বন্ধু রাজকে নিয়ে কলম ধরলেন রুদ্রনীল।
সোমবার, ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবসের দিনে জন্ম রাজ চক্রবর্তীর। কত বয়স হল? আমরা কি বড় হয়ে যাচ্ছি? এ সব কথা বাদ দিন। আমরা ঠিকই করে নিয়েছি, যত দিন মনের বয়স না বাড়বে তত দিন আমরা বুড়ো হব না। রাজ-আমি, আমরা এক থালার বন্ধু। এক বালিশেরও! সেই কথায় পরে আসছি। তার আগে জানাই, গত রাত থেকে বিধায়ক-পরিচালক বন্ধুর জন্মদিনে কী কী করেছি আমরা।
কাল রাজকে জন্মদিন উপলক্ষে বিদেশি সুগন্ধী উপহার দিয়েছি। এর পিছনেও গল্প আছে। রাজ বরাবরের ফিটফাট, শৌখিন। পরিষ্কার জামা-কাপড়, পরিচ্ছন্ন হয়ে থাকা, এ সবগুলো ওর স্বভাব। তখন আমরা মেসবাড়িতে। সুগন্ধি কেনার পয়সা নেই। রাজ তাই মোটা করে পাউডার মেখে থাকত। কেন? যাতে গা দিয়ে ঘেমো গন্ধ না বেরোয়। পোশাকও ময়লা হবে কম। ফিটফাট দেখতে লাগবে। এখন আমরা বয়সে, পেশায় সব দিক থেকেই এগিয়েছি। নিজেরা উপার্জন করছি আগের তুলনায় বেশি। সামনে গরম। নানা কারণে রাজকে বাইরে বেরোতে হবে। যাতে আগের মতোই ফিটফাট থাকে, তাই এই উপকরণ।
সল্টলেকের একটি নিশিনিলয়ে (পাব) জনা ৫০-৬০ জন ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা জড়ো হয়েছিলাম জন্মদিনের আগের রাতে। আবীর চট্টোপাধ্যায়, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় আসতে পারেননি। ওঁরা কলকাতার বাইরে। পার্টিতে আমি, ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত, পদ্মনাভ দাশগুপ্ত এবং আরও কিছু জন। পরিবারের তরফ থেকে রাজের ভাগ্নি, দিদি ছিলেন। ছিলেন শুভশ্রীর দিদি দেবশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়, তাঁর ছেলেও। বাদ একমাত্র ইউভান! খুব মিস করেছি ওকে। ইউভান আসর জমাতে একাই একশো। কিন্তু অতিমারি কমেনি। তাই রাজ-শুভ ওকে আনেনি।
আয়োজনে, তদারকিতে শুভশ্রী। আসরের মধ্যমণি পরিচালক বন্ধু। ওর জন্য তিনতলা স্ট্রবেরি কেক। নানা উপহার। রাজের মুখ যদি দেখতেন! লাজুক মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সবাইকে আপ্যায়ন করছে। সঙ্গে ঢালাও খানা-পিনা। কেক কেটে শ্যাম্পেনের ফোয়ারায় ভিজেছে ‘বার্থ ডে’ বয়। পাঁঠা, মুরগি, মাছের নানা স্বাদে অতিথিদের রসনা তৃপ্তির আয়োজন। স্ন্যাক্সের তালিকা দেখলেই মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। হঠাৎ শুভশ্রীর হাঁক, ‘‘রুডি (বন্ধুরা ভালবেসে) তুমি কোথায়?’’ কাছে যেতেই রাজের দিকে ইশারা, ‘‘দেখো, ওর চোখে জল!’’ বুঝলাম, বয়সের কথা যতই ভুলুক, ফেলে আসা দিনগুলোকে ভোলে কী করে? সেই সব দিন সামনে ভিড় করে দাঁড়াচ্ছে। আবেগে আমার অনুভূতিপ্রবণ বন্ধু কাঁদছে!
একটা সময় রাজ আর আমি খুব অভাবের মধ্যে দিয়ে গিয়েছি। আমাদের খাওয়ার জন্য আলাদা থালা ছিল না। একটি থালার একদিকে আমি। অন্যদিকে রাজ। আমরা এভাবেই খেতাম। দুটো বালিশে আলাদা মাথা রেখে ঘুমব? সেই বিলাসিতার সাধ্যই নেই। মেসবাড়ির একটি খাটে একটিই বালিশ। আমরা ভাগাভাগি করে তাতে মাথা রেখে জেগে জেগেই স্বপ্ন দেখতাম। আমি বরাবরের আগোছালো। কোথাও থেকে ফিরে জুতোজোড়া ছুড়ে দিতাম একদিকে। দড়ি থেকে ঝুলত ছেড়ে রাখা জামা-প্যান্ট। আকাচা পোশাক পরেই হয়তো কাজ খুঁজতে চলে যেতাম। রাজের এসব না-পসন্দ। নিজে ফিটফাট থাকত। অন্যদেরও রাখার চেষ্টা করত। কত সময় আমার, বাকি বন্ধুদের পোশাক নিজে হাতে কেচে পরিষ্কার করে দিয়েছে। ছড়িয়ে রাখা জুতো, বাকি জিনিস গুছিয়ে রাখত নিজের হাতে!
তার মধ্যেই বড় অঘটন, মেসবাড়িতে কোনও মেয়ে বন্ধু এলে। রাজ কিন্তু মনে মনে দারুণ প্রেমিক। কিন্তু এত মুখচোরা, লাজুক যে কিছুতেই মুখে তা জানাবে না। চোখের দিকে চোখ তুলে কথা পর্যন্ত বলতে পারত না বেচারি। ফলে, মেয়ে দেখলেই ধাঁ। এ দিকে, আমাদের সেই বান্ধবীর হয়তো রাজকে পছন্দ। সে ওর সঙ্গে একটু কথা বলতে চায়। সে গুড়ে বালি। পরেও ক’জনকে ও যে নিজমুখে প্রস্তাব দিয়েছে কে জানে! বিষয়টি নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আমার মনে হয়, রাজের সেই সমস্ত নিরুচ্চারিত প্রেমই ওর ভালবাসার ছবি। সে সব ছবি প্রচণ্ড হিট। রাজ এই ধরনের ছবি বানাতেও তাই মাস্টারপিস।
আজও আগের মতোই পরনিন্দা পরচর্চা করতে দেখলে রেগে যায় ও। আমি আর শুভশ্রী একসঙ্গে হলেই গজগজ করতে থাকে, ‘‘এই আবার দুই মাথা এক হয়েছে। তোদের এত কথা কিসের রে? যে যা করছে করুক না! তোদের তাতে কী!’’ তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজের বাহ্যিক কিছু পরিবর্তনও হয়েছে। রাজ আগের থেকে অনেক চৌখস। গুছিয়ে কথা বলে। আর মনে হয় আগের মতো কারওর চোখের দিকে তাকাতে লজ্জা পায় না। কিন্তু মিশলেই বোঝা যাবে, অন্তর জুড়ে পুরনো রাজ বহাল তবিয়তে বিরাজ করছে। রাজ, তুই এমনটাই থাকিস। মিঠেকড়া হয়ে। তোকে এটাই মানায়।