সুপ্রিম কোর্টে ওয়াকফ সংশোধনী আইন নিয়ে চলছে মামলা। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
সংশোধিত ওয়াকফ আইন দেশে কার্যকর করেছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। তাকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে বেশ কয়েকটি পিটিশন দায়ের করা হয়েছে। বুধবার সে রকম ৭৩টি আবেদন একত্রিত করে শুনল সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খন্নার বেঞ্চ। বেঞ্চে ছিলেন বিচারপতি সঞ্জয় কুমার এবং বিচারপতি কেভি বিশ্বনাথন। সেই শুনানিতে নতুন আইন নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে বেশ কিছু প্রশ্ন করেছে সুপ্রিম কোর্ট। নতুন আইনে ওয়াকফ বোর্ডের সদস্য হতে পারবেন অমুসলিমেরাও। সুপ্রিম কোর্টের প্রশ্ন, হিন্দুদের সম্পত্তি সংক্রান্ত বোর্ডে কি কোনও মুসলিমকে সদস্য হতে দেবে সরকার? বেঞ্চ জানায়, তাদের সামনে মূলত দু’টি প্রশ্ন। এক, পিটিশনগুলি কি হাই কোর্টে পাঠানো হবে? দুই, আবেদনকারীরা কী নিয়ে সওয়াল করতে চান? এক পিটিশনকারীর হয়ে সওয়াল করেন আইনজীবী কপিল সিব্বল। তিনি দাবি করেন, এই আইন সংবিধানের ২৬ নম্বর ধারা লঙ্ঘন করছে। সংবিধানের এই ধারা স্বাধীন ভাবে ধর্মাচরণের অধিকার দিয়েছে। তাঁর সওয়াল, জেলাশাসক সরকারের অঙ্গ। তিনি ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে সিদ্ধান্ত নিলে তা অসাংবিধানিক। ‘ওয়াকফ বাই ইউজার’ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন সিব্বল। এই ধারায় দীর্ঘদিন ধরে কোনও সম্পত্তি ধর্মীয় বা সেবার স্বার্থে ব্যবহার করা হলে তা ওয়াকফ বলে ধরে নেওয়া হয়, নথিভুক্তকরণ না হলেও চলে। সিব্বলের দাবি, এই ধারা ইসলাম ধর্মের অবিচ্ছেদ্য অংশ। পাল্টা সওয়াল করেন সরকারি আইনজীবী তুষার মেহতা। তাঁকে প্রধান বিচারপতির প্রশ্ন, ‘‘আপনি বলছেন ওয়াকফ বাই ইউজার কোর্টের রায়ে হলেও আজ তা বাতিল?’’ তিনি আরও জানিয়েছেন, বেশির ভাগ মসজিদ চতুর্দশ, পঞ্চদশ শতকে তৈরি। তাদের নথি দাখিল কী করে সম্ভব? ওয়াকফ সংশোধিত আইন নিয়ে অন্তর্বর্তী কোনও স্থগিতাদেশ দেয়নি সুপ্রিম কোর্ট। বৃহস্পতিবার আবার শুনানি।
ওয়াকফ আইন নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ-সহ একাধিক রাজ্যে কিছু এলাকায় অশান্তির ঘটনা ঘটেছে। শুনানি শেষে তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেন প্রধান বিচারপতি। তাঁর কথায়, ‘‘যে হিংসা হচ্ছে, তা খুবই উদ্বেগজনক। এ রকম হওয়া উচিত নয়।’’
ওয়াকফ সংশোধিত আইন নিয়ে অন্তর্বর্তী কোনও স্থগিতাদেশ দিল না সুপ্রিম কোর্ট। বৃহস্পতিবার আবার শুনানি।
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘‘আমাদের সামনে তিনটি পথ। এক, আমরা পিটিশন শুনব। দুই, হাই কোর্টে পাঠিয়ে দেব। তিন, হাই কোর্টে পড়ে থাকা পিটিশনও গ্রহণ করে আমরাই সিদ্ধান্ত নেব।’’ সুপ্রিম কোর্ট তিনটি অন্তর্বর্তী নির্দেশ নিয়ে আলোচনাও করে। সেগুলি হল, এক, কোর্ট যে সম্পত্তিকে ওয়াকফ বলে ঘোষণা করবে, তাকে ‘ওয়াকফ নয়’ বলে ধরা যাবে না। দুই, যে ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ রয়েছে, তা নিয়ে জেলাশাসক প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া চালাতে পারবেন। কিন্তু সেই বিধান কার্যকর করা যাবে না। তিন, ওয়াকফ বোর্ড এবং ওয়াকফ কাউন্সিলের সদস্যদের মুসলিম হতেই হবে। শুধু যাঁরা পদাধিকার বলে ওয়াকফে যোগ দেবেন, তাঁরা ভিন্ধর্মের হতে পারেন। শেষ পর্যন্ত এই অন্তর্বর্তী নির্দেশ তারা দেয়নি।
প্রধান বিচারপতির আইনজীবী মেহতাকে প্রশ্ন, ‘‘এখন থেকে কি মুসলিমদেরও হিন্দু সম্পত্তি বোর্ডের সদস্য হতে দেওয়া হবে?’’
প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ, ‘‘জেলাশাসক যদি সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করেন যে, কোনটা ওয়াকফ, কোনটা নয়, তা কি ঠিক হবে?’’ আইনে ৯ নম্বর ধারা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রধান বিচারপতি।
প্রধান বিচারপতির প্রশ্ন, কোনও ওয়াকফ সম্পত্তি নথিভুক্ত হয়ে গেলে, তাকে কি নতুন আইনে বাতিল ঘোষণা করা যাবে? মেহতা জানিয়েছে, নথিভুক্ত হয়ে গেলে তা হবে না। প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ, ব্রিটিশরা এ দেশে আসার আগে সম্পত্তির নথিভুক্তকরণ হত না। অনেক মসজিদ চতুর্দশ, পঞ্চদশ শতকে তৈরি হয়েছিল। যেমন জামা মসজিদ। মেহতার সওয়াল, তাতে নথিভুক্তকরণ করতে বাধা কোথায়?
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘‘কোনটা ওয়াকফ সম্পত্তি, কোনটা নয়, তা নিয়ে কোর্টকে সিদ্ধান্ত নিতে বলা হোক।’’ আইনজীবী মেহতার দাবি, ১৯৯৫ সালের ওয়াকফ আইনেও সম্পত্তির নথিভুক্তকরণ বাধ্যতামূলক ছিল।’’
বিচারপতি কুমার বলেন, ‘‘তিরুপতি বোর্ডে কি হিন্দু নন, এমন কেউ রয়েছেন?’’ প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ, হিন্দুদের ধর্মীয় সম্পত্তির দায়িত্বে অন্য কোনও ধর্মের কেউ থাকেন না।
ওয়াকফ আইনের পক্ষে সওয়াল করলেন আইনজীবী এসজি মেহতা। তাঁর সওয়াল, যৌথ সংসদীয় কমিটি ৩৮ বার বৈঠক করেছে। কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে লক্ষ লক্ষ স্মারকলিপি পরীক্ষা করেছে। তার পর সেই বিল সংসদের দুই কক্ষে পাশ হয়ে আইনে পরিণত হয়েছে।
কাশ্মীরি পণ্ডিতদের আইনজীবীর সওয়াল, ‘‘আমি কাশ্মীরি পণ্ডিত। আমাদের একটা মন্দির রয়েছে। এ বার মুসলিমদের একটা অংশ এসে বলল, এটা আমাদের জমি। এটা কি ঠিক? একই ঘটনা হচ্ছে এখানেও। জেলাশাসক বলছেন, আমি সিদ্ধান্ত নেব। আমি সর্বশক্তিমান।’’
সুপ্রিম কোর্টে সিঙ্ঘভির আর্জি, নয়া ওয়াকফ সংশোধনী আইনের কিছু অংশে আপাতত স্থগিতাদেশ দেওয়া হোক। গোটা আইনে নয়। প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘‘আমার আসব বিষয়টিতে।’’
প্রধান বিচারপতি জানান, এই বিষয়টি হাই কোর্টেও শুনানি হতে পারে। তাঁর কথায়, ‘‘যে কোনও এক হাই কোর্টকে এই মামলা শোনার নির্দেশ দিতে পারি। হাই কোর্টের রায় আমাদের সুবিধা করে দেবে।’’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘‘যখন দিল্লি হাই কোর্টে ছিলাম, শুনতাম, সেটা নাকি ওয়াকফের জমিতে। আমাদের ভুল বুঝবেন না। সব ওয়াকফ সম্পত্তির নথিভুক্তকরণ ভুল ভাবে হয়নি।’’ আইনজীবী অভিষেক মনু সিঙ্ঘভির পাল্টা সওয়াল, ‘‘আমরা শুনেছি সংসদও ওয়াকফের জমিতে হয়েছে।’’
সিব্বলের সওয়াল, নয়া আইন লঙ্ঘন করলে জেল পর্যন্ত হতে পারে। প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘‘এটা ঠিক আছে। অনেক কাজেই জরিমানা দিতে হয়।’’
সিব্বল জানিয়েছেন, ১৯৯৫ সালের ওয়াকফ আইনে সীমাবদ্ধতা ছিল না। নতুন ওয়াকফ সংশোধনী আইনে অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ, ‘‘সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আমরা বলতে পারি না যে, নিয়ন্ত্রণ করলেই তা অসাংবিধানিক।’’
সিব্বলের পাল্টা সওয়াল, ‘‘আমার জমি রয়েছে। তাতে আমি অনাথ আশ্রম করব। এতে সমস্যা কোথায়? এর জন্য নথিভুক্তকরণ করতে যাব কেন?’’ প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ, ওয়াকফে সম্পত্তির নথিভুক্তকরণ করলে সুবিধা হবে।
সিব্বলের সওয়াল, ‘‘ওয়াকফ ১০০ বছরের পুরনো। কিন্তু এখন ওরা ৩০০ বছরের পুরনো সম্পত্তির ডিড চাইবে। এটাই সমস্যা।’’
সিব্বল ওয়াকফ বোর্ডে হিন্দু সদস্যদের থাকা নিয়ে সওয়াল করেন। প্রধান বিচারপতি জানান, দু’জন মাত্র অমুসলিম সদস্য থাকবেন। সিব্বলের পাল্টা সওয়াল, নতুন আইনে বলা হয়েছে ‘অন্তত দু’জন অমুসলিম’ সদস্য থাকবেন।
বিচারপতি বিশ্বনাথনের পর্যবেক্ষণ, ‘‘সংবিধানের ২৬ নম্বর ধারায় যা লেখা, তার সঙ্গে ধর্মীয় আচারকে মিলিয়ে দেওয়া যাবে না।’’