মনসুখ মাণ্ডবিয়া ফাইল চিত্র।
গুজরাতের কনিষ্ঠতম বিধায়ক থেকে করোনা-কালে দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত মনসুখ মাণ্ডবিয়ার গত দু’দশকে রাজনৈতিক কেরিয়ারের লেখচিত্র প্রায় টানা ঊর্ধ্বমুখী। কিন্তু এই ‘হট সিটে’ তাঁকে প্রথম দিন থেকে বসতে হচ্ছে কোভিডের তৃতীয় ঢেউ সামাল দেওয়ার চ্যালেঞ্জকে সঙ্গী করে। কারণ, তা রুখতে ব্যর্থতা তাঁর ‘চাকরি’ নড়বড়ে করে দিতে পারে বলে গুঞ্জন রাজধানীতে। ঠিক যে ভাবে অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউ সামলাতে ‘ব্যর্থতার দায় ঘাড়ে নিয়ে’ সরতে হয়েছে সদ্য প্রাক্তন ডাক্তার-স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধনকে।
তৃতীয় ঢেউ রুখতে নরেন্দ্র মোদী কতখানি মরিয়া, তারও ইঙ্গিত মিলেছে এ দিন। মন্ত্রিসভার খোলনলচে বদলের পরের দিনই প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কড়াকড়ি শিথিল হতেই যে ভাবে কুলু, মানালির মতো পর্যটনকেন্দ্রে ভিড় উপচে পড়ছে, কোথাও দল বেঁধে স্নান করছেন মাস্কহীন পুণ্যার্থীরা, তা মেনে নেওয়া যায় না। বার্তা স্পষ্ট, ২০২৪-কে পাখির চোখ করে তৃতীয় ঢেউয়ে রাশ টানতে হবে যে কোনও মূল্যে।
করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ধাক্কায় অক্সিজেনের অভাব, জীবনদায়ী ওষুধের কালোবাজারি, প্রতিষেধকের জোগানে ঘাটতির মতো হাজারো কারণে ‘মুখ পুড়েছে’ মোদী সরকারের। আন্তর্জাতিক আঙিনায় টাল খেয়েছে নরেন্দ্র মোদীর ভাবমূর্তি। ক্ষোভে ফুঁসছেন সাধারণ মানুষের এক বড় অংশ। পরিস্থিতি দ্রুত না-শোধরালে আগামী বছর উত্তরপ্রদেশ এবং ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে এর খেসারত দিতে হতে পারে শঙ্কিত বিজেপি নেতাদের একাংশ। অনেকের ধারণা, এই পরিস্থিতি আঁচ করেই স্বাস্থ্যে ‘নতুন মুখ’ হিসেবে মনসুখকে তুলে এনেছেন মোদী। কিন্তু তাঁর দায়িত্ব নেওয়ার দিনেই কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধীর টুইট, ‘‘এই পরিবর্তনে কি প্রতিষেধকের ঘাটতি মিটবে?’’
অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন আগে কোভিড মোকাবিলায় যে ২৩,১২৩ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছিলেন, বৃহস্পতিবার তাতে সায় দিয়েছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা। কিন্তু নতুন মন্ত্রীর সামনে যে চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে, তা আক্ষরিক অর্থেই পাহাড়প্রমাণ।
বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাস, টিকাকরণের গতি বহু গুণ না-বাড়ালে, কোভিডের তৃতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ার প্রভাব হবে ভয়ঙ্কর। অথচ দেশে সেই টিকার জোগান এখনও বাড়ন্ত। মোদী বুক ঠুকে এক দিন রেকর্ডের কথা বললেও, গড় প্রতিষেধক দানের সংখ্যা কাঙ্খিত মাত্রার ধারেকাছে নয় এখনও। কেন্দ্রের প্রতিশ্রুতি, ডিসেম্বরের মধ্যে সকলকে (৯৪.৪ কোটি জন) প্রতিষেধক দেওয়া হবে। কিন্তু রাহুলের অভিযোগ, এখন যে হারে টিকাকরণ হচ্ছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় প্রায় ২৭% কম। যার অন্যতম কারণ টিকা উৎপাদন কম হওয়া। মূলত ওই সমস্যা থাকায় রাজ্যগুলিতে যথেষ্ট সংখ্যায় প্রতিষেধক পাঠাতে পারছে না কেন্দ্র। ফলে অনেক রাজ্যেই মাঝেমধ্যে টিকাকরণ কেন্দ্র বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছে। কিংবা বড়জোর অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে দিচ্ছে বয়স্ক ও টিকার দ্বিতীয় ডোজ় প্রত্যাশীদের।
বিশেষজ্ঞদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জুলাইয়ে রাজ্যগুলিকে ৩০ কোটি টিকার ডোজ় সরবরাহের দরকার ছিল। সেখানে সম্ভাব্য সরবরাহ মোটে ১২ কোটি। এই অবস্থায় জোগান বাড়াতে ২৪ ঘণ্টার নোটিসে বিদেশি টিকা নির্মাতাদের ছাড়পত্র দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু তাতেও এখনও তেমন লাভ হয়নি। বিরোধীদের সংশয়, ‘মন্ত্রকে শুধু মুখ বদল হলেই কি এই সমস্যা মিটবে? এই সমস্যার সমাধান কোথা থেকে খুঁজে পাবেন মনসুখ?’ তাঁদের ধারণা, নতুন দায়িত্বে মনসুখের স্থায়িত্ব অনেকটাই নির্ভর করবে এই ধাঁধার উত্তর খোঁজার উপরে। কেন্দ্রের অবশ্য দাবি, অগস্ট থেকে একাধিক নতুন দেশি ও বিদেশি টিকা বাজারে আসবে। মিটবে ঘাটতি।
স্বাস্থ্যকর্তাদের একাংশ মানছেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ কার্যত বেআব্রু করে দিয়ে গিয়েছে দেশের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোকে। শয্যা, অক্সিজেন, ওষুধ, আইসিইউ— অভাব সর্বত্র। শুধু অক্সিজেনের অভাবেই বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছেন বহু জন। বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাস মিলিয়ে বছরের শেষ দিকে তৃতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ার আগে তা কিছুটা অন্তত মেরামত করতে চাইছে কেন্দ্র। তার ইঙ্গিত স্পষ্ট কোভিড প্যাকেজে। এত কম সময়ে ওই মেরামতিও বড় চ্যালেঞ্জ মনসুখের। শয্যা, পরীক্ষা বাড়ানোর পাশাপাশি যে কারণে আগামী ধাক্কা সামাল দিতে কেন্দ্র এখন থেকে ভাবছে ডাক্তারি পড়ুয়া ইন্টার্নদের কাজে লাগানোর কথা।
নতুন মন্ত্রকে দায়িত্ব নেওয়ার দিনেই পুরনো কিছু টুইট ও শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে বিতর্কের মুখে পড়েছেন মনসুখ। এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে মন্তব্যও করতে চাননি তিনি। কিন্তু কোভিড মোকাবিলায় ব্যর্থতা বিরোধীরা বিনা প্রশ্নে হজম করবেন না, তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। বিশেষত যেখানে তৃতীয় ঢেউয়ে বড় সংখ্যায় শিশু-কিশোর-কিশোরীদের আক্রান্ত হওয়ার পূর্বাভাস রয়েছে অনেক আগে থেকে।
এর আগে কেন্দ্রে সড়ক পরিবহণ, জাহাজ, রাসায়নিক ও সার প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলেছেন মনসুখ। সেই গুজরাত থেকেই তিনি মোদীর আস্থাভাজন। কিন্তু সেই আস্থার ‘আসল পরীক্ষা’ সম্ভবত শুরু হল বৃহস্পতিবারই।