Poacher Review

শহুরে স্বার্থপরতার শেষ কোথায়?

কাহিনি অনেকটা এ রকম— ২০১৫ সালে কেরলের মালায়াত্তুর অঞ্চলের এক নিচুতলার বনকর্মী আরুকু খবর দেয়, চোরাশিকারিরা ফের সক্রিয় হয়েছে।

Advertisement
দীপান্বিতা মুখোপাধ্যায় ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০২৪ ০৮:৩২
Poacher Review

‘পোচার’ সিরিজ়ের একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত।

নিরুদ্বিগ্ন স্বরে পুলিশটি বলছিল, কংক্রিটের জঙ্গলে বসবাসকারীরা বনের হাতি মারা যাওয়া নিয়ে চিন্তা করে না। মানুষ মরলে তা-ও কথা ছিল। দূষণের বিপদসীমায় বাস করা দিল্লি নগরীর সেই পুলিশকে ইকোসিস্টেম বোঝানোর ঝক্কি নেয়নি বন দফতরের কর্মী মালা। শহুরে মানুষদের কাছে হাতি-টাতি নিতান্তই জংলি ব্যাপার। অন্য দিকে আর এক জনজাতি, যে বিলক্ষণ জানে হাতির পালের জন্য কী ভাবে তাদের খেতের ফসল নষ্ট হয়। তবুও সে বোঝে বন্যপ্রাণ হত্যা কত বড় অপরাধ। তাই সেই অপরাধে শামিল হওয়ার পরেও দোষ খণ্ডনের তাড়নায় ভোগে। দুটো চরিত্রই প্রাইম ভিডিয়োর ‘পোচার’ সিরিজ়ের। ‘দিল্লি ক্রাইম’-এর পর রিচি মেহতা কেরলের হাতির দাঁত শিকারের ঘটনা নিয়ে সিরিজ় তৈরি করেছেন। বিষয়ের গভীরতার কারণে এ সিরিজ়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন আলিয়া ভট্ট। কাল্পনিক থ্রিলারের ভিড়ে সত্য ঘটনা নির্ভর ‘পোচার’ ভাবনার খোরাক দেয়। প্রশ্ন তোলে, শহুরে স্বার্থপরতার শেষ কোথায়?

Advertisement

কাহিনি অনেকটা এ রকম— ২০১৫ সালে কেরলের মালায়াত্তুর অঞ্চলের এক নিচুতলার বনকর্মী আরুকু খবর দেয়, চোরাশিকারিরা ফের সক্রিয় হয়েছে। ১৮টি হাতি মেরে দাঁত কেটে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। অথচ বন দফতর অন্ধকারে। সাময়িক লোভে আরুকু নিজেও শামিল হয়েছিল তাতে। কিন্তু বিবেকের দংশন তাকে টিকতে দেয়নি। খবর পেয়ে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে রাজ্যের বন দফতর। ওয়াইল্ড লাইফ ক্রাইম বুরো-সহ একাধিক এজেন্সি শামিল হয় এই প্রজেক্টে। মালা (নিমিশা সজায়ান), অ্যালেন (রোশন ম্যাথিউ), নীল (দিব্যেন্দু ভট্টাচার্য) দিন-রাত এক করে দেয় শিকারিদের ধরপাকড়ে।

কেরল জুড়ে একাধিক ন্যাশনাল পার্ক, স্যাংচুয়ারি, বায়োস্ফিয়ার রিজ়ার্ভ। প্রকৃতি এ রাজ্যকে উজাড় করে দিয়েছে। কিন্তু ভগবানের আপন দেশে লুঠতরাজ চালানোর মতো দুষ্কৃতীরও অভাব নেই। সরকারি সূত্র অনুযায়ী, ১৯৯৫-এর পর থেকে কেরলে হাতি শিকারের ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু ২০১৫-তে ফের আইভরি পোচিংয়ের ঘটনা সামনে আসে। হাতির দাঁতের বড় ক্রেতা ছিল চিন। ক্রমশ এ দেশেও ক্রেতা বাড়তে লাগল। কোটি কোটি টাকায় বিকোত হাতির দাঁতের শৌখিন পণ্য। গজদন্ত দিয়েই তৈরি হতে লাগল গণেশের মূর্তি! দিল্লির এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৫০০ কিলোর বেশি হাতির দাঁত উদ্ধার করেছিল কেরল বন দফতর। তখনই বোঝা গিয়েছিল, চোরাচালানের শাখাপ্রশাখা কতটা বিস্তৃত।

‘পোচার’ শুধু শিকারের গল্প বলে না। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সংযোগের গল্পও বলে। অপরাধীদের ধরতে প্রাণপাত করে দেওয়া মালা আসলে চোরা অপরাধবোধে ভোগে। তার নিজের বাবাও যে পোচার ছিল। টিম লিডার নীল ব্যানার্জি তার ক্যানসারের কথা চেপে রেখে লড়ে যায়। অ্যালেন বাড়িতে খোলাখুলি বলতেই পারে না, তার আসল কাজটা কী। এ কাজে মন্ত্রগুপ্তি আছে। নিমিশা, রোশন এবং দিব্যেন্দু, এই তিন অভিনেতার উপরেই সিরিজ় দাঁড়িয়ে। তাঁদের সহজাত, স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয় দর্শককে কাহিনির সঙ্গে একাত্ম করে। পার্শ্বচরিত্রের অভিনেতারাও তারিফযোগ্য। স্থানীয় মানুষকে চরিত্র হিসেবে তুলে ধরায় তা আরও বিশ্বাসযোগ্যতা পেয়েছে। তবে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কানি কস্রুতির মতো অভিনেত্রীকে ঠিক মতো ব্যবহার করা হয়নি।

এ সিরিজ়ের সবুজ ক্যানভাস চোখের আরাম। দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে যাওয়ার সময়ে রূপকের মতো করে বন্যপ্রাণীর ব্যবহার প্রশংসনীয়। পরিচালক সাবলীল ভাবে গল্পটা বলেছেন। থ্রিলারোচিত সাসপেন্সও আছে। তবে কিছু ঘটনায় খটকা লাগে। স্থানীয় পোচারদের নিয়ন্ত্রণ করে যারা, সেই সব ব্যক্তি আড়ালে রয়ে গিয়েছে। দিল্লির ব্যবসায়ী পুনম বর্মাকে গ্রেফতার করা হয় বটে কিন্তু প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক মদত ছাড়া কি এ কাজ সম্ভব? সে সব উহ্য রয়ে গিয়েছে। সন্দেহভাজনরাও বেশ সহজেই মুখ খোলে!

‘পোচার’এ যতটুকু দেখানো হয়েছে, তা আসলে হিমশৈলের চূড়া। কেরল ছাড়া অন্যান্য রাজ্যের বন্যপ্রাণও বিপন্ন। শিকারি চক্রের বড় চাঁই ধরা পড়ার পরেও সিবিআই কর্তা এসে নিষ্পৃহ ভঙ্গিতে যখন বলে, তাদের হাতে আরও বড় বড় তদন্ত রয়েছে, তখন বোঝা যায় মাদক, অস্ত্রের চোরাচালান, সন্ত্রাসবাদের মতো অপরাধের পাশে বন্যপ্রাণী হত্যার ঘটনার আদৌ কোনও গুরুত্ব নেই। পরিবেশ-প্রকৃতি শুধু পাঠ্যবই আর সেমিনারের জন্যই। ‘দাও ফিরে সে অরণ্য’ নেহাতই ভাবসম্প্রসারণের বিষয়।

আরও পড়ুন
Advertisement