মীর থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন এমন এক জন-সহ মোট তিন জনকে মনোনীত করবেন উপরাজ্যপাল। আর জম্মু-কাশ্মীর সংরক্ষণ বিলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির মহিলা বিশেষ করে তফসিলি জাতি ও জনজাতির সমাজের নারীদের শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী, উপরাজ্যপাল নন, পূর্ণাঙ্গ রাজ্য জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্যপাল পাবে তিন জন বিধায়ক মনোনয়নের ভার। বিরোধী দলগুলির অভিযোগ, জনবিন্যাস কিংবা জনসংখ্যার ভিত্তিতে নয়, ‘ধর্মীয় মেরুকরণ’ মেনেই বিধানসভায় জম্মুর জন্য আসন বাড়িয়ে উপত্যকাকে কব্জা করতে চাইছে বিজেপি।

কেন্দ্রশাসিত থাকবে লাদাখ

জম্মু ও কাশ্মীরকে পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়ার নির্দেশ দিলেও লাদাখকে ‘কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল’ হিসাবেই রাখার নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির সংবিধান বেঞ্চের রায়— কোনও রাজ্যের একটি নির্দিষ্ট অংশকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ঘোষণা করা যায়। তা সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩-এ বর্ণিত রয়েছে।

২০১৯ সালের ৪ অগস্ট পর্যন্ত লাদাখ জম্মু-কাশ্মীরের অংশ ছিল। কিন্তু ৫ অগস্ট সংবিধানে সংরক্ষিত জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা খারিজ করে দেয় কেন্দ্র। পাশাপাশি, ওই রাজ্য পুনর্গঠনের বিলও আনে নরেন্দ্র মোদীর সরকার। সন্ত্রাসবাদ দমন ও প্রশাসনিক সুবিধার কথা মাথায় রেখে জম্মু-কাশ্মীর এবং লাদাখকে ভেঙে পৃথক দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ঘোষণা করা হয়। সংসদে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সে সময় বলেছিলেন, ‘‘লাদাখ এত দিন জম্মু ও কাশ্মীরের সঙ্গে থাকলেও, সেখানকার ভূপ্রকৃতি ও জনসংখ্যার চরিত্র আলাদা। সেখানকার বাসিন্দাদের দীর্ঘ দিনের দাবি ছিল লাদাখকে কেন্দ্রশাসিত এলাকা ঘোষণার।’’

কেন্দ্রের ওই সিদ্ধান্তের পর কাশ্মীর থেকে আলাদা হতে পেরে উচ্ছ্বাসের বাঁধ ভেঙেছিল লাদাখে। বিশেষ মর্যাদা বিলোপ নিয়ে কাশ্মীর উপত্যকা যখন উত্তাল, তখন সম্পূর্ণ বিপরীত ছবি দেখা গিয়েছিল লেহ্-র রাস্তায়। কিন্তু তার দু’বছর পেরোতে না পেরোতেই ‘মোহভঙ্গ’ হয় লাদাখের! আলাদা রাজ্যের মর্যাদা পেতে সেখানে সাম্প্রতিক কালে বেশ কয়েক বার বিক্ষোভও হয়েছে।

চলতি বছরের গোড়ায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তরফে সম্প্রতি লাদাখের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটিতে ছিলেন দেশের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই, লাদাখের সাংসদ এবং লাদাখের দু’টি (লেহ্‌ এবং কারগিল) স্বশাসিত পরিষদের প্রতিনিধিরা। কিন্তু লেহ্ পরিষদের নেতারা কমিটির বৈঠকে যোগ দিতে রাজি হননি। স্বতন্ত্র রাজ্য কিংবা সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের অন্তর্ভুক্তির দাবি তুলে পরিষদের নেতারা জানিয়ে দেন, দাবি পূরণ না হলে আলোচনা বৃথা। এতে অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছিল মোদীর সরকারকে। পরবর্তী কালে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থও হন লাদাখের নেতারা। তাঁদের বক্তব্য ছিল, উন্নয়নের নামে গণতন্ত্র ছিনিয়ে নিয়েছে কেন্দ্র! কিন্তু আপাতত কেন্দ্রের সিদ্ধান্তই বহাল রাখল শীর্ষ আদালত।

মোদী থেকে ওমর, কার কী প্রতিক্রিয়া?

৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে ঐতিহাসিক বললেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এক্স হ্যান্ডলে তিনি লেখেন, “আজ অনুচ্ছেদ ৩৭০ বিলোপ নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দান করেছে তা ঐতিহাসিক। এই রায় এক নতুন আশা জাগাল। এই রায় জম্মু-কাশ্মীর এবং লাদাখে বসবাসকারী আমাদের ভাইবোনদের উন্নতি এবং অগ্রগতির দিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে দিল। সব কিছুর ঊর্ধ্বে ভারতীয়দের ঐক্যের কথাই বলল আদালত।”

প্রধানমন্ত্রী আরও লেখেন, “জম্মু-কাশ্মীর এবং লাদাখের মানুষকে আরও এক বার আশ্বস্ত করে বলতে চাই, আমি আপনাদের স্বপ্ন পূরণ করতে বদ্ধপরিকর।” প্রধানমন্ত্রী আরও জানিয়েছেন, উন্নয়ন এবং অগ্রগতির সুবিধা প্রান্তিক এবং দুর্বল মানুষের কাছেও পৌঁছে যাবে। যাঁরা ৩৭০ অনুচ্ছেদের জন্য ভুক্তভোগী, তাঁদের কাছেও সমস্ত সুযোগ সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার জন্য তিনি অঙ্গীকারবদ্ধ। প্রধানমন্ত্রী মোদী আরও বলেন, “এই রায় শুধু আইনি রায় নয়, এটি একটি আশার আলো, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি, শক্তিশালী এবং অখণ্ড ভারত গড়ার সম্মিলিত সংকল্পের প্রমাণ।”

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ এক্স হ্যান্ডলে জানান, এই রায়ের ফলে গরিব এবং বঞ্চিতদের অধিকার পুনরুদ্ধার হবে। বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপ, পাথর ছোড়ার মতো ঘটনা এখন থেকে অতীত হয়ে যাবে। গোটা অঞ্চলে এখন ঐক্যের সুর বাজবে। তাঁর কথায়, “জম্মু-কাশ্মীর এবং লাদাখ ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল, এবং তা থাকবেও। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে আমাদের সরকার জম্মু-কাশ্মীর এবং লাদাখে শআন্তি ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর।”

লোকসভার বিরোধী দলনেতা তথা কংগ্রেস সাংসদ অধীর চৌধুরী এই রায় প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, বার বারই তাঁদের দাবি ছিল কবে জম্মু-কাশ্মীরকে পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া হবে। সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের পর দ্রুত জম্মু-কাশ্মীরকে রাজ্যের মর্যাদা দিয়ে সেখানে দ্রুত নির্বাচন করানোর ব্যবস্থা করা হোক।

কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা ওমর আবদুল্লা সুপ্রিম কোর্টের রায় শোনার পর জানান, তিনি হতাশ। তবে আশাহত হননি। ওমরের কথায়, ‘‘আমি হতাশ। তবে আশাহত নই। আমাদের লড়াই জারি থাকবে। বিজেপির এই জায়গায় পৌঁছতে বহু বছর সময় লেগেছে। আমরাও দীর্ঘ লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত।’’ ডেমোক্র্যাটিক প্রোগ্রেসিভ আজাদ পার্টি-র চেয়ারম্যান তথা প্রাক্তন কংগ্রেস নেতা গুলাম নবি আজাদ এই রায়কে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ বলেছেন। তাঁর কথায়, “জম্মু-কাশ্মীরের মানুষ এই রায়ে খুশি নন। তবে আমাদের এটি মেনে নিতে হবে।”

শীর্ষ আদালতে আইনি এই সাফল্যের জন্য প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকেই কৃতিত্ব দিচ্ছেন কেন্দ্রের সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা। শীর্ষ আদালতে আইনি যুদ্ধে কেন্দ্রের প্রধান সেনাপতি বিবৃতিতে বলেন, “এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তকে সম্ভবপর করে তুলেছে সম্মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদীর লৌহকঠিন ইচ্ছা এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী অমিত শাহের দুর্দান্ত কৌশল। গোটা দেশ তাঁদের কাছে ঋণী থাকবে।” এর পাশাপাশি তাঁর মন্তব্য, “২০১৯ সালের ৫ অগস্ট ভারতের ইতিহাসে এমন একটি দিন, যে দিন হিমালয়ের ঐতিহাসিক ভুলকে সংশোধন করে নিয়েছিল সরকার।”

Advertisement
আরও পড়ুন