Sourced by the ABP
মানুষের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রক হরমোনের মধ্যে কর্টিসল অন্যতম। জীবনদায়ী হরমোনও বলে এটিকে। এটি অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি হরমোন হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ বাইরে থেকে কোনও আঘাত, প্রদাহ হলে সেটার প্রতিক্রিয়া হিসেবে কিডনির উপরে থাকা অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি থেকে কর্টিসল হরমোন বেরোয়। এই হরমোন কতটা বেরোবে, সেই মাত্রা আবার নিয়ন্ত্রণ করে পিটুইটারি গ্ল্যান্ড। সেখানে থাকা এসিটিএইচ (অ্যাড্রিনোকর্টিকোট্রপিক হরমোন) নিয়ন্ত্রণ করে, কর্টিসল কখন, কত পরিমাণে বেরোবে। মানুষের শরীরের রক্তচাপ, বিপাক হার, ফ্যাট বা শর্করার মাত্রা ঠিকঠাক রয়েছে কি না, তা স্থির করে দেয় কর্টিসলের ক্ষরণ।
হরমোনের কাজ
একে স্ট্রেস হরমোনও বলে। কোনও কারণে শরীরে স্ট্রেস হলে কর্টিসলের মাত্রা বেড়ে যায়। ছোটদের সার্বিক বৃদ্ধি, হাড়ের বৃদ্ধি যাতে ঠিক থাকে, তার জন্য কর্টিসলের মাত্রা যথাযথ হওয়া জরুরি। কোলেস্টেরল, ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা ঠিক থাকার জন্যও কর্টিসলের ভূমিকা রয়েছে।
হরমোনের মাত্রার তারতম্য
এন্ডোক্রিনোলজিস্ট ডা. অভিজিৎ চন্দ বললেন, “হরমোনের মাত্রা বেড়ে গেলে অর্থাৎ হাইপারকর্টিসলিজ়ম হলে তাকে বলা হয় কুশিং’স সিনড্রোম। সাধারণত অ্যাড্রিনাল বা পিটুইটারি গ্ল্যান্ডে টিউমর হলে এই সমস্যার উদ্ভব হয়। এসিটিএইচ বেড়ে গিয়ে অ্যাড্রিনালিনকে স্টিমুলেট করে।
কুশিং’স সিনড্রোম আবার একাধিক ধরনের হতে পারে। হরমোনের উৎস যখন অ্যাড্রিনালেও নয়, পিটুইটারিতেও নয়, তখন তাকে বলে এক্টোপিক কুশিং’স সিনড্রোম। বাইরের কোনও নিউরোএন্ড্রোক্রিন টিউমরের কারণে এসিটিএইচ নিঃসৃত হয় এবং অ্যাড্রিনালকে স্টিমুলেট করে কর্টিসলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় এ ক্ষেত্রে। আর এক ধরনের কুশিং’স সিনড্রোম তৈরি হয় দীর্ঘ দিন ধরে স্টেরয়েড নেওয়ার ফলে। দীর্ঘকালীন স্টেরয়েডের প্রভাবে কর্টিসলের মাত্রা অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া স্বরূপ তৈরি হয় নানা সমস্যা।
এর ঠিক উল্টো সমস্যাটি হল হাইপো অ্যাড্রিনালিজ়ম। অর্থাৎ প্রয়োজনের তুলনায় হরমোনের ক্ষরণ কম হওয়া। একে বলে অ্যাডিসন’স ডিজ়িজ়। অ্যাড্রিনাল গ্ল্যান্ডে কোনও সমস্যায় ক্ষরণ কমে যায়। কোনও অটোইমিউন ডিজ়িজ় বা ইনফেকশনের ফলেও অ্যাড্রিনাল গ্ল্যান্ড নষ্ট হতে পারে।
সমস্যা কী কী
কর্টিসলের মাত্রা বেড়ে গেলে ধীরে ধীরে শরীরের ওজন বাড়তে থাকে। পেটের অংশ স্ফীত হতে থাকে, হাত-পা সরু হয়ে যায়। পেটে লালচে, চওড়া স্ট্রেচ মার্কস দেখা দিতে পারে। হাড় দুর্বল হয়। ব্লাড প্রেশার বেড়ে যায়। মাসল লস ও মাসল উইকনেস দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া কর্টিসল হরমোন কমবেশি হওয়ার প্রভাব সরাসরি পড়ে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যে। সাইকোলজিক্যাল সমস্যা শুরু হতে পারে। সাইকোসিস, ডিপ্রেশনের মতো সমস্যার মুখোমুখি হন রোগীরা।
ছোটদের ক্ষেত্রে তাদের বৃদ্ধিতে সরাসরি প্রভাব পড়ে। যদি দেখা যায়, বাচ্চারা মোটা হয়ে যাচ্ছে অথচ তাদের উচ্চতা বাড়ছে না, তা হলে বুঝতে হবে কোনও সমস্যা আছে। ডা. চন্দ এ প্রসঙ্গে বললেন, ‘‘কোনও বাচ্চার যদি অতিপুষ্টির কারণে ওজন বাড়ে, তা হলে তার উচ্চতাও বাড়বে। কিন্তু কুশিং’সের ক্ষেত্রে শুধু ওজন বাড়ে, উচ্চতা বাড়ে না। প্রক্সিমাল মাসল উইকনেস দেখা দেয়। সুগার দেখা দিতে পারে।’’
শরীরে গ্লুকোজ়ের তারতম্যও অনেকাংশে নির্ভর করে কর্টিসলের মাত্রার উপরে। হঠাৎ তা বেড়ে গেলে ডায়াবেটোজেনিক এফেক্ট দেখা দেয়। কোলেস্টেরল, ট্রাইগ্লিসারাইড বেড়ে যায়। আর এই সব কিছুর প্রভাব পড়ে সেই রোগীর সার্বিক অনাক্রম্যতার উপরে। অর্থাৎ ইমিউনিটি কমে যায়। ইনফেকশন হওয়ার বা ঠান্ডা লেগে যাওয়ার প্রবণতা থাকে।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও সচেতনতা
অনেক সময়ে ড্রাগ অ্যাবিউজ়ের কারণেও শরীরে কর্টিসলের মাত্রা বেড়ে যায়। বিশেষত কমবয়সি ছেলেমেয়েরা স্বাস্থ্য ফেরানো বা ওজন বাড়ানোর জন্য যদি স্টেরয়েড খেতে থাকে, তা হলে তা পরোক্ষ ভাবে ক্ষতি করতে পারে। ডা. চন্দ বললেন, ‘‘অনেকেই জড়িবুটিতে বিশ্বাস করেন। স্টেরয়েড মেশানো আছে কি না, তা না জেনে অনেকেই এ ধরনের ওষুধ খান, যার সাইড এফেক্ট হয় পরবর্তী কালে। যত দিনে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বোঝা যায়, তত দিনে শরীর সেই হরমোনের উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। গ্ল্যান্ড কাজ করে না আর।’’
সাবধানতা ও নিয়ন্ত্রণ
এই হরমোনের ব্যবহার চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানেই হওয়া উচিত। ‘‘কতটা মাত্রায় দেব, তা পরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। লক্ষণ কমে গেলে তা বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করি। স্টেরয়েড নির্ভরতার ক্ষেত্রে সচেতন থাকা জরুরি,’’ বললেন ডা. চন্দ।
নির্ণয় ও চিকিৎসা
বাহ্যিক ভাবে হরমোনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তবে শরীরে কোনও টিউমরের কারণে হরমোনের মাত্রার তারতম্য হলে তা পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ণয় করা জরুরি। ‘‘টিউমর কোথায় আছে, তা নির্ণয় করার জন্য কিছু বায়োকেমিক্যাল টেস্ট করা হয়। অ্যাড্রিনাল গ্ল্যান্ডে সিটি স্ক্যান, পিটুইটারি গ্ল্যান্ডে এমআরআই করা হয় সাধারণত। আইসোটোপ স্ক্যানও করানো হয় প্রয়োজনে। টিউমর পাওয়া গেলে তা বাদ দেওয়া হয়। টিউমর বিনাইনও হতে পারে, ম্যালিগন্যান্টও। দ্বিতীয়টি হলে খুব তাড়াতাড়ি কুশিং’স প্রোগ্রেস করে,’’ বললেন ডা. চন্দ।
ওভার-ট্রিটমেন্ট হয়ে গেলেও ওজন অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে, অস্টিয়োপোরোসিসের সম্ভাবনা থাকে। যাঁরা দীর্ঘ দিন ধরে স্টেরয়েড খেয়ে চলেছেন, তাঁরা হঠাৎ তা বন্ধ করে দিলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তাই চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে এর নিয়ন্ত্রণ জরুরি।