সকাল থেকেই গোটা শ্রীনগর ছিল থমথমে। —ফাইল চিত্র।
বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো!
শ্রীনগর-জম্মু হাইওয়ে ধরে অবন্তীপোরা পৌঁছতেই ঝটকা মেরে গাড়ি থামিয়ে দিলেন চালক। মুহূর্তে জলপাই রঙের ক্যামোফ্লাজ উর্দি পরা একদল সেনা ঘিরে ধরল সেডান গাড়িটি। নেমে আসতে বলা হল দ্রুত। হাতে উদ্যত ইনস্যাস। কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি, কী দরকার— উড়ে আসতে লাগল প্রশ্নবাণ। সে সব সামলে জানা গেল, সামনে আর এগোনো যাবে না। কোলাঘাট থেকে বাঙালি পর্যটকদের একটা গাড়িও আটকে দেওয়া হল। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ হেলিকপ্টারে ঘুরে এলেও, আজ দিনভর সেনা-আধাসেনা-জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ-র বড় কর্তারা তদন্তের উদ্দেশ্যে হামলাস্থলে রয়ে গিয়েছেন। তদন্তের স্বার্থে তাই পহেলগামে সংবাদমাধ্যম থেকে পর্যটক, সকলের প্রবেশ নিষিদ্ধ।
আমাদের গাড়ি যেখানে থেমেছিল, সেই এলাকাটির নাম সঙ্গম। অবন্তীপোরার এইখানে মিশেছে লিডার ও ঝিলম নদী, যা থেকে সঙ্গম নামের উৎপত্তি। ঘটনাস্থল বৈসরনের দূরত্ব এখান থেকে মেরেকেটে ষাট কিলোমিটার। গাড়িতে ঘণ্টা দুয়েকের পথ। আজ জম্মু-শ্রীনগর হাইওয়ে জুড়ে যে পরিমাণ তল্লাশি, অ্যান্টি-মাইন গাড়ি, নাকা চেকিং, আধা সেনা, সেনা ও পুলিশের উপস্থিতি, তা দেখে একটাই প্রশ্ন— কাল এই নিরাপত্তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি কেন?
সকাল থেকেই আজ গোটা শ্রীনগর ছিল থমথমে। স্থানীয় ব্যবসায়ী সংগঠন, পরিবহণ ব্যবসায়ীদের ডাকা বন্ধে সাড়া মিলেছে আশাতীত। সকালের মধ্যেই সমস্ত মৃতদেহ পুলিশ কন্ট্রোল রুমে নিয়ে আসা হয়। দশটা নাগাদ সেখানে এসে মৃতদের উদ্দেশে শেষ শ্রদ্ধা জানান অমিত শাহ। কথা বলেন পরিজনের সঙ্গে। তার পরেই বৈসরনের উদ্দেশে বেরিয়ে যান তিনি। ঘটনাস্থল ঘুরে শীর্ষ পদাধিকারীদের সঙ্গে বৈঠক সেরে দিল্লি ফিরে যান। সারা দিনে আজ ১৫০০ লোককে আটক করা হয়েছে। জঙ্গিদের সম্পর্কে তথ্য দিলে ২০ লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে।
এই হামলায় উপত্যকার স্থিতাবস্থা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা যে রয়েছে, মেনে নিচ্ছেন সকলেই। যে হারে পর্যটকদের বুকিং বাতিল হচ্ছে, অর্থনীতিতে তার প্রভাব পড়তে চলেছে। হোটেলমালিক আসগর ভাট, গাড়িচালক দিলশাদ কথাটা মেনে নিলেন । পর্যটক হত্যার দায় নেওয়া লস্কর-ই-তইবার ছায়া সংগঠন ‘দ্য রেজ়িস্ট্যান্স ফোর্স’ (টিআরএফ) তাদের বিবৃতিতে দাবি করেছে, ‘যাদের উপর হামলা চালানো হয়েছে, তারা পর্যটকের ছদ্মবেশে নৌসেনা ও গোয়েন্দা বিভাগের সদস্য ছিল। নিহত বিদেশিরা দিল্লির নিয়োগ করা আন্ডার-কভার এজেন্ট।’ গোয়েন্দাদের মতে, কাশ্মীরের আমজনতার পেটে টান পড়তে চলেছে বুঝেই সংবাদমাধ্যম থেকে মৃতদের পরিচয় জেনে পাল্টা যুক্তি সাজিয়েছে জঙ্গিরা। জঙ্গিদের তরফে আরও অভিযোগ, সংবিধান সংশোধনের পরে যে নয়া আবাসিক আইন হয়েছে, তার সুবাদে বাইরের লোকেরা জমি কিনে উপত্যকার জনবিন্যাস পরিবর্তনের ছক কষছে। সেই কারণে ‘ধর্ম নয়, তাঁরা স্থানীয় না বাইরের লোক’ সেই পরিচয়ের ভিত্তিতে হত্যা করা হয়েছে।
যে নৈসর্গিক সৌন্দর্য বৈসরনকে ‘মিনি সুইৎজ়ারল্যান্ড’-এর অ্যাখ্যা দিয়েছে, সেই ভূ-প্রকৃতিকেই হামলার জন্য দায়ী করছেন গোয়েন্দারা। পহেলগামের সুদূর দক্ষিণ প্রান্তে বৈসরন মূল শহর থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। ঘোড়ায় চেপে প্রায় এক ঘণ্টা নদী-নালা, জঙ্গল ও কাদা রাস্তার পথ পেরিয়ে পৌঁছতে হয়। চারপাশে ঘন জঙ্গল চলে গিয়েছে ভারত-পাক সীমান্ত পর্যন্ত। এই পথ দিয়েই জঙ্গিরা অনুপ্রবেশ করেছিল এবং হামলার পরে নির্বিঘ্নে জঙ্গলে মিলিয়ে গিয়েছিল বলে মনে করা হচ্ছে। রাস্তা না থাকায় গাড়ি চলা দুষ্কর। জঙ্গলের রাস্তাও বিপজ্জনক, পা ফস্কালেই গিরিখাতে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। সূত্রের মতে, সেই কারণে নজরদারির জন্য ড্রোন, কাঁটাতার ও ক্যামেরার উপরেই মূলত ভরসা রাখা হয়েছিল। বৈসরনে জঙ্গি উপদ্রবের অতীত ইতিহাস নাথাকায় নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হয়নি।
হাতে আঁকা জঙ্গিদের এই তিনটি ছবি প্রকাশ করেছে পুলিশ। ছবি: পিটিআই।
ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে অবশ্য সীমান্ত এলাকায় বাহিনীর দায়িত্বে থাকা এক বাঙালি বিএসএফ অফিসারের আফশোস, ‘‘আসলে ড্রোন বা ক্যামেরা কোনও বিশেষ এলাকার উপরে নজর রাখতে পারে। মোবাইলে কথাবার্তাও আড়ি পেতে শোনা সম্ভব। কিন্তু স্থানীয় মানুষের কাছ থেকে যে তথ্য পাওয়া যায়, তার কোনও বিকল্প নেই।’’ স্থানীয়দের সঙ্গে আস্থা বাড়িয়ে তাঁদের ভরসা জেতার মাধ্যমে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের যে চিরাচরিত প্রথা, তা যন্ত্রের অধিক ব্যবহারের ফলে কমে আসছে। যা সাম্প্রতিক সময়ে হামলা বাড়ার একটি অন্যতম কারণ।
প্রশ্ন উঠেছে, হামলার পরে ঘটনাস্থলে রি-ইনফোর্সমেন্ট আসতে দেরি হল কেন? প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, শারীরিক ভাবে অতি সক্ষম ব্যক্তিরও পহেলগাম থেকে ওই স্থানে পৌঁছতে অন্তত ৪০ মিনিট সময় লাগার কথা। এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই বললেই চলে। তাই খবর পাওয়ার পরে পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে সম্ভাব্য হামলার আশঙ্কা মাথায় রেখেই নিরাপত্তাবাহিনী সেখানে পৌঁছয়। তাতে বেশ অনেকটা সময় লেগে যায়।
গোয়েন্দা সূত্রে এও বলা হচ্ছে, হামলার আগে বেশ কিছু দিন জঙ্গলে ওত পেতে পর্যটকদের গতিবিধি নজরে রেখেছিল জঙ্গিরা। হামলা কখন হবে, কোন পথে হবে, ফিরে যাওয়ার রাস্তাই বা কী হবে— তা ঠিক করতে জঙ্গলে রাত কাটিয়েছিল। এলাকায় কোনও গ্রাম না থাকায় তাদের এই সক্রিয়তা নজর এড়িয়ে যায়। ওই হামলা চালাতে বিদেশি জঙ্গিদের অন্তত দু’জন স্থানীয় জঙ্গি সাহায্য করেছে বলে জানা গিয়েছে। সর্বাগ্রে তাদের চিহ্নিত করার কাজ শুরু হয়েছে। হামলার আগে ও পরে পাকিস্তানের সঙ্গেও জঙ্গিরা যোগাযোগ রেখে চলেছিল বলে জানা গিয়েছে। জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের পদস্থ এক কর্তার ব্যাখ্যা, ‘‘রোজ প্রায় দেড়-দু’হাজার পর্যটক যান ওই এলাকায়। বেছে বেছে হত্যা করায় সংখ্যাটি তিরিশের নীচে রয়েছে।’’ ব্রাশ ফায়ারিং (বাছবিচার না করে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে গুলি চালানো) হলে কত হত, ভেবেই শিউরে উঠছেন ওই অফিসার। তাঁর মতে, অন্তত জনা দশেক জঙ্গি গত কালের ঘটনায় সঙ্গে জড়িত ছিল, যার অধিকাংশই বিদেশি। এই মুহূর্তে দক্ষিণ কাশ্মীরে অন্তত ৬০ জন বিদেশিজঙ্গি সক্রিয় রয়েছে। কেন তাদের ধরা সম্ভব হচ্ছে না, সেই প্রশ্নের জবাব অবশ্য অধরা।