টিকা নিতে লাইনে অপেক্ষায়। ফাইল চিত্র।
চলতি বছর শেষের আগেই দেশের সমস্ত প্রাপ্তবয়স্কের (১৮ বছর কিংবা তার বেশি) টিকাকরণ সেরে ফেলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কেন্দ্র। হলফনামায় তা জানিয়েছে সুপ্রিম কোর্টে। নবান্নের দাবি, সেই কথা রাখতে আগামী কয়েক মাসে গড়ে ২.৮ কোটি (প্রায় ৩ কোটি) ডোজ় টিকার জোগান প্রয়োজন এই রাজ্যে। অথচ সম্প্রতি ফি মাসে আপাতত ৬০-৭০ লক্ষ ডোজ় জোগানোর কথা বলেছে কেন্দ্র! ফলে রাজ্যের বক্তব্য, আগামী দিনে টিকার সরবরাহ বহু গুণ না-বাড়ালে, বেঁধে দেওয়া সময়সীমার মধ্যে সকলের টিকাকরণ অসম্ভব হয়ে দাঁড়াতে পারে। মাসে ৬০ লক্ষ করে আসা ডোজ়ে সকলের দু’ডোজ় টিকাকরণে সময় লেগে যেতে পারে প্রায় দু’বছর (হিসেব সঙ্গের সারণিতে)। সে ক্ষেত্রে কোভিডের তৃতীয় ঢেউ সামাল দেওয়া যাবে কী ভাবে, তা নিয়ে শঙ্কিত তারা।
এ কথা ঠিক যে, অনেকে টিকা নিচ্ছেন বেসরকারি হাসপাতাল থেকে। যা প্রতিষেধক নির্মাতাদের কাছ থেকে সরাসরি কিনছে তারা। ফলে সেই সংখ্যা বাদ যাওয়ার কথা ‘বকেয়া’ ১৪ কোটি ডোজ় থেকে। কিন্তু প্রশাসন সূত্রের বক্তব্য, ২০১১ সালের পরে আর কোনও জনগণনার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়নি। অথচ মাঝের সময়ে জনসংখ্যা বেড়েছে অনেকখানি। রাজ্যে রেশন কার্ডই ১০ কোটির বেশি। ফলে প্রাপ্তবয়স্কের সংখ্যা প্রাথমিক ভাবে যা অনুমান করা হয়েছিল, বহু জায়গাতেই কাজে নেমে দেখা যাচ্ছে, আদতে তা ঢের বেশি। তার উপরে, বেসরকারি হাসপাতাল থেকে পকেটের কড়ি গুনে প্রতিষেধক নেওয়া মানুষ মোট জনসংখ্যার অনুপাতে নিতান্ত কম। বেশির ভাগই নিখরচার সরকারি টিকার মুখাপেক্ষী। তাই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে টিকা নেওয়ার হিসেব ধরলেও, রাজ্যকে টিকার জোগান না-বাড়ালে, দু’বছর লেগে যাওয়ার আশঙ্কা অমূলক নয় বলেই প্রশাসনের একাংশের ধারণা।
প্রশাসনিক সূত্রের বক্তব্য, এত দিন টিকা মিলছিল আরও কম। বরং সম্প্রতি এ বার থেকে প্রতি মাসে অন্তত ৬০-৭০ লক্ষ ডোজ় সরবরাহের আশ্বাস দিয়েছে কেন্দ্র। তা হয়তো মন্দের ভাল। কিন্তু ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পূর্ণ টিকাকরণের লক্ষ্যভেদ তাতে অসম্ভব। প্রশাসনের অন্দরের বক্তব্য, ‘‘যেখানে দিনে প্রায় ১০ লক্ষ ডোজ় দরকার, সেখানে মাসে মাত্র ৬০-৭০ লক্ষে চিঁড়ে ভিজবে কী করে? এ তো প্রয়োজনের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ!’’
হিসেব অমিল
• রাজ্যে সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ককে টিকা দিতে লাগবে প্রায় ১৬.৫ কোটি ডোজ়।
• তার মধ্যে দেওয়া হয়েছে ২.৫ কোটি। বাকি প্রায় ১৪ কোটি ডোজ়।
• অর্থাৎ, ডিসেম্বরের মধ্যে সকলকে টিকা দিতে প্রতি মাসে লাগবে গড়ে ২.৮ কোটি ডোজ়।
• অথচ কেন্দ্র জানিয়েছে, এখন মাসে তা মিলবে ৬০-৭০ লক্ষ করে!
• এই হারে (৬০ লক্ষ) প্রতিষেধক এলে, সকলকে তা দিতে লাগবে ২৩ মাসেরও বেশি। প্রায় দু’বছর!
কেন্দ্র শীর্ষ আদালতে জানিয়েছে, জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ডোজ় দিতে পারেনি কেন্দ্র। তাই আগামী দিনেও তা কী ভাবে অতখানি বাড়বে, সে বিষয়ে খুব নিশ্চিত নয় স্বাস্থ্য দফতর।
টিকার জোগানে সংখ্যার পাশাপাশি আর এক সমস্যা তা ঘিরে অনিশ্চয়তা। স্বাস্থ্যকর্তাদের অনেকে বলছেন, বিগত মাসগুলিতে টিকার জোগান ওঠা-নামা করেছে বিস্তর। আগামী ১৫ দিন কিংবা এক মাসে শেষমেশ কত টিকা হাতে আসবে, সে বিষয়ে প্রায় সূ সময়ই কিছুটা ধোঁয়াশা থেকেছে। এক কর্তার কথায়, “এ মাসে এখনও পর্যন্ত ২৫ লক্ষ ডোজ় টিকা এসেছে। বুধবার আরও তিন লক্ষ আসার কথা। তার পরেও কিন্তু এ মাসে আরও অন্তত ৩২ লক্ষ ডোজ় আসা বাকি।’’ তাঁদের প্রশ্ন, এই পরিস্থিতিতে কী ভাবে ‘হাত খুলে’ টিকাকরণ করবে রাজ্য?
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৫ লক্ষ জনের প্রথম ডোজ় (কোভিশিল্ড) নেওয়ার পরে ৮৪ দিন পেরিয়েছে। অর্থাৎ, সবার আগে তাঁদের দ্বিতীয় ডোজ় দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে (জেলাগুলিকে এই নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্য ও স্বাস্থ্যসচিব)। ৮৪ দিন এখনও হয়নি, এমন প্রথম ডোজ় প্রাপকের সংখ্যাও প্রায় ৫.৯০ লক্ষ। অর্থাৎ, এর পরেই অগ্রাধিকার তাঁরা। এই পরিস্থিতিতে জোগান নিশ্চিত না-হলে, নতুন করে প্রথম ডোজ় যথেষ্ট সংখ্যায় দেওয়া কঠিন বলে প্রশাসনিক সূত্রে দাবি। এক কর্তার কথায়, “প্রতি মাসে জোগান নির্দিষ্ট হলে, ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনামাফিক হওয়া সম্ভব। এত দিন জোগানের ওঠা-পড়ায় তা করতে বেগ পেতে হচ্ছিল।” আগামী দিনে অবশ্য আলোচনায় সমস্যা মেটার বিষয়ে আশাবাদী তাঁরা।