Harmful effects of Self-Medication

ইচ্ছামতো ওষুধ খেয়ে বাড়ছে বিপদ, ঘটছে মৃত্যু! কেন? মেডিক্যাল কাউন্সিলের নজরে কলকাতার প্রবীণরা

ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর)-এর সমীক্ষা দেখিয়েছে, প্রতি ১০০ জন প্রবীণ নাগরিকের মধ্যে ২৮ জনই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ইচ্ছেমতো ভুল ওষুধ খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে।

Advertisement
চৈতালী চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১০:০৬
28 Out of every 100 elderly Indians are at the risk of consuming inappropriate medication, ICMR warns against self-medication

নিজে থেকে ওষুধ খেয়ে বিপদে পড়ছেন বয়স্করা, কেন এই প্রবণতা বাড়ছে? প্রতীকী ছবি।

জ্বর-পেটখারাপ-মাথাব্যথা হলে এক দিন বা দু’দিনের ওষুধ কিনে নেওয়া হয়। সমস্যা মিটে গেলে ওষুধ খাওয়া অপ্রয়োজন বলে মনে হয়। ফলে কোর্স শেষ না করেই ওষুধ বন্ধ। শুনে মনে হবে, চিকিৎসকের কাছে যাওয়া সম্ভব নয় যাঁদের, তাঁরাই করেন এমন কাজ। তা কিন্তু ঠিক নয়। আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়ারা কেবল নন, একই কাজ করছেন আর্থিক ভাবে সচ্ছল গোষ্ঠীর অনেকে। আর তাঁদের মধ্যে বয়স্কদের সংখ্যাই বেশি।

Advertisement

সম্প্রতি ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর) এ সংক্রান্ত একটি সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। সেখানেই বেরিয়ে এসেছে এমন তথ্য। তারা দেখিয়েছে, প্রতি ১০০ জন প্রবীণ নাগরিকের মধ্যে ২৮ জনই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ইচ্ছেমতো ভুল ওষুধ খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তার থেকে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে।

দেশের ৬টি বড় শহরে এই সমীক্ষা চলছে, যার মধ্যে একটি কলকাতাও। এ ছাড়া, দিল্লি, চেন্নাই, গুয়াহাটি, উজ্জ্বয়িনীতে প্রাথমিক ভাবে সমীক্ষা শুরু হয়েছে। এর পরে অন্যান্য শহরেও সমীক্ষা হবে বলে জানিয়েছে আইসিএমআর। গবেষণা সংস্থাটি দাবি করেছে, নিজের ইচ্ছায় ওষুধ খাওয়াতে বিপদের আশঙ্কা যথেষ্ট, তা জেনেও এমন কাজ করে চলেছেন বয়স্করা। আরও একটি অত্যন্ত অবৈজ্ঞানিক উপায় হল ইন্টারনেটে খুঁজে ওষুধের নাম বার করে তা খেয়ে ফেলা। সেই ওষুধটি আদৌ অসুখ সারাতে পারবে কি না, বা তার কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেবে কি না, সে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র চিন্তা নেই বেশির ভাগেরই।

বয়স্কদের মধ্যে ইচ্ছামতো ওষুধ খাওয়ার প্রবণতা কেন?

চিকিৎসকরা বিষয়টি নিয়ে রীতিমতো চিন্তিত। জেরন্টোলজিস্ট ধীরেশ চৌধুরী আনন্দবাজার অনলাইনকে বললেন, “অসুস্থ হলে হাসপাতালে যাওয়ার প্রতিবন্ধকতা হল, শহরকেন্দ্রিক সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা পেতে হলে সাধারণ মানুষকে কাকভোরে গিয়ে সারা দিন অতিবাহিত করতে হয়, যা রোজগারের ক্ষতি করে। আর বেসরকারি হাসপাতালগুলির খরচ সীমাহীন। সে কারণেই ওষুধের নাম জেনে নিজে থেকে খেয়ে ফেলা অনেক সহজ বলেই মনে করছেন বয়স্করা। এমনও দেখেছি, সর্দিকাশি, জ্বর কেবল নয়, থাইরয়েড, হাইপারটেনশন, ডায়াবিটিসের মতো অসুখের ওষুধও নিজে থেকেই কিনে খাচ্ছেন বয়স্করা। ইচ্ছেমতো ওষুধের ডোজ় কমাচ্ছেন আবার বাড়াচ্ছেনও।”

এমন প্রবণতার পিছনে আর্থ-সামাজিক কারণ আছে। ভাল করে খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, কলকাতা শহরে এবং এ রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় অনেক বয়স্ক মানুষই একা থাকেন। হয়তো স্বামী-স্ত্রী থাকেন বা একা ষাটোর্ধ্ব পুরুষ বা মহিলা। কর্মসূত্রে ছেলেমেয়েরা বাইরে থাকেন বা কাছে থাকলেও হয়তো মা-বাবার জন্য নিয়মিত সময় বার করতে পারেন না। এই প্রবীণ নাগরিকদের সময়মতো চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো, ওষুধ খাওয়ানোর মতো কেউ নেই। বাড়িতে হঠাৎ শরীর খারাপ করলে কে তাঁদের হাসপাতালে নিয়ে যাবেন? এই চিন্তা থেকে তাঁরা হয়তো নিজেরাই নিজেদের চিকিৎসা করে চলেছেন। জ্বর-সর্দি বা পেটের গোলমালের মতো অসুখের হাজার ওষুধের নাম চেনা। তা ছাড়া, ইন্টারনেটের দৌলতে বড় বড় অসুখগুলির ওষুধের নাম বা চিকিৎসা পদ্ধতি একটু খোঁজাখুঁজি করলেই পাওয়া যাবে। সব কিছুই এত সহজলভ্য হয়ে যাওয়ায়, এমন প্রবণতাও বেড়ে চলেছে।

আরও একটি বিষয় রয়েছে। চিকিৎসকের দেওয়া পুরনো প্রেসক্রিপশন ঘেঁটে ওষুধ কেনেন অনেকে। যাঁর যে রোগ রয়েছে, সেইমতো যা ওষুধ দিয়েছিলেন চিকিৎসক তা-ই বার বার কিনে খেয়ে ফেলা, ইচ্ছেমতো ডোজ়ে কিনে খাওয়ার প্রবণতাও বেশি। চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার এই বিষয়ে একমত। তিনি জানালেন, রোগী এক বার চিকিৎসকের কাছে গিয়ে ওষুধ নিয়ে আসার পরে ফের তার রিপোর্ট দেখাতে যান না। বয়স্কদের সংখ্যাই এখানে বেশি। ফলে রোগ সেরে যাওয়ার পরে, ওষুধের ডোজ়ও যে বদলে দেওয়া হয়, সে ধারণাই নেই বেশির ভাগের। ফলে প্রথমে যে ডোজ়ে ওষুধ দেওয়া হয়েছিল, তাঁরা পরেও সেই একই ডোজ়ে ওষুধ কিনে খেতে শুরু করেন। আর এ ভাবেই শরীরে সেই নির্দিষ্ট ওষুধটির বিরুদ্ধে ‘রেজ়িস্ট্যান্স’ তৈরি হয়ে যায়। ফলে পরে আর ওষুধটি শরীরে কাজ করে না বা তার নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে থাকে। চিকিৎসকের মতে, দোষটা কেবল ওষুধ-ক্রেতাদের নয়, বিক্রেতাদেরও। কোনও রকম বৈধ প্রেসক্রিপশন ছাড়াই ওষুধ বিক্রি হয় বেশির ভাগ জায়গাতেই।

গোড়ায় গলদ কিন্তু আরও রয়েছে। শিক্ষিত বাঙালির হোমিয়োপ্যাথি চর্চার একটা রেওয়াজ ছিল। এখনও আছে। পাশাপাশি আয়ুর্বেদ, কবিরাজি চিকিৎসার নানা পদ্ধতি ও ওষুধের নামও এখন খুঁজলে পাওয়া যায় ইন্টারনেটে। এমন অনেকেই রয়েছেন, যাঁরা শুরুতে অ্যালোপ্যাথি ওষুধ খেয়ে পরে হোমিওপ্যাথি শুরু করেছেন। আর সেই ওষুধ কী ভাবে কাজ করে, কী পরিমাণে খেতে হয় তা না জেনেই খাওয়া শুরু করেছেন। মেডিসিনের চিকিৎসক পুষ্পিতা মণ্ডল এই বিষয়ে আরও কিছু তথ্য দিলেন। তাঁর কথায়, অনেক বয়স্ক রোগীই নাকি বলেন চিকিৎসকের কাছে গেলে তাঁরা অহেতুক অতিরিক্ত ওষুধ লেখেন, এটা-ওটা পরীক্ষা করতে দেন। এতে সময় ও অর্থ দুইই নষ্ট হয়। তার থেকে নিজে ওষুধ কিনে খেয়ে নেওয়া ভাল। এমন মানসিকতাই আসলে বিপদ বাড়াচ্ছে।

চিকিৎসকদের পরামর্শ, কোন রোগের জন্য কী কী ওষুধ ব্যবহার করা যাবে, কোন ওষুধগুলি অতিরিক্ত, কখন কোন অ্যান্টিবায়োটিক টেস্ট করতে হবে অথবা কখন টেস্ট না করে ওষুধ দেওয়াই যাবে না— তার একটি খসড়া করা উচিত। প্রবীণদের সুরক্ষার জন্য স্বাস্থ্য পরিষেবা আরও বাড়াতে হবে। এখন এই রাজ্য জুড়ে এমন অনেক সংস্থা আছে, যাদের মাধ্যমে জেরিয়াট্রিক কেয়ারগিভারদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়। রুটিন চেকআপ থেকে শুরু করে হাসপাতালে ভর্তি করানো, সেখানে নিয়মিত ভিজ়িট করা, মেডিক্লেমের পেপার দেখিয়ে ডিসচার্জ করানো-সহ আরও অনেক কাজই করেন তাঁরা। তেমন সংস্থাকে এগিয়ে এসে কার্যকরী ভূমিকা নিতেই হবে।

Advertisement
আরও পড়ুন