প্যাকেটের দুধ কি ফুটিয়ে খাওয়া উচিত? ছবি : সংগৃহীত।
প্যাকেটজাত দুধ বাড়িতে আনার পরে প্রথম কী করেন? সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহার করার প্রয়োজন হলে নিশ্চয়ই সসপ্যানে ঢেলে এক বার ফুটিয়ে নেন! পরে ব্যবহার করতে হলেও অনেকে দুধ প্যাকট থেকে পাত্রে ঢেলে, ফুটিয়ে, ঠান্ডা করে তার পরে ফ্রিজে রেখে দেন। কেন? কারণ, ছোট থেকে তেমনটাই মায়েদের করতে দেখেছেন। বাড়িতে গোয়ালা দুধ দিয়ে যাক বা ডেয়ারি থেকে কিনে আনা প্যাকেটের দুধ আনা হোক— মায়েরা প্রথমেই দুধে এক বার জ্বাল দিয়ে নিতেন। তার পরে হয় বাড়ির ছোটদের গ্লাসে ভরে দেওয়া হত অথবা ব্যবহার করা হত বড়দের চায়ে। কিন্তু এখন বাজারে যখন পাস্তুরাইজ়ড বা আল্ট্রা পাস্তুরাইজ়ড দুধ পাওয়া যাচ্ছে, তখনও কি খাওয়ার আগে দুধে জ্বাল দেওয়া বা ফুটিয়ে নেওয়া জরুরি? না কি সরাসরি প্যাকেট থেকেই দুধ গ্লাসে ঢেলে খাওয়া যেতে পারে!
কেন দুধ খাওয়ার আগে ফুটিয়ে নেওয়া হয়?
কাঁচা দুধকে ৯৫ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেড বা তার বেশি তাপমাত্রায় ফোটালে তাতে থাকা সালমোনেলা বা ইকোলাইয়ের মতো জীবাণু নষ্ট হয়ে যায়। শুধু তা-ই নয়, দুধ ফোটালে তাতে থাকা ল্যাকটোজ় (যা কারও কারও ক্ষেত্রে অ্যাসিডিটি বা হজমের সমস্যা তৈরি করতে পারে)-এর পরিমাণও কমে। ল্যাকটোজ় বদলে যায় প্রোটিনে। ফলে হজমের সমস্যা কম হয়।
ছবি: শাটারস্টক।
প্যাকেটজাত দুধে কি জীবাণু থাকতে পারে?
প্যাকেটজাত দুধ বলতে এককালে ডেয়ারি থেকে কেনা চৌকো নরম প্লাস্টিকে সিল করা দুধই বুঝতেন সাধারণ মানুষ। এখন অবশ্য ডেয়ারি কিংবা সুপারমার্কেট নানা ধরনের প্যাকেজে দুধ পাওয়া যায়। নরম প্লাস্টিকে সিল করা দুধ ছাড়াও টেট্রা প্যাক, কাচের বোতল, এমনকি প্লাস্টিকের বোতলেও সুপারমার্কেটে পাওয়া যায় দুধ। ওই দুধ প্যাকেটজাত হওয়ার আগে কী ধরনের পরিশোধন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে, তা-ও লেখা থাকে প্যাকেটে। যেমন কোনওটিতে লেখা থাকে ‘পাস্তুরাইজ়ড’, কোনটিতে ‘টোনড’, আবার কোথাও লেখা থাকে ‘ইউএইচটি’। এই সমস্ত শব্দের অর্থ কী, তা অনেকেই সঠিক জানেন না। তাই দুধ ফোটানো জরুরি নাকি জরুরি নয়, তা-ও বুঝতে পারেন না। সে দিক থেকে দেখলে দুধ ফোটানোর প্রয়োজন আছে কি না, তা জানতে দুধের প্যাকেটে লেখাগুলির অর্থও বুঝে নেওয়া দরকার।
পাস্তুরাইজ়ড
পাস্তুরাইজ়েশন হল দুধকে একটি বিশেষ তাপমাত্রায় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য গরম করে নেওয়ার প্রক্রিয়া। যা দুধের স্বাদ এবং পুষ্টি নষ্ট না করেই ক্ষতিকর ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাস বা দুধে থাকা অণুজীবকে নষ্ট করে দিতে পারে।
— ফাইল চিত্র।
ইউএইচটি ট্রিটমেন্ট
ইউএইচটি ট্রিটমেন্ট হল আল্ট্রা হাই টেম্পারেচার ট্রিটমেন্ট অর্থাৎ দুধকে অতিরিক্ত গরম তাপমাত্রায় (প্রায় ১৪০-১৫০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে) কয়েক সেকেন্ডের জন্য রাখার প্রক্রিয়া। এতে দুধ পরিশোধিত হয়। একই সঙ্গে ফ্রিজে না রাখলেও চট করে খারাপ হয়ে যায় না। এই প্রক্রিয়াকে আলট্রা পাস্তুরাইজ়েশনও বলা হয়।
হোমোজেনাইজ়েশন
এই প্রক্রিয়া দুধের স্নেহপদার্থকে ভেঙে দেয়, যাতে দুধের মধ্যে ক্রিমের মতো স্তর না পড়ে। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে দুধ শোধনের কোনও সম্পর্ক নেই। তবে হোমোজেনাইজ়ড দুধ যদি পাস্তুরাইজ়ড হয়, তবে তা শোধন করা হয়েছে বুঝতে হবে।
আল্ট্রাফিল্টারেশন
দুধের প্যাকেটে ‘আল্ট্রাফিল্টার্ড’ লেখা থাকলে বুঝতে হবে তা থেকে জল, ল্যাকটোজ় এবং কিছু খনিজ পদার্থকে বাদ দেওয়া হয়েছে। বদলে রাখা হয়েছে প্রোটিন এবং ফ্যাটের মতো উপাদান। এই প্রক্রিয়ায় সাধারণত বহু ছিদ্রবিশিষ্ট এক ধরনের ‘ছাঁকনি’(যা আদতে সাধারণ ছাঁকনির মতো দেখতে নয়)-র মধ্যে দিয়ে কৃত্রিম চাপ তৈরি করে দুধকে ছাঁকা হয়। ফলে দুধে থাকা ছোট অণুবিশিষ্ট পুষ্টিগুণ বেরিয়ে যায়। থেকে যায় বড় অণুর পুষ্টিগুণ যেমন ফ্যাট আর প্রোটিন। তবে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গেও পরিশোধনের কোনও সম্পর্ক নেই। ‘আল্ট্রাফিল্টার্ড’ দুধ যদি পাস্তুরাইজ়ডও হয় তবে বুঝতে হবে দুধ পরিশোধন করা হয়েছে।
ছবি: সংগৃহীত।
টোনড এবং ফুল ফ্যাট
দুধের প্যাকেটে টোনড, ফুল ফ্যাট বা ফুল ক্রিম মিল্ক-ও লেখা থাকে। এর সঙ্গেও দুধের পরিশোধন প্রক্রিয়ার কোনও সম্পর্ক নেই। টোনড মিল্ক বা ফুল ফ্যাট মিল্ক লেবেলগুলি দেওয়া হয় দুধে থাকা স্নেহপদার্থের পরিমাণের নিরিখে। যদি ৩ শতাংশের কম ফ্যাট থাকে, তবে তা টোনড দুধ। ৬ শতাংশের বেশি ফ্যাট থাকলে তাকে বলা হবে ফুল ফ্যাট বা ফুল ক্রিম মিল্ক। এই ধরনের দুধ পাস্তুরাইজ়ড হলে তাকে জীবাণুমুক্ত বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে।
কোন দুধ ফোটাবেন? কোনটি ফোটাবেন না?
১। যে কোনও পাস্তুরাইজ়ড দুধ যদি যথাযথ ভাবে সিলড প্যাকে থাকে এবং ফ্রিজে সঠিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হয়, তবে সেই দুধ না ফুটিয়েও সরাসরি প্যাকেট থেকে খাওয়া যেতে পারে। তবে অবশ্যই দুধটি কত দিন পর্যন্ত খাওয়া যাবে, তার মেয়াদ দেখে নিতে হবে।
২। যদি দুধের প্যাকেট ছেঁড়া বা ফাটা হয় তবে দুধে ব্যাক্টেরিয়া তৈরির সম্ভাবনা থাকবে। সে ক্ষেত্রে দুধ ফুটিয়ে নেওয়াই ভাল।
৩। যদি দুধ কেনার সময় দেখেন, তা যথাযথ ভাবে ফ্রিজে রাখা নেই, তা হলে সেই দুধেও ব্যাক্টেরিয়া বা জীবাণুর সংক্রমণ হতে পারে। তাই ফুটিয়ে নেওয়াই ভাল।
ছবি: শাটারস্টক।
দুধ ফোটালে কি পুষ্টিগুণ কমে?
পুষ্টিবিদেরা সাধারণত বলে থাকেন, দুধ ফোটালে তা প্রথম ফুট ধরা পর্যন্তই গরম করুন। দীর্ঘ ক্ষণ ফোটানো দুধে পুষ্টিগুণ নষ্ট হয়ে যায়। তবে যদি সরাসরি গরুর দুধ কেনেন, তবে তা ফুটিয়ে নেওয়াই ভাল।
আল্ট্রা পাস্তুরাইজ়ড দুধ আগেই অতিরিক্ত তাপমাত্রায় পরিশোধন করা হয়। তাই তা আবার গরম করলে পুষ্টিগুণ নষ্ট হতে পারে।
পাস্তুরাইজ় দুধও ৭২ ডিগ্রি সেন্ট্রিগেডে ১৫ সেকেন্ড রাখা হয়। এতেও অধিকাংশ জীবাণুই নষ্ট হয়ে যায়। তাই যদি যথাযথ ভাবে সংরক্ষণ করা হয়, তবে তা ফোটানোর প্রয়োজন নেই।