Retirement Anxiety

কোহলির অবসর ঘোষণা ভাবাচ্ছে অনেককে, কাজ থেকে অবসর কি আনতে পারে উদ্বেগ? বাঁচার উপায় কী?

অবসর পরবর্তী জীবনের কথা ভাবতেই উদ্বেগ? মনে হয়, সারা দিন ফাঁকা সময় কাটাবেন কী করে? হঠাৎ নিজেকে মূল্যহীন মনে হয় কি? জীবনযাপনের মানের সঙ্গে আপস করার ভয় থাকে কি?

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০২৪ ১৮:৫০
হাতে বিশ্বকাপ কিন্তু সঙ্গে অবসরের  প্রস্তুতি।

হাতে বিশ্বকাপ কিন্তু সঙ্গে অবসরের প্রস্তুতি। ছবি: এএফপি।

দেশকে ওয়ার্ল্ড কাপ এনে দেওয়ার পরেই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট থেকে অবসর ঘোষণা করলেন ক্রিকেটের তিন তারকা— বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা আর রবীন্দ্র জাদেজা। দেশবাসীর তাতে মনখারাপ, সন্দেহ নেই। কিন্তু ২২ গজের এই ২০ ওভারের মায়া কাটিয়ে যাওয়া কি সহজ? তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে বেশি। তারই সঙ্গে আসছে অবসর সংক্রান্ত আরও নানা প্রশ্ন। একটানা কোনও কাজের সঙ্গে বহু বছর যুক্ত থাকার পর বিচ্ছেদ, তা কি উদ্বেগ বাড়ায়?

Advertisement

আপনি দশটা-পাঁচটার কেরানি হন বা নামী কর্পোরেটের ব্যস্ত বড়বাবু, অধ্যাপক হন বা অভিনেতা— সারা জীবন কেউ যে কাজ করে জীবনধারণ করেন, সে কাজের সঙ্গে জুড়ে যায় তার পরিচয় এবং দৈনন্দিন অভ্যাস। সেখান থেকে অবসরের পরে আসে তীব্র মানসিক অবসাদ। সেই উদ্বেগে ভুগছে একান্ত ভাবে চাকরি-নির্ভর বাঙালি যুব সমাজ।

আজকাল বিয়ের বয়স অনেকটাই পিছিয়ে গিয়েছে। সন্তান বড় হতে হতে কাছে চলে আসছে অবসরের বয়স। পুরুলিয়ার একটি কলেজের মনোবিদ্যার শিক্ষক মৌসুমী ময়রার মতে, ‘‘এখন আমি অনেক ক্লায়েন্ট পাই, বিশেষত যাঁরা কিছু দিন হল বিয়ে করেছেন, সদ্য সন্তান হয়েছে, দায়িত্ব বেড়েছে এবং একান্ত ভাবেই চাকরি-নির্ভর, তাঁরা অবসর নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। আবার যাঁরা বিয়ে করেননি, বা বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছে, তাঁরাও অবসর নিয়ে উদ্বিগ্ন। কারণ, অফিস ছাড়া তাঁদের জীবনে আর কিছুই নেই।’’

বহুজাতিক সংস্থায় চাকরিরত স্বাগতা বসুর বয়স চল্লিশ। চাকরির এখনও বাকি অন্তত কুড়ি বছর। কিন্তু এখন থেকেই অবসর নিয়ে বেশ চিন্তিত তিনি। তাঁর বক্তব্য, “এই চাকরিই তো আমার একমাত্র পরিচয় হয়ে গিয়েছে। এগুলো ছাড়া বাঁচব কী নিয়ে?” চাকরি নিয়ে নেয় জীবনের সমস্ত সময়, অন্য কোনও দিকে নিজেকে গড়ে তোলার আর সুযোগ পাওয়া যায় না।

Workplace Anxiety

অবসর-উদ্বেগে ভুগছেন তরুণ চাকরিজীবীরাও। ছবিঃ সংগৃহীত।

অবসর সংক্রান্ত উদ্বেগ বা ভয়ের মূলত চারটি দিক আছে—

১) আত্মপরিচয় সঙ্কট: একটি বিশেষ সংস্থার একটি বিশেষ পদ যখন কারও একমাত্র পরিচয় হয়ে ওঠে, সেই পরিচয় ছাড়ার উদ্বেগও হয়ে ওঠে ততটা ভয়াবহ। কর্মসংস্থার দায়িত্বপূর্ণ পদে আসীন, অফিসের সকলের কাছে অপরিহার্য মানুষটি যখন অবসর নিয়ে বেরিয়ে আসেন, তাঁর মনে হয়, তিনি একেবারে মূল্যহীন হয়ে পড়েছেন।

২) আপসের ভীতি: গাড়িচালকের বেতন, ছেলেমেয়ের ঘর, বাবা-মায়ের ঘর, বসার ঘর, শোয়ার ঘর মিলিয়ে বাড়িতে একাধিক এসির বিল, কাজের লোক, আয়া, দামি গাড়ির ইএমএই, দামি ক্লাবের সদস্য থাকার খরচ, বন্ধুর বাড়ির পার্টিতে দামি স্কচের বোতলটা নিয়ে যাওয়ার বিলাসিতা যদি বজায় রাখা না যায়, সমাজে মান থাকবে না। সঙ্গে পেনশন বা সঠিক সঞ্চয় না থাকলে ছেলেমেয়ের পড়াশোনা থেকে বিয়ে, সবের দুশ্চিন্তা তো আছেই।

৩) অবসর সময়: খাতায়কলমে দিনের সাড়ে আট ঘণ্টা, বাস্তবে বারো ঘণ্টা বা তারও বেশি সময়, সঙ্গে যাতায়াত মিলিয়ে আরও খানিকটা সময়। সপ্তাহে পাঁচ বা ছ’দিন এই সম্পূর্ণ সময়ের ব্যস্ততা নিয়ে জীবনের এতগুলি বছর কাটানোর পরে আচমকা অনেকটা ফাঁকা সময় পেয়ে অনেকে দিশেহারা বোধ করেন। সারা দিন অফিস নিয়ে অভিযোগ-বিরক্তিময় ব্যস্ততম দিনগুলির কথা ভেবেই মানুষ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তবে কলকাতা পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত ডিএসপি প্রভাতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “সবটাই মানসিক প্রস্তুতির বিষয়। মানসিক ভাবে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে যে, সারা জীবন এই ব্যস্ততা থাকবে না, নিরাপত্তাও থাকবে না।”

অবসর সংক্রান্ত মানসিক প্রস্তুতির উপায় কী?

চাকরির উপর নির্ভরতা কমানো জরুরি। জীবনের যে আরও নানা দিক আছে, সে বিষয়ে প্রথম থেকেই সচেতন থাকা দরকার। মৌসুমীর মতে, ‘‘চাকরির বাইরেও নিজের একটা জগৎ তৈরি করা ভাল।’’

কিন্তু বর্তমান সময়ে, সভ্যতার এই বেদম দৌড় কি এক জন বেসরকারি সংস্থার কর্মীকে সেই সময়টা দিতে পারে?

ভবিষ্যতের কথা ভেবে, ব্যস্ত দিন থেকে কিন্তু নিজেকেই সময় বার করে নিতে হবে। দিনে এক ঘণ্টা বা অন্তত সপ্তাহে এক ঘণ্টা বার করে গিটার বা তানপুরাটির ধুলো ঝেড়ে কিন্তু বসাই যায়, বা ঝালিয়ে নেওয়া যায় ভুলে যাওয়া লেখার অভ্যাস।

সমাজমাধ্যমের এই যুগে কিন্তু নিজের একটা পরিচিতি তৈরি করা খুব কঠিন নয়। গান হোক বা রান্না, অভিনয় হোক বা আবৃত্তি— নিজের ছোট ছোট ভিডিয়ো তৈরি করে নিজের সমাজমাধ্যমের পাতায় দিতে পারেন। অন্যেরা জানুন, আপনি কেবল অমুক অফিসের বড়বাবু বা তমুক কলেজের দিদিমণিই নন! একটাই পরিচয়ে নিজেকে বেঁধে না ফেলে বরং ছড়িয়ে দিন খানিক, যাতে অবসরের পরে উদ্বেগ নয়, শুরু হয় আপনার জীবনের দ্বিতীয় ইনিংস!

আরও পড়ুন
Advertisement