C. V. Ananda Bose

চাকরি শুরু চৌরঙ্গির স্টেট ব্যাঙ্কে, থাকতেন রাসবিহারীতে, ‘বোস’-এর নয়া ঠিকানা রাজভবন

১৯৭৭ থেকে ১৯৭৯, দু’বছর স্টেট ব্যাঙ্কের প্রোবেশনারি অফিসার হিসেবে কলকাতায় কাজ করেছেন। সেই সময়েই মালয়ালমে তাঁর ছোটগল্পের সংকলন প্রকাশিত হয়।

Advertisement
প্রেমাংশু চৌধুরী
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০২২ ০৬:৪৬
সি ভি আনন্দ বোস। শুক্রবার দিল্লিতে। নিজস্ব চিত্র।

সি ভি আনন্দ বোস। শুক্রবার দিল্লিতে। নিজস্ব চিত্র।

কলকাতার সাংবাদিক শুনেই একগাল হেসে স্পষ্ট বাংলায় বললেন, “আমি বাংলা শিখছি।’’ আনন্দবাজার পত্রিকার নাম শুনে বললেন, “আমার নামের মধ্যেও তো আনন্দ রয়েছে।’’ তাঁর দাবি, তিনি চেহারাতেই মালয়ালি। মন থেকে বাঙালি। বাবা সুভাষচন্দ্র বসুর ভক্ত ছিলেন বলে জন্মের পরেই নামের সঙ্গে ‘বোস’ জুড়ে গিয়েছিল। চাকরি জীবনের শুরু হয়েছিল কলকাতায় শ্যামবাজার ও চৌরঙ্গির স্টেট ব্যাঙ্কের শাখায়। থাকতেন রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ে। পঁয়তাল্লিশ বছর পরে তাঁর নতুন ঠিকানা হতে চলেছে কলকাতার রাজভবন।

পশ্চিমবঙ্গের নতুন রাজ্যপাল, কেরলের সি ভি আনন্দ বোস অবশ্য তাঁর সাংবিধানিক ভূমিকা নিয়ে নিঃসংশয়। শুক্রবার একান্ত আলাপে বোস বলেন, “আমার দায়িত্ব হবে, রাজ্য সরকার যাতে তার সাংবিধানিক গণ্ডির মধ্যেই কাজ করে, তা দেখা।’’ আর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর সংঘাতের সম্ভাবনা নিয়ে চর্চা প্রসঙ্গে আনন্দ বোসের স্পষ্ট মন্তব্য, “আমি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাজ করতে যাচ্ছি। রাজনৈতিক নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে নয়।” বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে পশ্চিমবঙ্গের নতুন রাজ্যপাল হিসেবে তাঁর নাম ঘোষণা হয়েছে। এখনও মমতার সঙ্গে কথা না হলেও বোস বলছেন, “আমার সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক স্তরে ইতিমধ্যেই যোগাযোগ তৈরি হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের প্রতিনিধি হিসেবে দিল্লিতে রাজ্যের রেসিডেন্ট কমিশনার আমার সঙ্গে দেখা করে গিয়েছেন।’’

Advertisement

বর্তমানে উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড় পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল থাকাকালীন তাঁর সঙ্গে তৃণমূল সরকারের সংঘাত নতুন রাজ্যপালের অজানা নয়। তা নিয়ে প্রশ্নে আনন্দ বোস বলছেন, “জগদীপ ধনখড় দেশের উপরাষ্ট্রপতি। তাঁকে সম্মান করি। আমি নিজের স্টাইলে কাজ করব।’’ তাঁর আশ্বাস, তিনি রাজ্য সরকারের সঙ্গে ‘নিরবচ্ছিন্ন সহযোগিতা’ বজায় রেখেই চলবেন। আর সেই কারণেই ‘রাজ্যপাল হিসেবে কোনও চ্যালেঞ্জ’-এর আশঙ্কাও তিনি করছেন না। তাঁর ইঙ্গিত, রাজ্য সরকার সাংবিধানিক গণ্ডির মধ্যে থেকে কাজ করলে তিনিও সহযোগিতা করবেন।

মোদী জমানায় রাজ্যপালের দফতরকে রাজনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগানোর অভিযোগ তুলছেন বিরোধীরা। পশ্চিমবঙ্গ থেকে তামিলনাড়ু, তেলঙ্গানার মতো বিরোধী শাসিত রাজ্যে রাজ্যপালরা বিজেপি নেতানেত্রীর মতো আচরণ করেছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। ২০১১-তে আইএএস-এর চাকরি থেকে অবসর নেওয়া আনন্দ বোসের শান্ত কণ্ঠে জবাব, “যখন কংগ্রেস ক্ষমতায় ছিল, তখনও সংঘাত হয়েছে। রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রীর মতপার্থক্য নতুন নয়। এটা কোনও সমস্যাও নয়। মতভেদ গণতন্ত্রের অংশ। ইচ্ছে থাকলেই সমাধান হয়। আমি বাংলার মানুষের উপরে আস্থা রাখি। তাঁরা ঠিক সিদ্ধান্ত নেবেন।’’

পশ্চিমবঙ্গ ও কেরল, দুই রাজ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হিসেবে রাজ্যপালের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক চলছে। ধনখড়ের সময়েই তৃণমূল সরকার রাজ্যপালের বদলে মুখ্যমন্ত্রীকে আচার্যের পদে বসাতে বিধানসভায় বিল পাশ করিয়েছিল। সেই বিলে এখনও রাজ্যপালের প্রয়োজনীয় সম্মতি মেলেনি। রাজ্যপাল হয়ে তিনি এ বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেন, তার অপেক্ষায় থাকছে রাজনৈতিক মহল। আনন্দ বোস বলেন, “আমি গিয়ে বিষয়টি খতিয়ে দেখব।’’ তবে তাঁর মতে, গোটা বিষয়টিই ‘নন-ইস্যু’। একেবারেই ‘সাময়িক’ বিতর্ক। কে আচার্য হবেন, সেটা আইন অনুযায়ী ঠিক হবে। রাজ্যপাল আচার্য হলে তাঁর পূর্ণ স্বাধীনতা থাকতে হবে। এমনিতে কোনও সমস্যাই নেই। বিবাদটা ‘রাজনৈতিক’ হলে সংবিধানের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

১৯৭৭ থেকে ১৯৭৯, দু’বছর স্টেট ব্যাঙ্কের প্রোবেশনারি অফিসার হিসেবে কলকাতায় কাজ করেছেন। সেই সময়েই মালয়ালমে তাঁর ছোটগল্পের সংকলন প্রকাশিত হয়। সেই বইয়ের নাম ছিল ‘চৌরঙ্গির ফুলগুলি’। কলকাতার বস্তির ছেলে মুন্নার গল্প। সেই সময়ই আইএএস-এর প্রস্তুতি নেন। আমলা হিসেবে কেরলে ‘সকলের জন্য আবাসন’-এর লক্ষ্যে তাঁর কাজ দেখে মুগ্ধ হয়ে জ্যোতি বসু প্রস্তাব দিয়েছিলেন, বক্রেশ্বরে গিয়ে গরিবদের জন্য কম খরচে আবাসন তৈরির করার। ২০১৪-র লোকসভা ভোটে নরেন্দ্র মোদী নিজে তাঁকে ফোন করে কেরলের কোল্লম থেকে বিজেপির প্রার্থী হতে বলেন। মোদী নিজে প্রচারে গিয়ে তাঁকে জিতিয়ে আনার চেষ্টা করবেন বলেও কথা দিয়েছিলেন। বোস বলেছিলেন, তিনি ‘ইলেকশন মেটিরিয়াল’ নন। পরে বিজেপিতে যোগ দিলেও তাঁর বক্তব্য, “প্রধানমন্ত্রীকে কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে। গরিব মানুষের জন্য কাজ করেন। সমালোচনায় কান দেন না।’’ একইসঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাজের ধরনও ‘ইউনিক’ বলে তাঁর মত।

রাজ্যপাল হিসেবে নাম ঘোষণার পরে অনেকেই প্রথমে সি ভি আনন্দ বোসকে বাঙালি ভেবে ভুল করেছিলেন। বোস বলেন, ‘‘বাবা বাসুদেবন নায়ার ছিলেন নেতাজির ভক্ত। আমাদের পাঁচ ভাই, তিন বোনের মধ্যে ছয় জনের নামের শেষেই তাই বোস জুড়ে দিয়েছেন। আমার পুত্র বাসুদেব ও প্রয়াত কন্যা নন্দিতার নামের শেষেও বোস রয়েছে।’’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একনিষ্ঠ পাঠক বোস ‘শপথ’ করেছেন, রোজ একটি করে নতুন বাংলা শব্দ শিখবেন। কিছু দিন পরে ভাঙা বাংলাতেই কলকাতার মানুষের সঙ্গে কথা বলবেন। পারলে বাংলায় একটা বই লেখারও চেষ্টা করতে পারেন!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement