Intestine Health

অন্ত্রের সুস্থতা

স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় সামান্য বদল ভাল রাখে অন্ত্রের স্বাস্থ্য। সঙ্গে সচেতনতা ও চিকিৎসকের পরামর্শ জরুরি

Advertisement
কোয়েনা দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০২৪ ০৯:২৩
—প্রতীকী চিত্র।

—প্রতীকী চিত্র।

পেটের সমস্যায় এখন জর্জরিত ঘরে ঘরে প্রায় অধিকাংশ মানুষই। গ্যাস, অম্বল, পেটে ব্যথা, ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য… রোগের যেন শেষ নেই। সঙ্গে খিটখিটে মেজাজ। দিনের সব কাজ পণ্ড। সব সমস্যার সূত্রপাত সেই পেট থেকেই। পেট ঠিক থাকলে, মাথা থাকে শান্ত, দিন কাটে সুন্দর। পেটের যোগ সরাসরি মস্তিষ্কের সঙ্গেও। আর এই পেটের মধ্যেই রয়েছে অন্ত্র। যাকে বলা হয়, শরীরের ‘দ্বিতীয় মস্তিষ্ক’। জেনারেল ফিজ়িশিয়ান ডা. সুবীর মণ্ডল বলছেন,“এক কথায় বলতে গেলে, দিনভর আমরা যা খাই, তার ‘কন্ট্রোল রুম’ এই অন্ত্র বা গ্যাস্ট্রোইনটেস্টিনাল ট্র্যাক্ট (গাট)। শরীর ও মন সুস্থ রাখতে অন্ত্রের সুস্থ থাকা জরুরি।” মুখ থেকে শুরু করে খাদ্যনালি, পেট, অন্ত্র হয়ে মলদ্বার পর্যন্ত বিস্তৃত গ্যাস্ট্রোইন্টেসটিনাল ট্র্যাক্ট।

Advertisement

সমস্যা কেন হয়?

অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, নিয়মিত কৃত্রিম খাবার খাওয়ার অভ্যেস, শারীরচর্চার অভাবে নষ্ট হয় ‘গাট হেলথ’। খাবার থেকে ওষুধ, জল বাইরের যা কিছু খাবার আমরা খাই, তার সরাসরি সংস্পর্শে আসে অন্ত্র। ফলে নানা রকমের রোগে আক্রান্ত হওয়ার একটা সম্ভাবনা থেকেই যায়। পাশাপাশি অসময়ে খাওয়াদাওয়া, পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব ইত্যাদি কারণেও নষ্ট হতে পারে অন্ত্রের স্বাস্থ্য। তবে অন্ত্রের নিজস্ব কিছু রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতাও আছে। রয়েছে কিছু উপকারী অণুজীব, যা বাইরে থেকে আসা ক্ষতিকর ব্যাক্টিরিয়াকে নিষ্ক্রিয় করে সুস্থ রাখে শরীর। এই ভাল-খারাপ ব্যাক্টিরিয়ার সমতা নষ্ট হলেও কিন্তু অন্ত্রে সমস্যা হয়। মুশকিল হল, অধিকাংশ মানুষ প্রাথমিক ভাবে এ বিষয়ে আমল দেন না। ফলে দেখা দেয় হজমশক্তি, পাচনতন্ত্রে সমস্যা।

মস্তিষ্ক এবং অন্ত্রের স্বাস্থ্য পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এর মধ্যে যে কোনও একটায় সমস্যা হলেই, তার প্রভাব অন্যটার উপরে পড়ে। ফলে অতিরিক্ত স্ট্রেসের কারণেও অনেক সময়ে অন্ত্রের সমস্যা হয়। ডা. মণ্ডলের কথায়, “এর ফলস্বরূপ পেটের গণ্ডগোলের সঙ্গে ক্লান্তি, অবসাদ, মুড সুয়িং, একাগ্রতার অভাব ইত্যাদি দেখা দেয়।”

উপসর্গ

অন্ত্রের সমস্যায় সাধারণত গা গোলানো, বমি হওয়া, পেটে ব্যথা, ডায়রিয়া এ ধরনের সাধারণ উপসর্গ দেখা যায়। গ্যাস্ট্রোএন্ট্রোলজিস্ট ডা. অর্ক মুখোপাধ্যায় বলছেন, “এ ক্ষেত্রে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে শরীর নিজেই রোগ প্রতিরোধ করে ফেলতে পারে। ডায়রিয়া হওয়া এক অর্থে ভাল। এর ফলে শরীর থেকে ক্ষতিকর জিনিস বেরিয়ে যেতে পারে। তাই এ সময়ে কেবল ওআরএস খেলেই হয়। সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তা ছাড়া, অ্যান্টিবায়োটিকের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে অন্ত্রে থাকা ভাল ব্যাক্টিরিয়াও মরে যেতে পারে। তাই অ্যান্টিবায়োটিক যতটা সম্ভব কম খাওয়াই ভাল।”

  • পাশাপাশি গাটে গুড ব্যাক্টিরিয়ার তুলনায় যখন ব্যাড ব্যাক্টিরিয়ার সংখ্যা বেশি হয়ে যায় তখন খাবার ঠিক ভাবে হজম হয় না। ফলে গ্যাস, অম্বলের মতো নানা সমস্যা দেখা দেয়।
  • গাটের যে কোনও সমস্যা যেমন প্রদাহ, পেট খারাপ, হজমের সমস্যা হলে, সমস্যা হতে পারে ত্বকেও। ত্বক লাল হয়ে যাওয়া, এগজ়িমা ইত্যাদি দেখা দেয়।
  • হতে পারে লিকি গাটও। অন্ত্রের বিশেষ অংশ ক্ষুদ্রান্ত্রের অভ্যন্তরে থাকে একটি আস্তরণ, যা জীবাণু এবং ক্ষতিকারক উপাদান থেকে অন্ত্রকে দূরে রাখে। লিকি গাটের ফলে ক্ষুদ্রান্ত্রের এই আস্তরণে তৈরি হয় ছোট ছোট গর্ত। ব্যাক্টিরিয়া, গ্লুটেন, খাবারের তন্তু তখন মিশে যায় রক্তে। ফলে শরীরে ইনফেকশন হয়, অস্থিসন্ধিতে ব্যথা, প্রদাহ ইত্যাদিও হতে পারে। কিছু সময়ে বহু অটো-ইমিউন রোগের প্রধান কারণ এই লিকি গাট।

তবে এ তো গেল সাধারণ অসুখের কথা। এ ছাড়া অন্ত্রে টিবি, ক্রোন ডিজ়িজ়, আলসার ইকোলাইটিস-এর মতো গুরুতর কিছু সমস্যাও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে কিন্তু সাত দিনেও সাধারণ সমস্যা না কমলে, চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

অন্ত্র ভাল রাখার মন্ত্র

অন্ত্র ভাল রাখতে পারলেই সব পেটের অসুখকে সহজেই বিদায় জানানো যায়। তার জন্য গাট-এর খেয়াল রাখতে পারে কিছু খাবার।

  • সুষম খাবার: ডা. সুবীর মণ্ডল বলছেন, “স্বাভাবিক ভাবে ভারতীয়দের যে ধরনের খাদ্যাভ্যাস তাতে কোনও সমস্যা নেই। ভাত, রুটি, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ খাওয়া যেতে পারে সবই। হলুদ, জিরে, লঙ্কা, ধনে... স্বাভাবিক ভাবে যে ধরনের মশলা আমরা রোজকার খাবারে খাই প্রতিটিরই রয়েছে নানা গুণ। শরীরের জন্য সে সবই উপকারী।”
  • ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার: শরীরের দরকার পর্যাপ্ত পরিমাণে ফাইবার, ভিটামিন, মিনারেল ও আয়রন। রোজকার খাদ্যতালিকায় তাই রাখতে হবে সবুজ শাক, আনাজপাতি, তাজা রসালো ফল। পালং শাক, ব্রকোলি, রসুন, বাঁধাকপি খাওয়া ভাল। ফলের মধ্যে কলা, আঙুর কমলালেবু, নানা ধরনের বেরি জাতীয় ফল ইত্যাদি রাখতে পারেন।
  • স্যজাতীয় খাবার: ওটস, কর্নফ্লেক্স, ব্রাউন রাইস, বার্লি ইত্যাদি হোল গ্রেন ফুড খেতে পারেন। প্রয়োজনীয় পুষ্টি যেমন ফাইবার, অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট ও অন্যান্য মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট এতে ভরপুর থাকে। কোষ্ঠকাঠিন্য ও পেটের বিভিন্ন সমস্যা এর ফলে দূরে থাকে।
  • প্রোবায়োটিক এবং প্রি-বায়োটিক: এ ধরনের বিভিন্ন সাপ্লিমেন্ট এখন সহজলভ্য। দৈনন্দিন খাবারেও কিন্তু দই, চিজ়, ভিনিগার, আচার ইত্যাদি ধরনের ফার্মেন্টেড অর্থাৎ ভাল ব্যাক্টিরিয়া-সম্পন্ন খাবার রাখতে পারেন। এ ধরনের খাবার অন্ত্রের জন্য উপকারী। সবুজ আনাজপাতিতেও ভাল ব্যাক্টিরিয়ার জোগান থাকে। ভাত, চিঁড়ে, নানা ধরনের বাদামও অন্ত্রের মধ্যে থাকা উপকারী ব্যাক্টিরিয়ার কর্মক্ষমতা অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়।
  • সঙ্গে পর্যাপ্ত পরিমাণে জল খাওয়া জরুরি। চা, গ্রিন-টি, বাটারমিল্ক, ডাবের জল ইত্যাদিও খেতে পারেন।

এড়িয়ে চলুন

  • কৃত্রিম প্যাকেটজাত যে কোনও খাবার, এমএসজির মতো যে কোনও কৃত্রিম মশলা, প্রসেসড ফুড, জাঙ্ক ফুড থেকে সংক্রমণের ভয় বেশি থাকে। এ ধরনের খাবার অবশ্যই এড়িয়ে চলতে হবে।
  • তেল-মশলাও শরীরের জন্য জরুরি। তাই বলে অতিরিক্ত তেল, মশলাদার খাবার খাওয়া চলবে না।
  • নির্দিষ্ট কোনও ধরনের খাবারে অ্যালার্জি থাকলে সে খাবার পরিহার করতে হবে।
  • অতিরিক্ত মিষ্টি খাওয়াও অন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর।
  • মশলাদার স্ন্যাক্স, চকলেট এড়িয়ে চলতে হবে এ সবও।
  • রাস্তার ধারের কাটা ফল, রঙিন পানীয়, সোডা, বিভিন্ন ধরনের সফ্ট ড্রিংক বাদ দিন একেবারেই।

রোজকার জীবনে সুস্থ থাকতে অন্ত্রের যত্ন নিতে হবে। স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় সামান্য কিছু বদল আনলেই কিন্তু অন্ত্রের স্বাস্থ্য ভাল রাখা সম্ভব। সঙ্গে দরকার সচেতনতা ও সময় মতো চিকিৎসকের পরামর্শ।

আরও পড়ুন
Advertisement