মালবাহকের পোশাকে রাহুল গান্ধী। নয়াদিল্লির আনন্দ বিহার রেল স্টেশন। ডান দিকে, ‘কুলি’ ছবির পোস্টারে অমিতাভ বচ্চন। ছবি: পিটিআই।
মাথায় ভারের বোঝা, কিন্তু মুখে হাসি। গায়ে লাল টকটকে জামা। একেলে ভারতের নানা আধুনিক পালিশেও অবিকৃত রেলস্টেশনের কুলির ছবি। বৃহস্পতিবার সকালে দিল্লির আনন্দ বিহার স্টেশনে রাহুল গান্ধীর ‘কুলি-অবতার’ এক ধাক্কায় ফিরিয়ে দিচ্ছে চার দশক আগের একটি স্মৃতি। ১৯৮৩-র ‘কুলি’ ছবির পোস্টারে অমিতাভ বচ্চনকে এমনই চেহারায় দেখে আসমুদ্রহিমাচল।
এ কি নিছকই নেতাগিরির ঝকমারি? বা নেতার অভিনেতা হওয়ার চিরকেলে দায়? দেশ জুড়ে চলছে জল্পনা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক শিবাজীপ্রতিম বসু বলছিলেন, ‘‘এ তো নতুন কিছু নয়! রাহুলের ‘কুলি’ হওয়ার মধ্যে মোদীর চাওয়ালা’ ভাবমূর্তিরও একটা জবাব রয়েছে ভাবা যেতে পারে!’’ আবার একই সঙ্গে কিছু খটকাও তৈরি হচ্ছে ছবিটা দেখে। কারণ, আজকের জি২০ আমেজে সুরভিত মোদী তাঁর সেই চাওয়ালা মূর্তিকেই অনেক পিছনে ফেলে এগিয়ে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিকতম ছবিটি নতুন সংসদ-ভবনে। ঝকঝকে পোশাকে, চকচকে মুখে, মানানসই পাতলা ফাইল হাতে হেঁটে যাচ্ছেন। এর পাশে উস্কোখুস্কো দাড়িতে কুলিবেশী রাহুল দৃশ্যতই আলাদা। আবার দু’টি ছবিই কারও আরোপিত লাগতে পারে।
তবু মালবাহকদের সঙ্গে একাত্মতা খানিক সাবেক রাজনীতির ধাঁচ বলে মনে হয়। আনন্দ বিহার স্টেশনের কুলিদের ভিড়ে রাহুলকে দেখে অনেকেই বলছেন, এ তো জি২০ শীর্ষ সম্মেলনের চোখ ধাঁধানো দিল্লি নয়। নতুন সংসদ ভবনের মাখন-মসৃণ অলিন্দের ছবিও নয়। বরং জি২০ সম্মেলন উপলক্ষে স্বদেশের যে ক্লিষ্ট ক্লান্ত মুখখানি মোটা কাপড়ের পর্দায় মুড়ে ফেলা হয়েছিল, এ ছবি সেই আড়ালের কথা বলে।
পুরনো ভারতে সিনেমার অতিবাস্তব কুলিকে সমাজের স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে মূর্তিমান বিদ্রোহ হিসেবে ভাবতে কারও সমস্যা ছিল না। স্বাধীনোত্তর ভারতে সেই ‘দো বিঘা জ়মিন’-এর দিনকাল থেকে গরিব চাষি, শহুরে কুলি, রিকশাওয়ালাদেরও আমরা সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে দেখেছি। নায়ক গরিব হবে, কষ্ট পাবে, কিন্তু আদর্শচ্যুত হবে না। রাজ কপূর, গুরু দত্ত থেকে মনোজ কুমারের দেশপ্রেমের সিনেমাতেও নায়ককে নিম্নবর্গের চরিত্র হিসেবে দেখা গিয়েছে। কুলি-তে রাগী যুবক অমিতাভ ধর্মে মুসলিম। নাম ইকবাল। তিনিও বলিউডের পুরনো ধারাবাহিকতা বহন করছেন।
আজকের ‘জওয়ান-মুখরিত’ ভারতেও শ্রমিক, কৃষকের কথা সিনেমায় বলা হয় হয়তো, তবু প্রতিপত্তিশালী রাজনৈতিক শিবির তার সংস্রব কার্যত এড়িয়ে চলে। বড়জোর কিছু অনুদান ছুড়ে দেয়। রাহুল গান্ধীকে ‘কুলি’র ভূমিকায় দেখাকে তাই নিছক অভিনয় বলতে রাজি নন কেউ কেউ। ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’য় রাহুলের দীর্ঘ পদযাত্রা বা পরে ধানের চারা রোপণ, লাদাখে মোটরবাইক-অভিযানের ছবিও ইদানীং দেখা গিয়েছে। ওই সব ছবির মতো কুলিগিরির ছবিকেও কেউ কেউ এক ধরনের প্রাণবন্ত উদ্যমের ছবি হিসেবেও দেখা যায় বলে মনে করছেন।
তবু এ সব ছবিতে দেশে কুলিদের মর্যাদা, অধিকার পাল্টাবে— তেমন আশাও কারও নেই বললে চলে। ফিল্ম স্টাডিজ়ের অধ্যাপক মৈনাক বিশ্বাস বলছেন, ‘‘ভোটের দায়ে দলিতের পদসেবা করেও অনেকে ছবি তোলেন। কিন্তু শ্রমজীবীর ভূমিকা সাধারণ ভাবে গৌণই হয়ে পড়েছে রাজনীতি বা মিডিয়ায়।’’