Book Store

বন্ধ হয়ে গেল কাশ্মীরের ঐতিহ্যের বই বিপণি

একা একজন বইবিক্রেতা। তাঁর চার পাশে একাধিক কার্ডবোর্ডের বাক্সে বোঝাই ধ্রুপদী সাহিত্য। শূন্য বইয়ের তাকগুলোর দিকে তাকিয়ে তিনি। কোনও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা নয়।

সাবির ইবন ইউসুফ
শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০২৫ ০৮:০৬
শ্রীনগরের সেই ঐতিহ্যবাহী বইয়ের দোকানটি।

শ্রীনগরের সেই ঐতিহ্যবাহী বইয়ের দোকানটি। —নিজস্ব চিত্র।

অর্ধশতকের একটু কম সময় ধরে রমরমিয়ে চলার পরে গোটা কাশ্মীরবাসীর আরও একটা গর্বের ফলক এক রকম নিঃশব্দে মুছে গেল উপত্যকা থেকে। বন্ধ হয়ে গেল কাশ্মীরের সবচেয়ে পুরনো এবং বইপ্রেমীদের ভালবাসার ৪৫ বছরের পুরনো বইয়ের দোকান ‘বেস্টসেলার’।

একা একজন বইবিক্রেতা। তাঁর চার পাশে একাধিক কার্ডবোর্ডের বাক্সে বোঝাই ধ্রুপদী সাহিত্য। শূন্য বইয়ের তাকগুলোর দিকে তাকিয়ে তিনি। কোনও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা নয়। ‘বেস্টসেলারে’র মালিক সানিয়াসনাইন চিলু এই রকমই একটা জিবলি-ছবি দিয়ে উপত্যকাবাসীর সবচেয়ে প্রিয় বইয়ের দোকান বরাবরের মতো বন্ধ হওয়ার বিষয়টি জানিয়ে দিয়েছেন। এই ছবি থেকেই দোকানটি বরাবরের মতো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে জেনে কষ্ট পাচ্ছেন উপত্যকার বইপ্রেমীরা।

শ্রীনগরের লালচক থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বের বেস্টসেলার নিছক কোনও বইয়ের দোকান ছিল না। দশকের পর দশক পাঠক, সাংস্কৃতিক জগতের সঙ্গে যুক্ত লোকজনের বড় আশ্রয় ছিল এই টুকরো দোকানটা। দোকানে আসা লোকেদের আড্ডা-তর্ক-বিশ্লেষণে জমজমাট হয়ে উঠত গোটা এলাকা। অনেকেই বলতেন, এখানে গল্প শুধু বইয়ের পাতায় থাকে না, এখানে আসা লোকেদের মধ্যেও থাকে। এক শান্ত শুক্রবারে সেই দোকানকেই চিরবিদায় জানানোর কথা ঘোষণা করলেন চিলু। দিল্লির বুকশপ, লখনউয়ের ব্রিটিশ বুক ডিপো, মুম্বইয়ের স্ট্র্যান্ড-এর মতোই ঝাঁপ ফেলে দিল বেস্টসেলার-ও।

‘‘অনলাইনের দৌলতে শুধু বাজারটাই বদলায়নি, পাঠকেরও বদল হয়েছে। সত্যিকারের বইপ্রেমীদের নিয়ে কোনও দিনই সমস্যা হয়নি। কিন্তু অনলাইনে বই বিক্রি শুরু হওয়ার পরে লোকজন অনলাইনেই বিপুল ছাড়ে বই কেনা শুরু করলেন। একটা ফোনেই যদি সব হয়ে যায়, তা হলে গাড়ির ভিড় ঠেলে কেন লোকে দোকানে আসবেন?’’ গলায় একরাশ হতাশা জড়িয়ে বললেন চিলু।

একই সঙ্গে তিনি মনে করেন, শুধু অনলাইনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে ওঠার বিষয় নয় এটা। সমস্যা আরও গভীরে। একটা নতুন প্রজন্মের সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির বদলও এর জন্য অনেকটা দায়ী বলে মনে করেন তিনি। চিলু বলেন, ‘‘আগে লোকে বই পড়তেন মনের শান্তির জন্য, জ্ঞানের জন্য। এখন অনেকেই পড়েন চটজলদি কিছু জানার জন্য। ইনস্টাগ্রাম এবং ফুড ভ্লগিং বই নিয়ে ভালবাসাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে।’’

দোকানটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৮০-এর দশকে সানাউল্লাহ চিলুর হাতে। ২০১৭ সালে সানাউল্লাহর ছেলে সানি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দোকানের দায়িত্ব কাঁধে নেন। দোকানের ভিতরের সাজসজ্জায় বদলের পাশাপাশি বইয়ের সংগ্রহ আরও বাড়ানোয় নজর দেন। উপন্যাস, নন-ফিকশন, কাশ্মীরি ইতিহাস, ইসলামি সাহিত্য, পরিবেশ ও দুর্লভ কবিতার বহু বই জমা হয় তার তাকে।

কাশ্মীরের বইপ্রেমীদের কাছে এই দোকান নিছক একটা বইয়ের দোকান ছিল না। তাঁদের কাছে এটা যেন ধনভান্ডার। ছাত্রছাত্রী, গবেষক, এমনকি সাধারণ পাঠকও এখানে এমন সব বই খুঁজে পেতেন, যেগুলোর খোঁজ উপত্যকার প্রায় কোথাওই মিলত না। সাহির লুধিয়ানভি ও সাগর সিদ্দিকীর দিওয়ান থেকে শুরু করে পত্রাস বুখারির প্রবন্ধ, দুর্লভ সুফি রচনাবলী থেকে ও. হেনরি বা আর্থার কোনান ডয়েলের সম্পূর্ণ সংগ্রহ— গোটা দোকানটা যেন ছিল সাহিত্যের এক গোলকধাঁধা।

এই দোকানের দীর্ঘদিনের ক্রেতা ও বর্তমানে লেখক ফয়জ়ান বাট বলেন, ‘‘আমি অষ্টম শ্রেণি থেকে এখানে আসছি। ১৭ বছর হয়ে গেল! সানাউল্লাহ আঙ্কল আমাদের পরিবারের সদস্যের মতোই দেখতেন। আমরা সস্তায় বই পেতাম, কখনও কখনও বাকিতেও নিতাম। আমার জন্য এই দোকানটা শুধু বই কেনার জায়গা ছিল না। এটা ছিল বাড়ির মতো।’’

বিশিষ্ট কলামচি খাওয়ার খান আচকজ়াই বলেন, ‘‘এটাই ছিল কাশ্মীরের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ বইয়ের দোকান, যেখানে সাহিত্য, রাজনীতি, কবিতা, দর্শন, ইতিহাস সবই ছিল। সানি সব সময় সাহায্য করতেন। একবার তিনি উপত্যকার বাইরে ভ্রমণের সময় আমার জন্য বিরল বই এনে দিয়েছিলেন।’’ তাঁদের কাছে এটা শুধু একটা বইয়ের দোকান বন্ধ হওয়া নয়, এটা শ্রীনগরের একটি সাংস্কৃতিক ছন্দের ক্ষয়প্রাপ্তির সংকেত। চিলু নিজেও সেটা মেনে নিয়ে বললেন, “ইয়াকুব বুকসেলারস এখন বেকারি হয়ে গেছে! প্রেজেন্টেশন বুকস, গ্লোবাল বুকস, লর্ডস, বুক ভিশন, শাহ বুক স্টোর—সবই বন্ধ। শিগগিরই, এখানে বইয়ের দোকান শুধু স্মৃতিতে বা অনলাইন প্রবন্ধে থাকবে।”

সমাজমাধ্যমেও অনেকে নিজেদের অনুভূতি জানিয়েছেন। একজন লিখেছেন, ‘‘শ্রীনগরে এখন ক্যাফে বেশি গজাচ্ছে! বইয়ের দোকান কমছে, ক্যাপুচিনো বাড়ছে! হয়তো এটাই এখন আমাদের পরিচয়!’’

আরও পড়ুন